fishing

জল হারাচ্ছেন জেলেরা

নদী-খাল-বিল দিনের আলোয় দখল হয়ে যাচ্ছে। তার উপরে জলকে কামড়ে ধরেছে দূষণ, প্রভাব পড়ছে মাছের প্রজননে।

Advertisement

সুপ্রতিম কর্মকার

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২১ ০৬:৩৫
Share:

সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করলে মাছ ভাল ওঠে, জলে বিপদ হয় না— এমনই বিশ্বাস তামিলনাড়ুর মৎস্যজীবীদের। তাই সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে রুনিয়া আর বিজু এক সঙ্গে রাত কাটিয়েছিলেন। কিন্তু বারো দিন পেরিয়ে গেল, বিজু চিন্নাপট্টনাভর ফিরলেন না। ট্রলার মালিকের বাড়ি গিয়ে রুনিয়া জানলেন, স্বামীকে শ্রীলঙ্কার পুলিশ আটকে রেখেছে। কবে ছাড়া পাবে, কেউ বলতে পারছে না।

Advertisement

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের এই ঘটনার পিছনে কি কেবলই রয়েছে দুর্ভাগ্য? সেটা বুঝতে হলে তাকাতে হবে মাছ, মৎস্যজীবী আর নদীর দিকে। তামিলনাড়ুর ‘কারুর’ জেলায় কাবেরী নদীর থেকে বেরিয়ে আসা একটি শাখা নদী অমরাবতী। এই নদী, আর তার সঙ্গে জুড়ে থাকা কুডাকানার নদীতে মাছ ধরতেন বিজু। সম্বল বলতে একটা ছোট্ট নৌকা, জাল, আর নানা রকম মাছ মারার অস্ত্র— পাড়ি, কাচা, উঠা, সোরাটি, কাটামারান, কারাইভালাই। যেটুকু মাছ পেতেন, তা বিক্রি করে দুটো পেট চলে যেত। কিন্তু গত বছর পাঁচেকে মাছের পরিমাণ খুবই কমে গিয়েছিল, দুটো নদীতেই।

বিজু চিন্নাপট্টনাভর এখন তামিলনাড়ুর সেই মৎস্যজীবীদের প্রতিনিধি, যাঁরা নদীতে মাছ মেলে না বলে বাধ্য হয়েছেন ট্রলার মালিকের কাছে নাম লেখাতে। সমুদ্রের অভিজ্ঞতা কম, তাঁরা আন্তর্জাতিক জল সীমানা বুঝতে পারেন না। শ্রীলঙ্কা জলপ্রহরীদের হাতে গ্রেফতার হতে হয়। এমন ঘটনা নতুন নয়, কিন্তু তার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। নদীতে মাছ ধরে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

Advertisement

একই চিত্র বাংলায়। সম্প্রতি নদিয়া জেলাশাসকের অফিসের সামনে মৎস্যজীবীরা ধর্না দিয়েছেন। জেলা মৎস্য দফতরের কাছেও তাঁরা গিয়েছেন। জলঙ্গি নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন নদীপারের ওই মৎস্যজীবীরা। তাঁরা আজ মাছ পাচ্ছেন না। অথচ, বর্ষার ঠিক পরেই তাঁদের মাছ ধরার সেরা সময়, কারণ তখন নদীর দূষণ কম থাকে, মাছ ভাল মেলে। বৃষ্টি ধরলেই একটা ছোট নৌকা আর খেপলা জাল নিয়ে জেলেরা বেরিয়ে পড়তেন।

কিন্তু এখন এই মরসুমে নদীটা এই ছোট মৎস্যজীবীদের থাকে না। নদীর বুকে আড়াআড়ি লম্বা বাঁশ পোঁতা হয়, তার গায়ে লম্বা করে লাগিয়ে দেওয়া হয় মশারি জাল। স্থানীয়রা একে ‘বাঁধাল’ বলে। পরিবেশ কর্মীদের আন্দাজ, করিমপুর থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত কম বেশি ২০০টা বাঁধাল রয়েছে। একই অবস্থা দত্তপুলিয়ার ইছামতী নদীতেও। সম্পূর্ণ বেআইনি এই বাঁধাল দিচ্ছে কারা? অর্থবান, ক্ষমতাশালী, রাজনীতির মদতে পুষ্ট ব্যবসায়ীরা।

রাজনৈতিক মদতেই বহরমপুর শহরের পাশে চালতিয়া বিল, বিষ্ণুপুর বিলের জমিগুলো হাত বদল হয়ে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে ব্যক্তিমালিকানায় চলে যায় বিল। জলই যাঁদের ঘরবাড়ি, সেই দরিদ্র মৎস্যজীবীরা জল ছুঁতে পারেন না আজ। এঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বহরমপুরের কিছু স্থানীয় মানুষ। রিলে অনশন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন স্থানীয় প্রশাসনের, নেতাদের। পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করেছে।

জাতীয় মৎস্য নীতির যে খসড়া তৈরি হয়েছে, তাতে নদী, খালবিল থেকে মাছ ধরার চাইতে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে মাছ চাষের দিকে। মৎস্যজীবীদের জন্য ব্যাঙ্ক ঋণের ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু ব্যাঙ্কে দেখানোর মতো সম্পদ (জমি, ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর, ভেড়ি) তাঁদের কোথায়? দরকার হয় মৎস্যজীবী পরিচয়পত্র। সেখানেও রাজনৈতিক টানাপড়েন চলে পঞ্চায়েতের হাত ধরে, ব্লক অফিস পর্যন্ত। বাপ-ঠাকুরদার কাছ থেকে শেখা বিদ্যার প্রমাণ দেবেন ওঁরা কী ভাবে? বহু লড়াই করে চাকদহের বুড়িগঙ্গা-পারের মৎস্যজীবীরা পরিচয়পত্র পেয়েছেন। বালুরঘাটের আত্রেয়ী-পারের আর ফরাক্কার গঙ্গা-পারের জেলেপাড়ার মৎস্যজীবীরা এখনও সে লড়াই চালাচ্ছেন।

অথচ বাজারে টাটকা, মিষ্টি জলের মাছের যত চাহিদা, তত জোগান নেই। নদী-খাল-বিল দিনের আলোয় দখল হয়ে যাচ্ছে। তার উপরে জলকে কামড়ে ধরেছে দূষণ, প্রভাব পড়ছে মাছের প্রজননে। সব দিক থেকেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন ছোট মৎস্যজীবীরা। তামিলনাড়ুর মতো, বাংলার মৎস্যজীবীরাও মেদিনীপুর আর সুন্দরবনের ‘খটি’গুলোতে নাম লেখাচ্ছেন। আর ট্রলারে করে তাঁদের পাড়ি দিতে হচ্ছে সমুদ্রে। নদিয়া-মুর্শিদাবাদে অনেকে মাছ ধরা ছেড়ে দিনমজুর হয়েছেন। অনেকে হুগলি আর উত্তর ২৪ পরগনার বড় ব্যবসায়ীদের ঠিকা-নেওয়া জলাশয়ে দৈনিক মজুরিতে কাজ করছেন। স্বাধীন মৎস্যজীবী এখন প্রান্তিক।

জীববৈচিত্র, স্বাদবৈচিত্র রক্ষা করার জন্য স্বাধীন মৎস্যজীবীদের জলের অধিকার দেওয়া প্রয়োজন। ছোট চাষিকে জমির পাট্টা দেওয়ার মতো, স্বাধীন মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার অনুমোদন বা ‘জল পাট্টা’ দেওয়ার দাবিও উঠছে। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে তার রূপায়ণ করা যেতে পারে। পাট্টার ভিত্তিতে দেওয়া যায় ব্যাঙ্ক ঋণ প্রভৃতি সুবিধে, যা স্বাধীন জেলেদের মূলস্রোতে নিয়ে আসবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement