বিধানসভা নির্বাচনের আগে বড়, মেজ, ছোট, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাজনীতিকদের দলবদলের ঢেউয়ে উত্তাল হয়েছে বাংলার রাজনীতি। ২০০৮-এর এক গবেষণাপত্র রাজনীতির কারবারিদের আনুগত্য বদলকে সাধারণ ভাবে রাজনৈতিক উচ্চাশার স্বাভাবিক পরিণাম, এবং রাজনৈতিক দলের নিজস্ব শৃঙ্খলা এবং অনুশাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছে। আমাদের সমাজের দলবদলুদের কর্মকাণ্ডকেও এ ধরণের প্রিজ়মের ভেতর দিয়ে দেখার একটা প্রয়াস তাই করা যায়। পার্টির নিজস্ব অনুশাসন কারও উচ্চাশার পরিপন্থী হতে পারে, কারও নিজস্ব রাজনৈতিক অস্তিত্বকে সঙ্কটে ফেলতে পারে, কেউ আবার দল বদলে নিজের নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা বাড়াতে চাইতে পারেন, অথবা প্রতিপক্ষকে সম্ভাব্য জয়ী
ধরে নিয়ে চাইতে পারেন তার ব্যান্ডওয়াগনে সওয়ার হতে।
দলবদল হয় অন্যত্রও। অবশ্য সব দেশের কালচারে তা সমান ভাবে সম্পৃক্ত নয়। আমেরিকাতে গত ৭০ বছরে দল পালটেছেন মাত্র ২৭ কংগ্রেস-সদস্য, ওদিকে ইটালিতে ১৯৯৬-২০০১’এর আইনসভায় দল বদলেছেন প্রায় এক-চতুর্থাংশ সদস্য। বলা হয়, নির্বাচনের প্রাক্কালে নাকি জনপ্রতিনিধিরা দলবদলে বিরত থাকেন। অবশ্যই ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ ভিন্ন সুরে সাক্ষ্য দেবে। আসলে আমাদের দলবদলের কালচারকে দেখতে হবে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেই। পার্থ চট্টোপাধ্যায় যাকে বলেন ‘রাজনৈতিক সমাজ’ (পলিটিক্যাল সোসাইটি), আর দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য যার নাম দিয়েছেন ‘দলীয় সমাজ’ (পার্টি সোসাইটি)। রাজনীতি, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল, মজ্জায় মজ্জায় জড়িয়ে ধরে রয়েছে এ রাজ্যের, বিশেষত গ্রামীণ বাংলার, বেঁচে থাকাকে। বিরাটসংখ্যক জনতার কাছে রাজনীতি প্রধানত কোনও পার্টির মতাদর্শের প্রতি বিশ্বাস নয়, নেতা এবং ক্ষমতাসীন পার্টির প্রতি আনুগত্যই মুখ্য। পশ্চিমবঙ্গের এই সামাজিক-রাজনৈতিক পরিকাঠামোর মধ্যেই ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ প্রবল ভাবে মাথা জাগিয়েছে গত এক-দেড় দশকে। কেবল মুসলিম ভোট নয়, মতুয়া ভোট, রাজবংশী ভোট, আদিবাসী ভোট, ইত্যাদি অনেক নতুন রাজনৈতিক বুলি বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বদলে যাওয়া এই ‘পরিচয়-ভিত্তিক দলীয় সমাজ’ (আইডেন্টিটি-বেস্ড পার্টি সোসাইটি)-এর প্রেক্ষিতেই তাই দেখতে হবে রাজ্যের দলবদলের রূপরেখাকেও।
মেক্সিকোর প্রেক্ষিতে একটা সাম্প্রতিক স্টাডি করেছেন লুইজ়িয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ইয়ান কেরেভেল। তিনি দেখেছেন, দলবদলুদের নির্বাচনে প্রার্থীপদ পাওয়া সহজ হয়ে যায় বটে, তবে তাদের জিতবার হার যায় কমে। আপাতদৃষ্টিতে প্রথমটা আমাদের সমাজেও সত্যি, তবে জয়-পরাজয়ের অ্যাকাডেমিক মূল্যায়ন এখনও এখানে হয়েছে বলে জানা নেই।
রাজনৈতিক দলবদলের নৈতিকতা নিয়ে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া আমাদের সমাজের। এক দল ছেড়ে অন্য দলে যাবার ফাঁকে অন্তর্বর্তিকালীন ‘কুলিং পিরিয়ড’ কিংবা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ধাঁচে ‘ট্রান্সফার ফি’ চালু করা যেতে পারে কি না, সে নিয়ে আলোচনা চলতে পারে নিশ্চয়ই। কিন্তু রাজনৈতিক দলবদল নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন, সেটাও এক বিস্ময়। মানুষ বেশি মাইনে বা সুযোগ-সুবিধা পেলে কিংবা কর্মস্থলে ‘কাজ করতে অসুবিধা’ হলে চাকরি বদল করেন। অনেক সময়ই চলে যান প্রতিযোগী সংস্থাতেও। এমন ‘রুমাল’ থেকে ‘বিড়াল’ তো হামেশাই ঘটছে। আমার কোনও বন্ধু বা স্নেহভাজন এমন চাকরি বদলালে তাকে শুভেচ্ছাই জানাই। খেলোয়াড়রাও হইহই করে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে মোহনবাগানে, এসি মিলান ছেড়ে বার্সিলোনাতে, এক আইপিএল টিম ছেড়ে অন্য দলে পারি দিচ্ছেন। এ সবকে আমরা স্বাভাবিক বলেই মনে করি। তা হলে রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে অন্য মানদণ্ড কেন? রাজনীতিকে একটা পেশা হিসেবে মেনে নিলেই তো সমস্যা চুকে যায়। না কি জনগণ রাজনীতিকে নীতির পরাকাষ্ঠা হিসেবে ভাবেন? দলগুলোরও অভ্যন্তরীণ গঠন আর দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়। বাজপেয়ীর বিজেপি আর মোদীর বিজেপি কি এক? নেহরুর কংগ্রেস আর সনিয়া গাঁধী কংগ্রেসে কোনও পার্থক্য নেই?
নির্বাচনের আগে দলবদলের রাজনীতি বা রাজনীতির দলবদলে মিডিয়ার অত্যুৎসাহও বিষয়টাকে একেবারে থ্রিলারের চেহারা দিয়েছে। যিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন, কেবলমাত্র দলীয় কর্মকর্তা, তার সংশ্লিষ্ট দলকে জবাবদিহির দায় থাকতে পারে, তবে জনগণের কাছে নিশ্চয়ই নেই। জলের ব্যবসা ছেড়ে কেউ জলপাইয়ের ব্যবসা শুরু করলে আমি-আপনি বলার কে? সংশ্লিষ্ট দলের সাথে তার অসমীকরণ নিয়েও সাধারণ জনতার মাথা ঘামানোর কোনও কারণ দেখি না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির দলবদল নিয়ে অবশ্য ভাববার অবকাশ থাকতে পারে, যদিও জনপ্রতিনিধি হিসেবে মেয়াদ ফুরোবার আগে দলত্যাগ করবেন না এমন ‘প্রতিশ্রুতি’ দিয়ে কেউ ভোটে দাঁড়ান বলে তো শুনিনি। তবে অনভিপ্রেত দলবদল রুখতে দলত্যাগ-বিরোধী আইন রয়েছে দেশে, যদিও নানা রাজ্যে ‘রিসর্ট রাজনীতি’র রমরমা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সেটাই হয়তো যথেষ্ট নয়।
তবু, নির্বাচিত দলবদলুদের আবার ভোটারদের সামনে দাঁড়াতে হয়, ব্যাখ্যা দিতে হয় রঙবদলের। নির্বাচকরা এদের ‘আয়া রাম গয়া রাম’ হিসেবেই দেখবেন, নাকি তাদের দলবদলের সিদ্ধান্তে
যুক্তি খুঁজে পেয়ে রঙবদলটাকে মান্যতা দেবেন, সে বিচার তো নির্বাচনে। আপাতত তথাকথিত নীতির বাঁধন থেকে রাজনীতিবিদদের মুক্তি দেওয়াটাই বোধহয় স্বস্তির।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা