একটি রাজনৈতিক প্রাণী
cow

গরু নিয়ে অশান্তি আজকের নয়, কেবল একটি দলের দায়ও নয়

স্বাধীন ভারতের এক জন নাগরিক আখলাক পাঁঠার মাংস খাবেন, না গরুর মাংস খাবেন, তার বিচার সমাজ বা রাজনৈতিক নেতারা করতে পারেন না।

Advertisement

রূপেন্দ্র নারায়ণ রায়

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৪৬
Share:

গল্পটি সত্যি কি না, হলফনামা দিয়ে বলতে পারব না! তবে বিশ্বভারতীর এক জন অধ্যাপকের কাছে শোনা: রবীন্দ্রনাথের কলম নাকি প্রায়ই খোয়া যেত। তাঁর গুণগ্রাহীদেরই কেউ হয়তো কলম আত্মসাৎ করতেন স্যুভেনির সংগ্রহের অছিলায়। তাই বোধ হয় যখন একটি ছড়ার প্রথম লাইন দিলেন এক জন, “সকল পক্ষী মৎস্যভক্ষী মাছরাঙা হয় কলঙ্কিনী!” গুরুদেব ছড়াটি শেষ করলেন এই বলে যে: “সবাই কলম ধার করে, হায়! আমিই কেবল কলম কিনি।”

Advertisement

গরু নিয়ে রাজনীতির কলঙ্ক একটি দলের ঘাড়ে অবশ্যই চাপানো যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাবে, বাকি সবাই পরিস্রুত তুলসী পাতা কি? নিশ্চয় মনে আছে, কংগ্রেস রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতীক ছিল জোড়া বলদ। তার পর পার্টিতে ভাঙন ধরল। ইন্দিরা গাঁধী প্রমাণ করলেন যে, তিনি ‘গুঙ্গি গুড়িয়া’ (বধির কন্যা) নন, তিনি এক জন বিচক্ষণ নেত্রী। জোড়া বলদ প্রতীক পেল আদি কংগ্রেস। ইন্দিরা গাঁধী দূরদর্শী ছিলেন। উনি ভেবে দেখলেন, জোড়া বলদ প্রতীকটা বড়ই পুরুষতান্ত্রিক। তা ছাড়া পারিবারিক দৃষ্টিকোণ একটু আনলে ভালই হয়। তাই তিনি প্রতীক নিলেন গাই-বাছুর। গরুতে ছাপ দিয়ে ভোট তাই বহু যুগ ধরে। অনেক পরে এসেছিল হাত।

আরও একটু আগের ইতিহাস। ব্রিটিশরা বলে সিপাহি বিদ্রোহ, আমরা বলি আমাদের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ। ১৮৫৭ সালে সেই বিদ্রোহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এই মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেলের প্রচলন। গরুর চর্বি মেশানো কার্তুজ দাঁতে কেটে বারুদ ভরতে হত, ফলে হিন্দু সিপাহিরা ধর্মনাশের আশঙ্কায় বিদ্রোহ করে। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মঙ্গল পান্ডে।

Advertisement

কথায় বলে গল্পের গরু গাছে ওঠে। আর গরু নিয়ে আমাদের সাহিত্যে তামাশা ও বিয়োগান্তক গল্পের শেষ নেই। সুকুমার রায়ের ঝালাপালা-তে ইংরেজির বাংলা অনুবাদ নিয়ে একটি অপূর্ব হাস্যকৌতুক আছে— “কেষ্টা: আজ্ঞে, ‘আই গো আপ, ইউ গো ডাউন’ মানে কী? পণ্ডিত: ‘আই’— ‘আই’ কিনা চক্ষুঃ, ‘গো’— গয়ে ওকারে গো— গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ। ‘আপ’ কিনা আপঃ— সলিলং বারি অর্থাৎ জল। গোরুর চক্ষে জল, অর্থাৎ কিনা গোরু কাঁদিতেছে। কেন কান্দিতেছে? না ‘উই গো ডাউন’, কিনা ‘উই’ অর্থাৎ যাকে বলে উইপোকা— ‘গো ডাউন’, অর্থাৎ গুদমখানা। গুদমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না, তাই না দেখে, ‘আই গো আপ’— গোরু কেবলি কান্দিতেছে।”

