বিনা পয়সার বিনোদন
Social Media

বাজার যাকে আটকাত, সমাজমাধ্যম তার জন্য দরজা খুলেছে

দেড় দশক আগে জন্মগ্রহণ করা সমাজমাধ্যম বাজারে প্রবেশের সমস্ত বাধাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।

Advertisement

পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:৩০
Share:

কী  অবস্থা হল বলো তো শিক্ষিত মধ্যবিত্তের? আমরা সকালে দাঁত মাজতে মাজতে মোবাইলে শুনছি ‘বাদাম বাদাম কাঁচা বাদাম’, বিকেলে অফিস থেকে ফিরে দেখছি বস্তাপচা সমস্ত মেগা সিরিয়াল, আর রাত্তিরবেলা শুতে যাওয়ার আগে গোগ্রাসে গিলছি রগরগে প্রেমের উপন্যাস অথবা সস্তা কোনও থ্রিলার!”

Advertisement

কয়েক সপ্তাহ আগে, এক মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে প্রায় এক যুগ পর আড্ডা মারার সুযোগ হয়েছিল কফি হাউসে। সেখানেই, ধূমায়িত ‘ইনফিউশান’-এ চুমুক দিতে দিতে কথাগুলি বলেছিলেন উনি।

তার পর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যোগ করেছিলেন, “অধঃপতন বোধ হয় একেই বলে…”

Advertisement

তখন, শীতের সেই পড়ন্ত বিকেলে, খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখিনি মাস্টারমশাইয়ের কথাগুলি। কিন্তু, অসচেতন ভাবেই হয়তো সেগুলি রেখে দিয়েছিলাম মনের মধ্যে। তাই, কয়েক সপ্তাহ পরে, সহসাই মনে পড়ে গেল, “কী অবস্থা হল…।”

সত্যিই তো, আজকাল নিম্নরুচিরই জয়জয়কার সর্বত্র; রুচিসম্মত রসোত্তীর্ণ শিল্প-সাহিত্যের-সঙ্গীতের কদর কোথায়? এক দশক আগেও যে গানকে গান বলে ধরাই হত না, সেই গানই আজ ‘ভাইরাল’ হচ্ছে; অপাঠ্য, নিম্ন মানের, সাহিত্যপদবাচ্য নয় এমন লেখা নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে; পাতে দেওয়ার অযোগ্য চলচ্চিত্র, ধারাবাহিক, ওয়েব-সিরিজ় ‘হিট’ হচ্ছে।

কী ভাবে এই অধোগতি হল আমাদের? কেন আমাদের রুচি পৌঁছে গেল এত নিম্ন স্তরে? ভাল এবং খারাপ, বাজারে যখন দুইই পাওয়া যায়, তখন ভালটাকে বর্জন আর খারাপটা গ্রহণ করতে কবে থেকে শিখলাম আমরা?

পণ্ডিতেরা কী বলবেন জানি না, তবে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে মনে হয়, আমাদের এই আলোর পথ ছেড়ে অন্ধকার পথের যাত্রী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ গত এক দশকে সমাজমাধ্যমের অবিরাম উত্থান। কেন সমাজমাধ্যমের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছি, সেটা একটু ব্যাখ্যা করে বলা প্রয়োজন। কিছু ক্ষণের জন্য ধরে নিন, কালযন্ত্রে চেপে এই শতকের গোড়ার দিকে আমরা ফিরে গিয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই, সমাজমাধ্যম ব্যাপারটা কী, সে সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা নেই। বস্তুত, মোবাইল-কম্পিউটার এই মহার্ঘ বস্তুগুলিও তখনও সর্বজনীন নয়। এই রকম পৃথিবীতে তিন জন মানুষ, ধরা যাক, তিন রকমের শিল্পচর্চা করেন। প্রথম জন লেখালিখি করেন, দ্বিতীয় জন ভালবাসেন
গান গাইতে, তৃতীয় জন অভিনয় করেন পাড়ার নাটকে। কিন্তু নিজ নিজ শিল্পচর্চায় তিন জনই বেশ অদক্ষ।

সে কারণেই বৃহত্তর পাঠক, শ্রোতা বা দর্শক সমাজে প্রচলিত যে সমস্ত আত্মপ্রকাশের মাধ্যম— অর্থাৎ লেখালিখির ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক পত্রিকা, গান-বাজনার ক্ষেত্রে ক্যাসেট বা সিডি, এবং অভিনয়ের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র বা ধারাবাহিক— সেগুলির মধ্যে দিয়ে কেউই আত্মপ্রকাশের সুযোগ পাননি। পত্রিকা, ক্যাসেট, চলচ্চিত্র এবং ধারাবাহিক, প্রত্যেকটি পণ্যই মানুষ মূল্য দিয়ে ক্রয় করেন এবং উপায় থাকলে গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে সাধারণত কেউই নিম্ন মানের জিনিস ক্রয় করতে চান না। অতএব পত্রিকায় যেমন নিম্ন মানের লেখা ছাপানো সম্পাদকের চলে না, তেমনই চলে না ক্যাসেট কোম্পানির খারাপ গায়কের ক্যাসেট প্রকাশ করা, এবং পরিচালকের খারাপ অভিনেতাকে চলচ্চিত্র বা ধারাবাহিকে সুযোগ দেওয়া।

সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো ব্যাপারটা দেখলে কী উপসংহার টানা যায়? যে উৎপাদনকারীর পণ্যের মান খারাপ (বা যথেষ্ট ভাল নয়), তিনি পণ্যটি নিয়ে প্রচলিত মাধ্যমে বাজারে প্রবেশ করতে পারলেন না বিক্রয়ের জন্য, বাজারে প্রবেশের বাধা থাকার ফলে। এখানে বলে রাখা ভাল, অপ্রচলিত মাধ্যমে যদিও বা তিনি বাজারে প্রবেশ করেন (নিজের পয়সা খরচ করে অমনোনীত উপন্যাস বই হিসাবে প্রকাশ নেওয়া যেতে পারে), তাঁর পণ্যটি তিনি কেবল বাজারের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশের কাছেই পৌঁছে দিতে পারবেন বাজারে প্রবেশের মাধ্যমটি অপ্রচলিত বলেই। সুতরাং খারাপ পণ্যটি ভোক্তাদের (পাঠক, শ্রোতা বা দর্শক)— সমস্ত না হলেও অন্তত বেশির ভাগের— সম্ভাব্য বিকল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারল না এবং তাঁদের রুচি ও পছন্দকে প্রভাবিত করতে পারল না।

ধরুন, সেই তিন ব্যক্তি আজও ঠিক একই মানের (অর্থাৎ খারাপ) শিল্পচর্চা করেন। কিন্তু তা বলে, আগেকার মতো এখন বৃহত্তর পাঠক, শ্রোতা, দর্শক সমাজে তাঁদের আত্মপ্রকাশ আটকে থাকবে কি? মোটেই না। কারণ, সমাজমাধ্যম।

দেড় দশক আগে জন্মগ্রহণ করা সমাজমাধ্যম বাজারে প্রবেশের সমস্ত বাধাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। আমি খারাপ উপন্যাস লিখলাম, প্রথম শ্রেণির পত্রিকায় ছাপল না? কুছ পরোয়া নেহি, উপন্যাসটি সমাজমাধ্যমে ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশ করে ঔপন্যাসিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করব। অডিশনে অতীব খারাপ অভিনয় করলাম বলে আমাকে সিনেমায় মুখ দেখাতে দিলেন না পরিচালক? বয়েই গেল! অখ্যাত কোনও পাইস হোটেলে “কষা মাংসটা বেশ কষা মাংসের মতোই খেতে হয়েছে” বলতে বলতে আমার মাংস-ভাত খাওয়াটা মোবাইল-ক্যামেরায় রেকর্ড করব আর তার পর সেই ভিডিয়ো ‘ভ্লগ’ হিসাবে সমাজমাধ্যমে আপলোড করে সমাজমাধ্যম কাঁপিয়ে দেব!

ফলত, আগে যে বাজার, বাজার-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিম্ন মানের পণ্য প্রত্যাখ্যান করত, এখন সেই বাজারই ছেয়ে যেতে শুরু করল অত্যন্ত নিম্ন মানের পণ্যে। শুধু তা-ই নয়, ক্রেতারা, যাঁরা সাধারণত নিম্ন মানের পণ্য ক্রয় করেন না, তাঁরাও আশ্চর্যজনক ভাবে সেই পণ্যের দিকে আস্তে আস্তে ঝুঁকতে লাগলেন।

কেন ক্রেতারা ঝুঁকতে লাগলেন নিম্ন মানের পণ্যের দিকে? প্রথমত, বাজারে ভালর তুলনায় অনেক বেশি খারাপ পণ্যের জোগান হওয়ায় অনেক সাধারণ ক্রেতা বিভ্রান্ত হয়ে প্রায় নিজের অজানতেই খারাপ পণ্যের খপ্পরে পড়ে গেলেন। দ্বিতীয়ত, খারাপ পণ্যের প্রকাশ মাধ্যম সমাজমাধ্যম হওয়াতে সেগুলির বিনিময় মূল্য হয়ে দাঁড়াল প্রায় শূন্য! বিনামূল্যের জিনিসের প্রতি মানুষের টান মজ্জাগত। তৃতীয়ত, খারাপ পণ্য, ভাল পণ্যের তুলনায়, সর্ব স্তরের ক্রেতার কাছে অনেক সহজলভ্য (এটিও খারাপ পণ্যের প্রকাশ মাধ্যম সমাজমাধ্যম হওয়ার ফল)। ভাল বই এখনও টাকা খরচ করে কিনতে হয়, কিন্তু সমাজমাধ্যমে প্রকাশিত উপন্যাস হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়।

সমাজমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে খারাপ পণ্য গ্রহণ করতে শুরু করার ফলে সেই পণ্য আমাদের সামগ্রিক রুচি এবং পছন্দের উপর প্রভাব বিস্তার করতে লাগল। প্রথমে ধীরে ধীরে, তার পর বেশ দ্রুত এবং ব্যাপক ভাবে। ঘুমোনোর সময়টুকু ছাড়া দিনের বাকি সময়টার বারো আনাই আমরা সমাজমাধ্যমে কাটাতে লাগলাম যে! ফলত, আমাদের রেফারেন্স পয়েন্ট বা মানবিন্দুটাই বদলে গেল। কোনটা ভাল, আর কোনটা খারাপ, সেই বোধটাও লুপ্ত হল।

খারাপ পণ্যের প্রতি চাহিদা যে হেতু সৃষ্টি হল, বাজারে অতএব খারাপ পণ্যের জোগানও বৃদ্ধি পেল স্বাভাবিক নিয়মেই। কেবল আর সমাজমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে নয়, আমরা দেখলাম, প্রচলিত কিছু মাধ্যমের মধ্যে দিয়েও বাজারে খারাপ পণ্য প্রবেশ করতে শুরু করল (টিভি সিরিয়ালের কথাই ভাবুন)। অধিকাংশ ভোক্তা যখন উচ্চ মানের পণ্য ছেড়ে নিম্ন মানের পণ্যের দিকে ঝুঁকছে, তখন সেই পণ্য সরবরাহ না করলে বাজারে টিকে থাকা প্রচলিত মাধ্যমগুলির পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এ সবের যোগফল— সমাজের মন্দ-ভারসাম্যে আটকে পড়া।

এই নিম্নরুচির সাম্যাবস্থা থেকে উত্তরণের পথ আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তা অন্য সাধনার ফল। সেই সাধনার সাধ বা সাধ্য এখনও সমাজে সহজলভ্য নয়। তবুও, একটু সতর্ক কি হতে পারি না আমরা? বিনা আয়াসে, বিনা ব্যয়ে কোনও বিনোদন হস্তগত হচ্ছে বলেই তাতে তনুমন ঢেলে দিতে হবে, এই মানসিক আলস্যটুকু তো বর্জন করাই যায়।

অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement