রাজ্যে ছ’টি বিধানসভা উপনির্বাচনের বাকি ঠিক সাত দিন। একে তো পর পর উৎসবের মরসুম চলছে। তার উপর আর জি কর-কাণ্ডের মতো ঘৃণ্যতম ঘটনা এবং তা নিয়ে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক আন্দোলন মিলেমিশে জনমন আলোড়িত। উপনির্বাচন এখন পর্যন্ত সে ভাবে নাড়া ফেলেনি।
তবু নির্বাচনের রাজনৈতিক গুরুত্ব আছেই। ফল নিয়ে খুব একটা আগ্রহ, উত্তেজনা সব সময় না থাকলেও দলগুলির খানিক নড়াচড়া লক্ষ করা যায়। তাই এক সঙ্গে ছ’টি কেন্দ্রে ভোটের সময় তা একেবারে প্রতিক্রিয়াবিহীন হওয়ার কথা নয়, তবু সমগ্র নির্বাচনী আবহটি এখনও অনেকটাই নিস্তরঙ্গ।
এরই ফাঁকে আবার রাজ্যে ঝটিতি সফর সেরে গেলেন অমিত শাহ। সাধারণত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ এখানে পা রাখলে তার আগে-পরে বহুবিধ রাজনৈতিক চর্চা ও বিতর্ক হয়। অবশ্য ’১৯-এর লোকসভা বাদ দিলে বাংলায় তাঁর হাত ধরে বলার মতো কোনও নির্বাচনী সাফল্য বিজেপি পায়নি। তা সত্ত্বেও এখানে এসে বিজেপির নেতা-কর্মীদের সামনে গরমাগরম বক্তৃতা দিয়ে তিনি অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে বিশেষ কার্পণ্য করেন না।
এ বার যেন তাতেও ভাটা। বর্তমান পরিস্থিতিতে শাহের সফর থেকে রাজ্য বিজেপির কী প্রাপ্তি হল, সেটা দলের নেতারা সত্যিই কিছু বুঝলেন কি? তাঁদের অন্তরাত্মার কাছে এই প্রশ্ন রাখা থাক। তারই সঙ্গে প্রশ্ন থাক, বাংলার শাসক তৃণমূল, বিশেষত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কি এর থেকে কিছু ‘বার্তা’ আহরণ করলেন? করলে সেটাই বা কী?
ভাবের ঘরে চুরি অনেক হয়েছে। এ বার বিজেপিকে এটা ভাবতে হবে বইকি! কারণ শাহের সফরের পরে তাদের হাতে পেনসিলটাও থাকছে কি না, সেই সংশয় অনেকের। বস্তুত দেখেশুনে মনে হয়, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলটি আপাতততাদের দিল্লির কর্তাদের বিচারে সম্ভবত খরচের খাতায় রয়েছে।
তা ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কঠোর রাজনৈতিক আক্রমণ করার ক্ষেত্রেও বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব হয়তো ভেবেচিন্তে একটু ‘সতর্ক’ পদক্ষেপ করতে চান।
শুধু নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এ সব বলা হচ্ছে ভাবলে ভুল হবে। যদিও গণতন্ত্রে ভোটের ফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সংখ্যা সেখানে ক্ষমতার নির্ধারক। তবে আমরা জানি, নানা দলের খেলোয়াড়দের কারিকুরি, বাহুবল, রাষ্ট্রবল ইত্যাদির দ্বারা ভোটে হার-জিত যে ভাবে ‘নিয়ন্ত্রিত’ হয়, তাতে সাধারণ মানুষের মতের সঠিক প্রতিফলন কোথায় কতটা ঘটে, বলা কঠিন। তাই বার বার দেখা যায়, জনমতের স্বাভাবিক প্রবণতার সঙ্গে গণনার হিসাব মিলছে না! কিন্তু এখন বাংলায় রাজনীতির যে চেহারা সামনে আছে, তার ভিত্তিতে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি সম্পর্কে কিছু ধারণা করা যেতে পারে।তার থেকে বঙ্গ-বিজেপির অবস্থান বোঝাও কিছুটা সহজ হবে।
সাম্প্রতিক কালে আর জি কর-কাণ্ড নিঃসন্দেহে রাজনীতির সবচেয়ে বড় উপকরণ। বিরোধীদের জন্য তো বটেই। এ কথা সর্বাংশে সত্যি যে, চিকিৎসকদের ওই আন্দোলনকে ঘিরে বৃহত্তর নাগরিক সমাজ যে ভাবে একত্র হতে পেরেছে, স্মরণকালের মধ্যে তার নজির নেই। আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কতটা ‘অরাজনৈতিক’ থাকতে পেরেছে, নতুন করে সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে এর প্রভাব এতটাই বেশি যে, রাজ্য-রাজনীতি কিছুতেই এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। বরং এই রকম ক্ষেত্রে এখান থেকে চলার রসদ নিয়ে দলগুলি যে যার মতো করে সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। এটাই তাদের ধর্ম।
আন্দোলনে বাম, অতিবাম, এসইউসি-র মতো বিরোধী দল ও মতাবলম্বীদের ছায়াপাত অস্বীকার করার নয়। কিন্তু নির্মম পরিহাসের বিষয়, এই আন্দোলনের পরিসরে পা রাখতে গিয়ে বিজেপিকে এক প্রকার তাড়া খেয়ে ফিরতে হয়েছে। শাসক তৃণমূলের বিরোধী হিসাবে বামমনস্কদের একাংশ যেখানে ‘প্রবেশাধিকার’ পেয়েছেন, সেখানে প্রধান বিরোধী দলের এমন দশা অর্থবহ।
আরও আশ্চর্য, অমিত শাহ কলকাতায় এসে আর জি কর-কাণ্ডকে কার্যত কোনও গুরুত্বই দিলেন না। ধর্ষণে মৃত তরুণী চিকিৎসকের মা-বাবার সঙ্গে শাহের দেখা করার বন্দোবস্ত করতে রাজ্য বিজেপির প্রভূত প্রয়াস ছিল। রাজ্য দলের এক নেত্রী নিজেই এই ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন। অবশেষে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে নিরাশ করেছেন। মৃতা ছাত্রীর মা-বাবার সরাসরি আবেদনেও শাহের ইতিবাচক সাড়া মেলেনি।
রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে শাহের মতো নেতার এ-হেন ভূমিকার ব্যাখ্যা দিতে সেই থেকে তাঁর দলীয় পারিষদেরা সবাই তৎপর। কিন্তু যে যা-ই বলুক, আদতে জনসমক্ষে রাজ্য বিজেপির অস্বস্তি বাড়ল। এ নিয়ে দ্বিমত নেই। বিশেষ করে ছ’টি উপনির্বাচন যখন দোরগোড়ায়। অবশ্য ’২১-এর বিধানসভা এবং ’২৪-এর লোকসভা ভোটের মতো এ বারেও শাহ আগাম বলে গিয়েছেন, ’২৬-এ বাংলা দখল তাঁরাই করবেন। তবে আঙুর ফল টক বা মিষ্টি, সে তো খাওয়ার পরের কথা!
স্বাভাবিক কারণেই এখানকার বিজেপি ভেবে রেখেছিল অন্য রকম। ডাক্তারদের প্রতিবাদ মঞ্চ বা সামাজিক আন্দোলন কোথাও পাত্তা না পেয়ে তাদের আশা ছিল অমিত শাহ ‘মুশকিল আসান’ হবেন। বাস্তবে হল উল্টো। গোটা সফরে আর জি কর নিয়ে শাহ একটি পূর্ণ বাক্যও বলেননি। সন্দেশখালি এবং আর জি করকে এক বন্ধনীতে রেখে দু’চারটি শব্দ ব্যবহার করেছেন মাত্র।
গত কয়েক দিনে রাজ্যের একাধিক প্রবীণ, অভিজ্ঞ বিজেপি নেতার সঙ্গে কথা বলেছি। অধিকাংশেরই মূল বক্তব্য, আর জি করের ঘটনা ও তার বিভিন্ন অভিঘাত নিয়ে শাহ যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলকে কড়া ভাবে রাজনৈতিক আক্রমণ করতেন, তা হলেও ভোটের বাজারে বিজেপির বঙ্গ ব্রিগেড অন্তত সেটা মেঠো রাজনীতিতে ‘কাজে’ লাগানোর মওকা পেত।
দ্বিতীয়ত, তাঁরা এটাও মনে করেন, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে অমিত শাহ মৃতা চিকিৎসকের মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে তাঁদের ‘আশ্বস্ত’ করলে তার ভিত্তিতেও আন্দোলনের চৌহদ্দিতে থাকার একটা ‘উপায়’ খোঁজা যেত। কিন্তু এখন যাদাঁড়াচ্ছে, তাতে দলের হাতে পেনসিলটুকুও থাকছে কি না, সন্দেহ!
এই অবস্থায় ‘বজ্রাহত’ বিজেপি শিবিরে নানা গুঞ্জন চলছে। অনেকেই বলছেন, রাজ্য-রাজনীতিতে আর জি কর-কাণ্ডের গুরুত্ব না-বোঝার মতো ব্যক্তি তো অমিত শাহ নন। তাই তিনি যখন বিষয়টিকে তাঁর সফরের ‘শিরোনাম’-এ আনতে চাননি, তখন সেটা সচেতন সিদ্ধান্ত বলে ধরে নেওয়া যায়।
পর্যবেক্ষকদের অনেকের ধারণা, এত বড় আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের কোনও ভাবেই যুক্ত করতে না পারা রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের ব্যর্থতা। কারণ এটা শুধু ছাত্র-আন্দোলনেই থেমে থাকেনি। চিকিৎসক মহল ও নাগরিকদের অংশগ্রহণে বৃহত্তর আকার পেয়েছে। যেখানে বেশির ভাগ বাম-বৃত্তের এবং কংগ্রেসের কতিপয় ঘনিষ্ঠ লোকজনকে দেখা গিয়েছে। বাদ বিজেপি। এই ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া যে ‘অভিপ্রেত’ নয়, অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে শাহ সেটাই তাঁর রাজ্য দলের নেতাদের টের পাইয়ে দিয়ে গেলেন। এটা কার্যত এক প্রকার ভর্ৎসনা। দলের হাল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়াও বটে।
যদিও এর ফলে বিরোধী বলয়ে বামেদের ‘কপাল’ রাতারাতি খুলে যাবে, এখনই এত দূর ভেবে নেওয়ার সময় আসেনি। তবে লক্ষণীয় হল, ইদানীং সিপিএম, অতিবাম ইত্যাদি ক্রমশ তৃণমূলের আক্রমণের বড় নিশানা হয়ে উঠেছে। বিরোধী শিবিরে এই ‘নব-উত্থান’-এর পিছনে ভিতরের ও বাইরের মদত, অর্থবল ইত্যাদি নানা অভিযোগও উঠছে। সত্যাসত্য উচ্চমহল বুঝবে।
আপাতত এটুকুই বলব, ‘শত্রুর শত্রু’ মানে বন্ধু। যথা বিজেপি, তথা তৃণমূল। প্রয়োজন পারস্পরিক।