গরু নিয়ে একটি করুণ কাহিনিও আছে। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’। কাশীপুর গ্রামের গরিব চাষি গফুর। তার পরিবারের সদস্য বলতে সে, তার মেয়ে এবং একটি গরু, যার নাম মহেশ। গফুর যে গ্রামে থাকে, সে গ্রামের হিন্দু জমিদার শিববাবু গরুর প্রতি অবহেলার দায়ে গফুরকে অপরাধী সাব্যস্ত করেন। তারা গো শব্দের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা করে গফুরকে বোঝালেও নিজেরা গরুকে খাওয়ার জন্য খড় দিতে অস্বীকার করে। টাকার লোভে তিনি গ্রামে গরু চরে বেড়ানোর একমাত্র মাঠ বিক্রি করে দেন। গল্পের শেষে একটি ঘটনায় মেজাজ হারিয়ে গফুর তার মহেশকে লাঙলের ফলা দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলে, যে মহেশকে সে তার ছেলের মতো ভালবাসত। গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে গফুর শ্রমিক হিসেবে চটকলে কাজ করতে চলে যায়। কিন্তু যাওয়ার আগে সে একটি মর্মস্পর্শী ফরিয়াদ করে: “নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ তুলিয়া বলিল, আল্লা! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তার চ’রে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ ক’রো না।” এই গল্পে হিন্দু জমিদারের গরু প্রেম মেকি আর মুসলমান চাষি একটি গরুকে তার পুত্রসম ভালবাসে।

গরুর তক্কো-গপ্পো দুধ ছাড়া হয় না। দুধের উৎপাদনে আমাদের দেশ শীর্ষস্থানে ২০০০ সাল থেকেই। ১৯৯১-৯২’এ আমরা সাড়ে পাঁচ কোটি টন দুধ উৎপাদন করতাম। এখন তা ছুঁয়েছে ২০ কোটি মেট্রিক টনের কাছাকাছি। অর্থাৎ, ১৯৯১-৯২’এ মাথাপিছু দৈনিক উৎপাদন ছিল ১৮০ গ্রাম, তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪০০ গ্রাম। ভারতে দুধ উৎপাদনের ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং কিংবদন্তি পুরুষ ভার্গিস কুরিয়েনের নেতৃত্বে সমবায় আন্দোলনের সাফল্য আজ বিখ্যাত।

গরুর দুধ নিয়ে যে রাজনীতি একেবারেই হয়নি, তা-ও বলা যাবে না। মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন: “(আমি) ইফতারের আমন্ত্রণ পেয়েছি। সেই আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছি। এর জন্য কেউ যদি বলেন, মমতা মুসলিমদের তোষণ করে— তাঁরা বলতে পারেন। আমি বলি, যে গরু দুধ দেয় তার লাথিও একটু আধটু খেতে হয়। যে ডাকবে আমি যাব।” তৃণমূল নেতা জাভেদ খান তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কলকাতার রাস্তায় গরুর গাড়ি বার করেছিলেন। এ সব কিন্তু গরু নিয়ে অহিংস ভোট বাক্সের রাজনীতি।

সাম্প্রতিক কালে গরু নিয়ে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গিয়েছে গোহত্যা এবং গোমাংস ভক্ষণ। কোন ছোট পর্দার তারকা বলেছেন, ‘নবমীতে বিফ রান্না করি’— তাই নিয়ে তুলকালাম। বাড়িতে তিনি কী রান্না করবেন— বিফ না হ্যাম— সেটা তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। ফলাও করে তার সঙ্গে দুর্গাপুজো বা ইদ না জুড়ে দিলেই ভাল হত। ধর্মনিরপেক্ষতার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হিন্দুকে গোমাংস আর মুসলমানকে বরাহমাংস খেতে হবে, এমন কোনও বিধান নেই। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে শুধু ধর্ম আর রাজ্যপাট পৃথক রাখতে হবে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদ স্বধর্মপরায়ণ মুসলমান ছিলেন, কিন্তু দু’জনেই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে ছিলেন অটল।

