আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা। সেই অবস্থায় সাদা কার্পেটে হাঁটলেন কিম কার্দাশিয়ান। ছবি: এএফপি
আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা। সেই অবস্থায় সাদা কার্পেটে হাঁটলেন কিম কার্দাশিয়ান। মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। গোটা বিশ্ব তা দেখে বেজায় হইচই করল। এমন সাজ আগে নাকি দেখা যায়নি! কেউ মিম বানালেন। কেউ তারকা সুন্দরীকে ‘ব্যাট উওম্যান’ বলে ডাকলেন।
কিন্তু মান করলেন একদল আফগান মহিলা। তাঁরা বললেন, এমন অপমান মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু অপমানটা কী ভাবে করলেন কিম? তিনি তো কারও সাজ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি!
কিম বৃত্তান্তে আসার আগে রানাঘাট আর তিব্বত নিয়ে খানিক আলোচনা হোক। অথবা পোশাক এবং রাজনীতির যোগাযোগ নিয়েই না হয় হোক কিছু কথা।
এক বান্ধবী লন্ডনে বাম রাজনীতি করেন। সবে লেবার পার্টির একটি সভায় বক্তৃতা করেছেন। ভারতে এসে আনন্দ করে সেই সমাবেশের ছবি দেখালেন। সব ভাল। কিন্তু কলকাতাবাসী বন্ধুর চোখ আটকে গেল সমাবেশে উপস্থিত এক নেত্রীর হিজাবে। বাম যদি, তবে হিজাব কেন? বাঙালি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক বান্ধবী বললেন, বামপন্থী বলেই তো হিজাব পরেছে। অবাম হলে পরত নাকি? বোঝো ঠেলা!
তর্ক এগলো বহু দূর। শাঁখা-সিঁদুর-শাড়ি নিয়ে তোলপাড়ের পর বোঝা গেল, এ দুনিয়ার এক গোলার্ধে বসে আর এক গোলার্ধের রাজনীতি বিষয়ে মন্তব্য করা সহজ নয়। পোশাক নিয়েও নয়। যে দেশে শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান ছাড়া সকলেই প্রান্তিক, সেখানকার বামেদের চরিত্র আলাদা। নিজ সংস্কৃতির প্রতীক হিসাবেই হিজাব মাথায় তুলেছিলেন সেখানকার বাম নেত্রী। ভারত, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে বসে হিজাবে মাথা ঢাকা আর ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক সভায় সে কাজ করার মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
পোশাকের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক এমনই। দূরত্ব যেমন, ঘনিষ্ঠতাও ততটাই। কিন্তু সে সবের মাঝখানে কী ভাবে ঢুকে পড়লেন আমেরিকার শৌখিনী কিম কার্দাশিয়ান!
গিয়েছিলেন বাৎসরিক ‘মেট গালা’-এ। সারা দেশের তারকারা নানা ধরনের নজরকাড়া পোশাক পরে হাজির সেখানে। কার পোশাক কত অদ্ভূত, তা নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে সরগরম থাকে গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম। সেখানে কিম পৌঁছলেন আপাদমস্তক কালো পোশাকে মুড়ে। নিজে বলে না দিলে কেউ জানতেও পারতেন না যে তিনিই কিম। তারকারা এমন এক উজ্জ্বল সন্ধ্যায় সাধারণত নিজেদের সুন্দর মুখ দেখাতেই ব্যস্ত থাকেন। আর সেখানে কিম মুখটাই ঢেকে রাখলেন! তাই সব ক্যামেরা তাঁকেই তাক করল। চোখা হিল জুতো, টানটান চেহারার সঙ্গে লেপ্টে থাকা কালো জামা এবং পিঠ থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়া চাদরের মতো কালো কাপড়ে এক ‘সুপার উওম্যান’।
কিমের পোশাক বোরখা-পরা মেয়েদের অসম্মান করে কি করে না, সে প্রসঙ্গ আলাদা। ছবি: এএফপি
এ বছর ‘মেট গালা’-র থিম ছিল আধুনিক আমেরিকার সাজসজ্জা। যিনি যে ভাবে আমেরিকার সংস্কৃতিকে দেখেন, সে ভাবেই সেজে এসেছিলেন। কিমও তাই। ইনস্টাগ্রামে সে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘টি-শার্টের চেয়ে বেশি আমেরিকান আর কী বা হতে পারে!’
সেই পোশাক দেখে কেউ বললেন অসাধারণ। কেউ বা সবচেয়ে সৃজনশীল মনে করলেন পোশাকটিকে। কিন্তু বাধ সাধল কাবুল-বিতর্ক।
নতুন তালিবান আমলে আবার মহিলাদের সাজপোশাক নিয়ে নানা বিধিনিষেধ উড়ে আসতে শুরু করেছে। তালিবান প্রথমে যা-ই আশ্বাস দিয়ে থাকুক, ধীরে ধীরে রূপ বদলাচ্ছে তারা। প্রথমে ছিল মেয়েদের শুধু হিজাবে মাথা ঢাকার কথা। বোরখার প্রয়োজন নেই। তার পর এল নিকাব। আর এক দিন আবেয়ার দাবি।
অর্থাৎ, আফগানিস্তানের মেয়েদের আশঙ্কাই সত্যি হল। রঙিন পোশাকে সাজের দিন শেষ। আবার কালো কাপড়ের আঁধারে বাঁধা জীবন। তা নিয়ে তোলপাড়ও চলছে। নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা আফগান পরিবারের মেয়েরা নিজেদের রঙিন পোশাকের সংস্কৃতি তুলে ধরছেন নেটমাধ্যমে। লাল, নীল, সবুজের ঝলমলে পোশাকে ভরছে তাঁদের ইনস্টাগ্রামের পাতা। তালিবানের কাছে তাঁদের বার্তা— ‘ডোন্ট টাচ মাই ক্লোদস্’। আমার পোশাকে হাত দিও না। তার মধ্যেই কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে সাদা কার্পেটে হেঁটেছেন কিম। তাই মানে লেগেছে বিপ্লবী সেই মুসলিম নারীদের।
কিন্তু কিমের সাজকে কি সত্যিই কাউকে অসম্মান বলা চলে? আদত প্রশ্ন সেটাই।
স্বভাবতই এ নিয়ে কিম মুখ খোলেননি। কিন্তু আপাদমস্তক ঢাকা সেই পোশাকে হেঁটে যাওয়ার সময়ে বোরখায় ঢাকা কোনও মহিলার কথা কি মনে হয়েছিল কিমের? যদি না হয়ে থাকে, তবে তা চিন্তার বিষয়।
কিমের পোশাক বোরখা-পরা মেয়েদের অসম্মান করে কি করে না, সে প্রসঙ্গ আলাদা। কিম আদৌ তাঁদের বিপ্লবের কথা জানেন কি না, সে প্রশ্নও অপ্রাসঙ্গিক নয়। তবে সাধারণ চোখে কোনও এমন কালো সাজ যে প্রথমে কালো রঙের বোরখার কথাই মনে করায় অধিকাংশ মানুষকে, সে কথা কি কিম বা তাঁর টিম— কারও মনে আসেনি? না এসে থাকলে বিষয়টি উদ্বেগের। কারণ, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে এখন কাবুল। তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে নতুন করে তৈরি বোরখা-বিতর্ক। যে আধুনিক আমেরিকাকে কিম নিজের পোশাকে তুলে ধরলেন, সে দেশের সংস্কৃতি নিয়েই কিছু ভাবনার অবকাশ তৈরি হয় এ ক্ষেত্রে।
আধুনিক আমেরিকার কাছে অন্য গোলার্ধের মানুষের পোশাক, বিপ্লব, রাজনৈতিক বিবাদ, দৈনন্দিন যাপনযুদ্ধ সবই কি তবে অপ্রাসঙ্গিক? টি-শার্টের তুলনায় গুরুত্বহীন? তাই কি তাঁর পোশাক নিয়ে মুসলিম মহিলাদের অভিমানের কথা ঘুরপাক খেলেও কোনও উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না শৌখিনী?
আফগানিস্তানের মেয়েদের আশঙ্কাই সত্যি হল। রঙিন পোশাকে সাজের দিন শেষ। ছবি: এএফপি
তবে এক কথায় বলতে গেলে, দোষ কারও নয় গো মা। দোষের মধ্যে দোষ তো ধরা যায় একটিই। কিমের পোশাক যে বোরখার কথা মনে করাবে অনেককে, কিম নিজে তা ভাবেননি। তবে তিনি অন্যের কথা ভেবে বিশেষ কোনও কাজ করেছেন বলে এখনও পর্যন্ত কোনও ‘অভিযোগ’ নেই। যেমন আফগানিস্তানের কথা ভাবার দায় আপাতত বিশেষ প্রকাশ করছে না যে দেশ, সেই আমেরিকার সংস্কৃতি নিজের পোশাকে তুলে ধরেছেন তিনি। ফলে কিমের সাজ নিয়ে যদি আলোচনা করারই হয়, তবে একটিই কথা বলা চলে বেশি ভাবনাচিন্তা করার অভ্যাস না থাকলেও আধুনিক আমেরিকাকে দিব্যি চিনেছেন এই তারকা সুন্দরী। এবং বাকি দুনিয়ার কাছে সে ভাবনা তুলে ধরতেও পিছপা হননি। এর বেশি ওই কালো পোশাক নিয়ে যা বলতে চাইবেন, তা-ই বৃথা!
তবে হাজার তর্কের পরেও যেমন লন্ডনের রাজনীতিতে হিজাবের গুরুত্ব বোঝা সম্ভব হয় এ গোলার্ধের বামপন্থীর, তেমন যদি কিমেরাও বোঝার দায় নিতেন, তবে জন লেননের স্বপ্ন সত্যি হত। মানুষের মধ্যে খানিক ভেদাভেদ ঘুচত। নিজের সংস্কৃতির জন্য লড়াইয়েও অন্য অঞ্চলের মানুষকে পাশে পেতেন। কিন্তু সব স্বপ্ন যে সত্যি হওয়ার নয়। অতঃকিম কিম থাকলেন সেই তিমিরেই। তিমিরে রইল যৌথ বিপ্লবের আশা। আর লেননপন্থীর হাতে রইল শুধু পেন্সিল।