অস্ত্রে ভারত কতটা স্বনির্ভর? ছবি: সংগৃহীত।
ভারতের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ব্যবসা নিয়ে বেশির ভাগ মানুষের মোটামুটি ধারণাটা হল— দশকের পর দশক ধরে সরকার অস্ত্র উৎপাদন ও তার মানোন্নয়নে স্বনির্ভর হতে চাইছে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি মালিকানাধীন সংস্থার দ্বারা), কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম আমদানিকারক দেশ হিসাবে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে। এই স্ববিরোধী অবস্থার কারণ যে চেষ্টার অভাব, এমন নয়। সম্ভবত এর পিছনে যা কাজ করছে তা হল, যে সব উপায়ে চেষ্টাগুলি করা হচ্ছে, সেগুলিই যথাযথ নয়।
খুব কম লোকই জানেন, ভারতে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা এবং সমর-সরঞ্জামের মানোন্নয়নের জন্য যে বাজেট রাখা হয়, তা বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে (প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে মহাকাশ এবং পারমাণবিক শক্তিকে এর মধ্যে ধরতে হবে)। যদিও আমেরিকা বা চিনের তুলনায় এই অর্থের পরিমাণ অনেকটা কম। কিন্তু প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা ও সামরিক সরঞ্জামের উন্নতিতে ব্রিটেন, জার্মানি এবং ফ্রান্সের মতো দেশ যা ব্যয় করে, সে তুলনায় ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট অনেক বেশি। কিন্তু এই দেশগুলি যে ভাবে সম্মুখসমরে ব্যবহারের যোগ্য রণ-সরঞ্জামের উৎপাদনকে দেখে, ভারত সে ভাবে দেখে না। সত্যি বলতে, ভারতে সরকারি মালিকানাধীন বিমান ও বৈদ্যুতিন যন্ত্রের উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিতে গবেষণা ও উৎপাদনের মানোন্নয়নের পিছনে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তা আন্তর্জাতিক স্তরে এই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত গড় অর্থের এক সিংহভাগ দখল করে রয়েছে।
স্ববিরোধ কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। এক দিকে ব্রহ্মস বা তেজস-এর মতো অস্ত্রের উদাহরণ প্রমাণ করে যে, ভারতের নিজস্ব ভূমিতে তৈরি অস্ত্রের গুণগত মান ক্রমেই উন্নত হচ্ছে। অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধজাহাজ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। অন্য দিকে আবার এক শ্রেণির আধিকারিকরা দেশজ প্রতিরক্ষা সমগ্রী উৎপাদন কেন্দ্রগুলি বিক্রি করা দেওয়ার কথা ভাবছেন, বা তাদের অধিকাংশ শেয়ার ব্যক্তিগত উদ্যোগপতিদের বিক্রি করার ব্যাপারে ভাবছেন, এবং অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানির উপর নির্ভরশীলতাকে কমাতে চাইছেন। একই সময় দেখা যাচ্ছে, প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনের হিসাব আমেরিকান ডলারের নিরিখে কিন্তু স্থিতাবস্থাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই স্থবিরতা প্রতিরক্ষা-পণ্যের রফতানির ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়।
তা হলে বিষয়টিকে কী ভাবে দেখা যেতে পারে? পরিস্থিতি ইতিবাচক, না কি তার উল্টো? উত্তরে বোধ হয় দু’দিকেই সায় দিতে হবে। এই ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এক সাম্প্রতিক আলোচনায় দেখা গিয়েছে, এখানে যেন এক দিনবদলের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সরকারের তরফে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত উৎপাদন ব্যক্তিগত উদ্যোগের হাতে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই তুলে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। গত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে, প্রতিরক্ষার গবেষণা ও মানোন্নয়নের জন্য সরকার-নির্ধারিত অর্থের এক চতুর্থাংশ ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কারখানা এবং অ-সরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হবে। এই বিষয়টি এখনও পর্যন্ত ভাবনার স্তরেই থেকে গিয়েছে। কিন্তু এ-ও সত্য যে, সি-২৯৫ ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্র্যাফট টাটা-এয়ারবাসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগেই তৈরি হচ্ছে। হাউইৎজ়ার তৈরি করছে লারসেন অ্যান্ড টুর্বো এবং ভারত ফোর্জ-এর মতো সংস্থা। এ সব বৃহৎ উদ্যোগের পাশাপাশি, এই মুহূর্তে হাজার দশেক ছোট এবং মাঝারি আকারের উদ্যোগও এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে কাজ করতে শুরু করেছে।
গবেষণা ও মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে ড্রোন, রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের উৎপাদনকে ধরতে হবে। এর পাশাপাশি, বেশ কিছু স্টার্ট-আপ সংস্থা ইমেজ রেকগনিশন, পরিধেয় প্রযুক্তি এবং ওই ধরনের সামগ্রী তৈরির কাজ করছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের ধরনধারণ যে বেশ খানিকটা বদলে গিয়েছে, তা এই সব উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়।
তবে তার মানে এই নয় যে, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র একেবারে সঙ্কটমুক্ত হয়ে পড়েছে। স্বদেশি গবেষণা ও মানোন্নয়নের প্রকল্পে তৈরি সরঞ্জাম গ্রহণ করতে সামরিক বাহিনী দীর্ঘ সময় নেয়। সরকারি টাকায় যাঁরা উৎপাদন করছেন, তাঁদের পক্ষে সব থেকে সস্তা দরে সরবরাহকারীর কাছ থেকে পণ্য কেনার রেওয়াজ তেমন ফলদায়ী হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। আইডেক্স (ইনোভেশন ফর ডিফেন্স এক্সেলেন্স) ফান্ডিং বিশেষ করে ড্রোন তৈরির ক্ষেত্রে কাজে এলেও, এখনও পর্যন্ত সে ব্যাপারে বরাতের সংখ্যা নগণ্য। তথ্য এই যে, ড্রোন নির্মাণকারী সংস্থাগুলিতে উৎপাদন-নির্ভর ইনসেন্টিভ দেওয়ার প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এর ফলে হয়তো ড্রোন ও ড্রোন-সংক্রান্ত সরঞ্জাম নির্মাতা সংস্থাগুলি ভিন্ন ভাবে চিন্তাভাবনা করবে বলে আশা করা যায়।
রফতানির খাতেও খানিক ঔজ্জ্বল্য দেখা যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে যদি টেসলার কথা ধরা যায়, দেখা যাবে যে, এই সংস্থা স্থানীয় স্তরে নির্মিত দ্রুত চার্জ নিতে সক্ষম ব্যাটারি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম উৎপাদনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। পিনাকা রকেট ফায়ারিং সিস্টেমের আমদানির ব্যাপারে দু’টি বিদেশি সংস্থা বরাত দিয়েছে। চলতি বছরের গোড়ার দিকে হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল)-এর সঙ্গে তেজস যুদ্ধবিমান নিয়ে এক বাণিজ্যিক সমঝোতায় স্বাক্ষর করেছিল মালয়েশিয়া। যদিও শেষমেশ চিন এই বরাতটি হস্তগত করে নেয়।
বিচ্ছিন্ন বাণিজ্য চুক্তি আর দেশীয় গবেষণা ও মানোন্নয়নের ব্যাপারে এখনও বলার মতো কোনও জায়গা তৈরি হয়নি। বিশেষ করে বৃহদায়তন উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই সব চুক্তি বা উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত লক্ষণীয় কোনও ছায়া ফেলেনি। কিন্তু সরকার যে হেতু আর সরকারি টাকায় পরিচালিত গবেষণা থেকে উঠে আসা বৌদ্ধিক সম্পদের উপর মালিকানা দাবি করে না, বেসরকারি সংস্থা সে দিক থেকে দেখলে এই বৌদ্ধিক ক্রিয়াকাণ্ডকে উৎপাদনের স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থব্যয় করতে বা পুঁজি জোগাতে রাজি আছে। ভাগ্য সহায় থাকলে, প্রতিরক্ষা বিষয়ক গবেষণা এবং সেই ক্ষেত্রের জন্য সামগ্রী উৎপাদন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ভারতকে নিয়ে যেতেই পারে।