অর্থনৈতিক বৈষম্য।
একটি সামরিক ঘাঁটি ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট একটি দ্বীপ তান্নায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। যুদ্ধের পরে সৈনিকরা যখন পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেলেন, তান্নাবাসীরা সেই যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে দিনযাপন করতেন। প্রতি দিন শূন্য বিমানবন্দরে কাঠের খেলনা বন্দুক ঘাড়ে নিয়ে মশাল জ্বালিয়ে মার্চ করে বেড়াতেন এই আশায় যে, যুদ্ধের সময়ে দ্বীপে যে প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি এসেছিল, কোনও দৈববলে হয়তো তা আবার ফিরে আসবে। ওদেদ গ্যালোর তাঁর নতুন বই দ্য জার্নি অব হিউম্যানিটি-তে এই ঘটনাটির উল্লেখ করে বলছেন যে, বিশ্ব ব্যাঙ্কের উন্নয়নের প্রকল্পগুলি অনুন্নত দেশের মানুষের কাছে তান্নার মানুষের অভিজ্ঞতার মতোই অলীক আর অবাস্তব। কেন অবাস্তব, তার উৎস সন্ধানে গ্যালোর প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে যান। বিশ্লেষণ করেন মানবজাতির পথ চলা, আর্থিক স্থবিরতা থেকে সমৃদ্ধি হয়ে আজকের অসাম্যের চূড়ায় পৌঁছনো।
মানবসভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবই এমন সময়, যখন সমৃদ্ধি কার্যত সর্বজনীন হওয়ার সম্ভাবনা নিল। তার আগে কৃষিভিত্তিক সমাজে, কৃষিতে প্রযুক্তির উন্নয়ন হলেও, জীবনযাত্রার মান বাড়ল না, কারণ ম্যালথাস-এর তত্ত্ব বলছে, খাদ্য উৎপাদন বাড়লেই মানুষ সন্তান সৃষ্টিতে প্রয়াসী হত। মানুষ ক্রমে বুঝল যে, শুধু সন্তান উৎপাদন করে জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব নয়। সন্তানদের শিক্ষিত করতে হবে। উৎপাদনের উপাদান শুধু স্টিম ইঞ্জিন আর যন্ত্রপাতি নয়, মানবসম্পদও। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শিশুশ্রমের ব্যবহার কমল। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু হল। কাজে মননশীলতার প্রয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারী-পুরুষের মজুরির ফারাকও কমতে শুরু করল। মহিলারা যত কর্মস্থলে আসতে লাগলেন, সন্তান জন্মের হারও তত কমে এল। উনিশ শতকের শেষ থেকে পৃথিবীতে মাথাপিছু আয় বাড়ল বিপুল পরিমাণে। পৃথিবীতে বৈভবের জোয়ার এল।
তবে, নতুন একটি সমস্যারও সম্মুখীন হল এই বিশ্ব— চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বৈষম্য! পশ্চিম ইউরোপ আর আমেরিকার জীবনযাত্রার মান উন্নত হল ঠিকই, কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ অনুন্নতই রয়ে গেল। প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমাজেও অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ল। প্রশ্ন হল, এই বৈষম্যের উৎস কোথায়?
গ্যালোর বলছেন উন্নত দেশের মানুষদের মন হয়তো বৃদ্ধিনির্ভর, ফলে খানিকটা দূরদর্শীও বটে, যা অনুন্নত দেশে বিরল। কিন্তু কেন এই দূরদর্শিতার অসাম্য? আমাদের মনগুলো এত আলাদা কেন? এর উত্তর খুঁজতে গ্যালোর ভূগোলে চলে যান। কিছু কিছু দেশের চাষের জমি হয়তো বিভিন্ন ফসল ফলানোর উপযোগী, আবার কোনও দেশের জমিতে হয়তো চা বা কফি ছাড়া আর কিছুই ফলানো যায় না তেমন। যে দেশের জমিতে বিভিন্ন রকমের ফসল ফলে, সেখানে মানুষের আচরণ অনেক বেশি বাজার ও বৃদ্ধিকেন্দ্রিক হয়ে গেল। যেখানে চা-কফি ছাড়া আর কিছু উৎপাদন হয় না, সেই দেশগুলি অনুন্নত হয়েই রইল দাসপ্রথার ইতিহাসকে জিইয়ে রেখে। যে জমিতে লাঙলের ব্যবহার বেশি, কায়িক শক্তির কারণে সেই দেশগুলি পুরুষকেন্দ্রিক লিঙ্গবৈষম্যের সমাজে রূপান্তরিত হল।
গ্যালোর আরও বলছেন যে, উন্নতির আসলে কোনও বাঁধাধরা গৎ নেই। বিভিন্ন দেশের তন্ত্রী বিভিন্ন সুরে বাজে। কী সুরে বাজবে, তার পিছনে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিকা রয়েছে। কোনও কোনও দেশের অগ্রগতির জন্য সংস্কৃতির বৈচিত্র খুবই অনুকূল। আবার কোনও কোনও দেশে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ যখন নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস হারিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তা উন্নয়নের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং বিশ্ব ব্যাঙ্কের সংস্কারের বাঁধাগতের দাওয়াই অনেক অনুন্নত দেশের মানুষের কাছে তান্নাবাসীদের উপলব্ধির মতোই অলীক।
পৃথিবী আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এক দিকে, প্রযুক্তি দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানকে প্রতিনিয়ত উন্নত করছে। অন্য দিকে, সেই প্রযুক্তি পরিবেশ দূষণ করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জীবন বিপন্ন করছে। যে ভাবে শিল্পবিপ্লবের পর মানবসম্পদের বিকাশ আমাদের বৃদ্ধির কক্ষপথে পৌঁছে দিয়েছিল, সেই একই মানবসম্পদের উপরে ভরসা রেখে আশা করি আমরা এই দুর্দিনও অতিক্রম করব। শিক্ষার প্রসার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী ধরনের শিক্ষা একটি দেশের পক্ষে উপযোগী হবে, সে বিষয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক পরিষ্কার ভাবে কিছু বলছে না। একটি দেশের শিক্ষার পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সেই দেশের সংস্কৃতি এবং ভৌগোলিক পটভূমির সাযুজ্য থাকা প্রয়োজন। যে দেশে অনেক সংস্কৃতির মানুষ বাস করেন, সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণুতা বাড়ানোর কথা থাকা উচিত। যে দেশে সংস্কৃতির মধ্যে খুব বৈচিত্র নেই, সেখানে সিলেবাসে চলতি ধ্যানধারণাকে প্রশ্ন করার রসদ থাকা বাঞ্ছনীয়। যে দেশে নারী-পুরুষে অসাম্য, সেখানে ছাত্রদের সিলেবাসে লিঙ্গসাম্যের প্রাধান্য থাকা দরকার। প্রয়োজন হল স্থান-কালভিত্তিক শিক্ষার প্রসার, যা মানুষের মনের জানলাগুলি খুলে দেবে।
যদিও গ্যালোরের বইটির মূল প্রতিপাদ্য আন্তর্দেশীয় অসাম্য, তিনি বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বৈষম্যের বিষয়েও তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। বইটির প্রতি পরিচ্ছেদেই চিন্তার ফসল আছে। তবু প্রশ্ন রয়েই যায় আমাদের ভারতের সম্বন্ধে, যেখানে বৈষম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যে দেশে শীর্ষের এক শতাংশ মানুষ দেশের বাইশ শতাংশ সম্পদ ভোগ করেন, যে দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ, বিভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে বাস করা সত্ত্বেও অসহিষ্ণুতার বিষ হিংসার বীজ বপন করে চলে, যে দেশে লিঙ্গবৈষম্য, দুর্নীতি দৈনন্দিনের সঙ্গী, কী ধরনের শিক্ষানীতি সেই দেশকে সুখ সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে?
অর্থনীতি বিভাগ, ডারহাম ইউনিভার্সিটি