গোমাংস কী, তাই নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি আছে। আমাদের দেশে মোষের মাংসের চাহিদা অনেক বেশি। গত শতাব্দীতে অনেক বনেদি পুজোয় মোষ বলি হত। ছেলেবেলায় শুনেছি, কৃষ্ণনগর রাজ পরিবারের পুজোয় নাকি বলিপ্রদত্ত একটি মোষ হাড়িকাঠ উপড়ে মা দুর্গার কাছে চলে যায়। তার পর থেকে জমিদারবাবু মোষ বলি নিষিদ্ধ করেন।

অনেকেই গরুর মাংস ভেবে মোষের মাংস খান। আমার মনে আছে, কাঠমান্ডুর ফিরিঙ্গি পাড়া থামেলের একটি রেস্তরাঁয় আমার এক জন লন্ডননিবাসী বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলাম। বন্ধু সাহেব মানুষ, তিনি স্টেক ফরমায়েশ করলেন। তার পর বললেন অপূর্ব স্বাদ , লন্ডনের যে কোনও স্টেককে হার মানায়। আমাদের হোটেলে ফেরার পথে আমাকে বললেন: “সব ব্যবস্থা অপূর্ব, শুধু মেনুতে বানান ভুল ছিল— বিফ স্টেকের জায়গায় লেখা ছিল বাফ স্টেক।” আমি সবিনয়ে বললাম, “বানানে কোনও গলদ নেই। নেপাল (তখন ছিল) হিন্দু রাজ্য। তাই গোহত্যা নিষিদ্ধ। বাফ হল বাফেলোর শব্দসংক্ষেপ, আপনি মোষের মাংস খেয়েছেন।” আমার বন্ধু সে রাতে আর কোনও কথা বলেননি।

মোষের মাংস রফতানিতে আমাদের দেশ শীর্ষে। দ্বিতীয় স্থানে ব্রাজিল। বিশ্বের বাজারে গরু এবং মোষের মাংস রফতানির পরিসংখ্যান এক সঙ্গে প্রকাশিত হয়ে থাকে। সেই হিসেবে রফতানিকারী দেশগুলির মধ্যে ২০২০ সালে এক নম্বর ছিল ব্রাজিল। তারা রফতানি করেছে ২৫.৫ লক্ষ মেট্রিক টন। দ্বিতীয় স্থানে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া। দু’টি দেশই ১৪ লক্ষ মেট্রিক টন রফতানি করেছে। ভারত থেকে যে ‘বিফ’ রফতানি করা হয়, তার ৯০% মোষের মাংস।

আমাদের দেশে অহিংস বেচারা একটি প্রাণীকে নিয়ে সহিংস রাজনীতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। ২০১৫ সালে গোরক্ষার নামে আখলাক খানকে গণপিটুনি দিয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের এক জন নাগরিক আখলাক পাঁঠার মাংস খাবেন, না গরুর মাংস খাবেন, তার বিচার সমাজ বা রাজনৈতিক নেতারা করতে পারেন না। যদি সেই অজুহাতে কোনও নাগরিককে হত্যা করা হয়, তা হলে আমাদের সমাজ অসভ্য এবং বর্বর আখ্যা পাবে।

তা হলে আমাদের সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের গলাকাটা জেহাদি জন বা করাচিতে সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লের হত্যাকারী আহমেদ ওমর সাইদ শেখের কী তফাত রইল?

দল, মত, আদর্শ এবং রাজনীতি নির্বিশেষে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement