Sourced by the ABP
চার দিকে নররূপী হনুমানের দাপাদাপি, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের প্রবল বিক্রম দেখেও বাঙালি ভদ্রলোক যে এখনও নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ভদ্রলোকরা গোড়া থেকেই এক অদ্ভুত প্রজাতি। এই কারণে অদ্ভুত নয় যে, ভদ্রসম্প্রদায়ের একদম জন্মলগ্নে, সেই ১৮৫৭ সালে, যখন ভদ্রলোক কথাটা সে ভাবে চালুই হয়নি, সিপাইদের মহাবিদ্রোহে সারা ভারত যখন কাঁপছে, দেশীয় সৈন্যরা যখন লালমুখো ব্রিটিশকে এক হাত নিচ্ছে, রাজধানী কলকাতারই তখন এমন নড়বড়ে অবস্থা যে, ‘সিপাইরা আসছে’, এই গুজব রটা-মাত্র সাহেবরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালাতে শুরু করছে— সেই ক্রান্তিকালেও ‘বাবু’দের একটাই কাজ ছিল, সভাসমিতি করে, বা খবরের কাগজে ব্রিটিশের পক্ষে লেখা। বঙ্কিম বা হুতোম যে ইঙ্গবঙ্গদের নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন, স্রেফ তাঁরাই নয়, রক্ষণশীল এবং প্রবল জনপ্রিয় ঈশ্বর গুপ্ত অবধি লিখে ফেলেছিলেন, “চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশের জয়/ ব্রিটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয়।” আর বিদ্রোহীদের উদ্দেশে তাঁর বাণী ছিল, “কার কথা শুনে সবে সেজেছো সমরে? পিঁপীড়ার পাখা ওঠে মরিবার তরে।” কবিতাটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, বলা বাহুল্য। শেষ পঙ্ক্তিটা এখনও প্রবাদ হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু এটাই একমাত্র অদ্ভুত ব্যাপার নয়। আশ্চর্য ঘটনাটা হল, এর বছর দুয়েকের মধ্যেই অবস্থাটা আমূল বদলে গেল। নাকে-তেল-দেওয়া ‘বাবু’রা যেন হঠাৎ জেগে উঠলেন। দু’বছরের মধ্যেই হঠাৎ করে লেখা হয়ে গেল আদ্যন্ত ইংরেজ-বিরোধী নীলদর্পণ, অনুবাদ করে লং সাহেবের জেল-জরিমানা হল। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আগুন ঝরাতে লাগলেন হিন্দু পেট্রিয়ট-এ। এ সব তো আকাশ থেকে পড়ে না, ভিন্ন স্বর কোথাও একটা ছিলই, কল্কে পেত না, সেটাই ফুঁড়ে বেরোতে শুরু করল লাভা স্রোতের মতো। এবং শুধু তা-ই নয়, ক’বছরের মধ্যেই উপনিবেশ-বিরোধিতাই হয়ে গেল ভদ্রলোকের অভিজ্ঞান। খুচখাচ আবেদন-নিবেদন দিয়ে শুরু, কয়েক দশকের মধ্যেই গতি পেল স্বদেশি আন্দোলন। ওটাই মূলধারা হয়ে গেল। হ্যাঁ, পথ নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদ প্রচুর ছিল, ইংরেজের চেয়েও বেশি ইংরেজ লোকজনেরও কিছু অভাব ছিল না, ধামাধরা রায়বাহাদুরদেরও সংখ্যা ছিল প্রচুর, তবুও ভদ্রলোকের চেতনায় উপনিবেশ-বিরোধিতাই হয়ে গেল মুখ্য ধারা। বাঙালি ভদ্রলোক সিপাহি-বিদ্রোহের সময় নিজেদের অবস্থান নিয়ে আদৌ ভেবেছেন কি না সন্দেহ, কিন্তু তার পরেও গোটা ব্রিটিশ জমানা ধরে আন্দামান ভর্তি হয়ে গেছে বঙ্গসন্তানে, জেল-ফাঁসি-আত্মবলিদান কোনওটারই কমতি হয়নি, যত দিন না ইংরেজ দেশ ছেড়ে বিদায় নিয়েছে।
কাজেই, বিপর্যয় যখন ঘাড়ের উপর আগতপ্রায়, যখন টিভি খুললেই রামমন্দির, মাল্টিপ্লেক্সে গেলেই বলিউড, আর এফএম খুললেই হিন্দি ‘গানা’, তখনও ভদ্রসমাজ যে নাক-কান বুজে আছে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ এই উদ্ভট দ্বৈততা ভদ্র সম্প্রদায়ের মজ্জাগত। ওই এক বারই নয়, এটা একাধিক বার ঘটেছে। বিংশ শতকে বাঙালির সবচেয়ে বড় বিপর্যয়, যার নাম মন্বন্তর এবং দেশভাগ, যখন ঘটছে, তখনও এই একই গল্পের পুনরাবৃত্তি। মন্বন্তর নিয়ে ত্রাণ ইত্যাদি আধানিষ্ক্রিয় কাজকর্ম তবু কিছু ছিল, কিন্তু দেশভাগ নিয়ে ভদ্র বঙ্গসমাজ আবারও কুম্ভকর্ণ। ১৯৪৬-৪৭’এর অবস্থার কথা ভাবলেও এখন অলীক মনে হয়। কংগ্রেস নেতারা অখণ্ড বাংলায় ঠিক কতটুকু অস্ত্রোপচার করলে পশ্চিমবঙ্গে ভোটে নিরঙ্কুশ বিজয় হবে, তার হিসাব করেছেন, মুসলিম লীগ পাকিস্তান পাওয়ার ছক কষছে, টাটা-বিড়লারা ভারত ভাগ হলে অখণ্ড বাজার পাওয়া যাবে ভেবে আনন্দে আটখানা হচ্ছেন, আর বঙ্গভঙ্গ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত হরেক লড়াইয়ে দীক্ষিত, রাজনীতি-সচেতন ভদ্রসমাজ সব বুদ্ধিশুদ্ধি জলাঞ্জলি দিয়ে হয় নিস্পৃহ, নয় বাংলা ভাগের পক্ষে সওয়াল করছে। হিন্দুত্ববাদীরা হুঙ্কার ছাড়ছে, বামপন্থীরা দ্বিজাতিতত্ত্বের খোয়াবে মশগুল। এমনকি পূর্ববঙ্গের ভদ্রসমাজের একাংশ, যাঁরা উচ্ছিন্ন হবেন ক’দিন পরেই, তাঁরাও যে গাছে বসে, সেই ডাল কাটছেন, অর্থাৎ দেশভাগের পক্ষে। কত শতাংশ পক্ষে ছিলেন, অঙ্ক কষে বলা অবশ্য অসম্ভব, কারণ যোগেন মণ্ডলদের কণ্ঠস্বর লিপিবদ্ধ থাকলেও, উচ্চবর্ণের ভদ্রসমাজে ভিন্ন স্বরের অস্তিত্ব নিয়ে খুব বেশি লেখাজোখা নেই। যা লেখা আছে, তা হল, অখণ্ড বাংলার পক্ষে শেষ অবিচলিত কণ্ঠস্বর শরৎ বসু ক্রমশ সম্পূর্ণ একলা হয়ে যাওয়ার আখ্যান।
কিন্তু আবারও, অদ্ভুত ঘটনা এটা নয়। বছর পাঁচেকের মধ্যেই আবার উল্টে গেল কাহিনি। ১৯৪৭-এ যে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের আনন্দে উদ্বেল ছিল, তারাই উত্তাল হল ভাষার দাবিতে। ১৯৫২ সালে ঘটল ২১ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গেও ভাষা আন্দোলন হল ১৯৫৬ সালে, বঙ্গ-বিহার সংযুক্তির বিরুদ্ধে। রাজ্যগুলো যে কেন্দ্রের অধীনে স্রেফ প্রশাসনিক পঞ্চায়েত নয়, জাতিসত্তার প্রতীক, যেন তাঁরা এর আগে টেরই পাননি। তিন বছর পর শহিদের ঢল নামল খাদ্য আন্দোলনে। খাদ্য আন্দোলনের সঙ্গেও দেশভাগের একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। কিন্তু, ঠিক সেই সিপাহি বিদ্রোহের মতোই, এ সবের যে মূল কারণ, সেই দেশভাগের পাপ নিয়ে, কিঞ্চিৎ অশ্রু ঝরানো ছাড়া মূলস্রোতে আর কেউ কোনও রাজনৈতিক ভাবনা ভেবেছেন বলে জানা যায় না। এবং একই সঙ্গে এ-ও সত্য যে, এর পরেই, পূর্ববঙ্গে জাতিসত্তার আন্দোলন মূলধারার হয়ে গেল। এবং যত দিন না তৈরি হল স্বাধীন বাংলাদেশ, বাঙালি থামেনি, দাঁত কামড়ে পড়ে ছিল ওই দাবি নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে ঘটনাক্রম গড়িয়েছিল অন্য দিকে, ১৯৬৬-র খাদ্য আন্দোলন, ১৯৬৭-র নকশালবাড়ির গণবিস্ফোরণ, কিছু সফল, কিছু ব্যর্থ। কিন্তু কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭-এর পর আর ক্ষমতায় আসতে পারছে না, এটা নিশ্চিত না করে এপারেও বঙ্গসমাজ থামেনি।
কাজেই, দেখাই যাচ্ছে ভদ্রসমাজের এই কুম্ভকর্ণপনা এবং তার পর হঠাৎ জেগে ওঠা নতুন কিছু না। এই একবিংশ শতকেও, সেই একই নাট্যের পুনরভিনয় ছাড়া আর কিছু হচ্ছে না। বাঙালি জাতিসত্তার উপর এত বড় খাঁড়া এর আগে আসেনি। মাতৃভাষায় শিক্ষাকে কার্যত অকেজো করে দেওয়া হচ্ছে। এনআরসি-র নাম করে একটা আস্ত ভাষাগোষ্ঠীকে নাগরিক হওয়ার পরীক্ষায় বসতে হবে, এ মোটামুটি ধরেই নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে কার্যত খোঁড়া করে রাজ্যগুলোকে মিউনিসিপ্যালিটির স্তরে নামিয়ে আনার তোড়জোড় চলছে। গণমাধ্যম থেকে মাল্টিপ্লেক্স, সর্বত্র এক-ভাষা এক-ধর্মের জয়গান। যাঁরা কর্মকর্তাদের ‘কারিয়াকর্তা’ বলেন, সরাসরি রামমন্দির উদ্বোধনে প্রদীপ জ্বালেন, হনুমান সেজে অযোধ্যা যান, তাঁরা সরাসরি পুরো প্রক্রিয়াটার পক্ষে। সে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যাঁরা বিপক্ষে, তাঁদের গলাও শোনা যাচ্ছে না। তাঁরা চুটিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ঠিকই পালন করবেন, কিন্তু হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান যে একটা অখণ্ড প্রক্রিয়া, ভাষা যে রাজনীতি বা প্রতিরোধের জায়গা, তা মনে করেন বলে বোঝা যাচ্ছে না।
১৮৫৭ সালে ইংরেজ-শাসনকে যে রকম দৈব ভাবা হত, ১৯৪৭-এ দেশভাগকে যে রকম একটা প্রাকৃতিক অনিবার্য বিষয় হিসাবে ভাবা হয়েছিল, এই ২০২৪-এও হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানকে সে রকম একটা ‘ও তো হবেই’ ভেবে নেওয়া হয়েছে। তাই ভদ্রলোকেরা বসে রামমন্দিরের সম্প্রচার দেখছেন, বলিউডকে প্রাণের আরাম, হনুমান সেজে হুঙ্কার দেওয়াকে ‘চয়েস’ ভাবছেন। প্রতিরোধ ছাড়া আগ্রাসন আটকানো যায় না, সবাই জানেন। কিন্তু ন্যূনতম নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধেও এখন প্রবল অনীহা। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো? ধুর, সে আবার কী। মাতৃভাষায় শিক্ষা? ছাড়ুন তো। প্রেক্ষাগৃহে বাংলা ছবি বাধ্যতামূলক করা? না না, ও রকম জোর করা যায় নাকি। তা হলে করবেনটা কী? দাওয়াই হিসাবে কেউ বলছেন বাউল গান গাইতে হবে, কেউ বলছেন কুটিরশিল্পে জোর দিতে হবে, লোকসংস্কৃতিকে তুলে আনতে হবে, অর্থাৎ রাজনীতি বাদে আর সব কিছু। অথচ, এই বাংলাতেই শ’খানেক বছর আগে মুকুন্দদাস যখন বঙ্গনারীকে কাচের চুড়ি ভেঙে ফেলতে বলে গান গাইতেন, আসর জুড়ে চুড়ি ভাঙার ঝনঝন আওয়াজ পাওয়া যেত। এখনকার ভদ্রসমাজ উপস্থিত থাকলে নির্ঘাত বলত, এ ভাবে বলা ঠিক না, বেছে নেওয়ার স্বাধীনতার উপর হাত দেওয়া হচ্ছে, কিংবা চুড়ির কারবারিদের কী হবে ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়ত। এবং সবশেষে ঢাল-তরোয়ালহীন স্থানীয় নির্মাতাদের পরিবেশবান্ধব কাঠের চুড়ি তৈরি করতে বলে প্রসঙ্গ শেষ করতেন।
ইতিহাস তো ঠিক ছক মিলিয়ে দেওয়ার অঙ্ক না। কিন্তু আগের দু’বারের ছক এখনও পর্যন্ত মিলে যাচ্ছে। আপাতত ভদ্রসমাজ কুম্ভকর্ণ-রূপে বিরাজিত। বিবাদী স্বর এখনও আছে, কিন্তু মূলধারায় কল্কে পাচ্ছে না। ছক যদি মিলে যায়, তা হলে অবিলম্বে একটা সময় নির্ঘাত আসবে, যখন হঠাৎ করে কুম্ভকর্ণ জেগে উঠবে। ঝামেলা একদম গলা টিপে ধরলে, তখনই ভিন্ন স্বর মূলধারায় পরিণত হবে। আগের দু’বারের মতো এ বারও, তাতে ক্ষয়ক্ষতি বাড়া ছাড়া আর কিছু লাভ হবে না। তার চেয়েও বড় কথা, এটাকে ঠিক ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়াও বোধ হয় বলা যায় না।