যতই অতীত বর্ণনা করি না কেন, প্রেম সমসাময়িক
Valentines Day Special

ভালবাসার নির্ঘুম নির্ঘোষ

শরীরের কথা এসে গেল, যাক গে। প্রেমের একটা পর্যায়ে তাকে তো আসতেই হত। কিন্তু সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং কী শেখাল, মাঝখানের দু’তিন বছরে, পরিখার মতো একটা দুর্গম-দুর্ভেদ্য সময়ে?

Advertisement

রূপম ইসলাম

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:০৮
Share:

আমি প্রতীক্ষা করে আছি চাতকের মতো। জানি তুমি আসবে, কারণ তুমি বলেছ আসার কথা; কথা দিয়েছ। তোমার সেই মহার্ঘ কথার বিনিময়ে আমি আরও খানিকটা সময় দিতে পারব না? অপেক্ষা করতে পারব না? ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে পারব না? তা হলে আর জীবন সঁপে দেওয়ার বাগাড়ম্বর হৃদয়ের আপিসে রেজিস্টার করালাম কেন?— এ সব অন্তর্দ্বান্দ্বিক প্রশ্ন আমায় কুরে কুরে খেতে আরম্ভ করেছে তত ক্ষণে। আর এদের প্রশ্রয় পেয়ে আমি দাঁড়িয়েই রয়েছি স্থির।

Advertisement

এই ভাবেই সময় বয়ে যেতে থাকল, যেমন ভাবে সে নিরবচ্ছিন্ন বয়ে যায়। তার পর ঘটল সেই ম্যাজিকের মতো ঘটনা। প্রায় জাদুবাস্তবতার পর্দা সরিয়ে, সাইকেল চালিয়ে, বাদামি চুল সরানো ব্রণ কপাল আর ঘামে ভেজা টি-শার্টের উড়নচণ্ডী অবয়ব নিয়ে সে নেমে এল আমার সাদা-কালো সিনেমাস্কোপকে রঙিন করে দিতে— বাস্তবেই সে এল, মোবাইল ফোনের পর্দায় বা সমাজমাধ্যমের জানলায় নয়, কারণ যে স্থির-চলচ্চিত্রে আমি ফিরেছি এখন, তা এখনকার ‘সব পেয়েছি সহজে’-র ডিজিটাল যুগের শূন্যসর্বস্বতার গর্বিত দৃশ্যমানতার পতাকা ওড়ানোর সময় নয়, কিংবা তখন সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-এর ড্রিলও অভ্যাস করছিল না থমকে যাওয়া আকুল পৃথিবী। তথাকথিত তারুণ্যের প্রতিনিধি এই আমারও বয়স হয়েছে বেশ অনেকটাই। আমাকেও বলতে হচ্ছে— আমার বর্ণনা করা দৃশ্যটির পৃথিবী সত্যিই অন্য রকম ছিল।

কিন্তু প্রেমের তাতে কী বা আসে যায়? প্রেম অতীতের নয়। সে যতই আমি অতীত বর্ণনা করি না কেন, প্রেম সমসাময়িক। ‘আহা, আমাদের তো এত সহজে মেলামেশার সুযোগ ছিল না, তখন একটা চুম্বনও যেন অতিরিক্ত সংবেদন, আশ্চর্য শিহরনের জোগান দিত, এখন শরীর সহজলভ্য, তাই আবেগও ফিকে হয়ে গেছে’— এ নিয়ে অনেকে বলবেন, প্রমাণও করে দেবেন, আমি তবুও বলব সমসময়ের প্রেমই শ্রেষ্ঠ প্রেম। কারণ, সমসময় আমায় শিখিয়েছে আমার বয়সে প্রেমকে ঠিক কোন নজরে দেখতে হয়। ঠিক যেমন সমসময় এক জন নবযুবক বা কিশোরের মননে প্রেমের প্রথম সঞ্চার ঘটাচ্ছে, আমিও তার মতো করেই আমার উপলব্ধির স্বাধীন ঘোষণা করতে চাই। আমি এই গৌরবে থাকতে চাই, তা উদ্‌যাপন করতে চাই যে, আমার আজকের প্রেমানুভূতি আমার প্রথম প্রেম নয়। প্রেমের খণ্ড মুহূর্তের শৈল্পিক প্রকাশের পোড়খাওয়া ফেরিওয়ালা আমি— আমি আমার এই সময়ের প্রেমবোধের জন্য কিশোর-কিশোরীর দিকে যেমন তাকাব, তেমনই তাকাব আয়নার দিকেও। তলিয়ে যাব নিজেরই চোখের অব্যক্ত কথার গভীরে। আমি এই সময়ে দাঁড়িয়েই আগুন লাগাব নিজের শরীরে। আমি যদি আজ এখনই পুড়তে না পারি, কী করে ভাবব প্রেম? কী করে লিখব প্রেম? কী করে গাইব প্রেম?

Advertisement

শরীরের কথা এসে গেল, যাক গে। প্রেমের একটা পর্যায়ে তাকে তো আসতেই হত। কিন্তু সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং কী শেখাল, মাঝখানের দু’তিন বছরে, পরিখার মতো একটা দুর্গম-দুর্ভেদ্য সময়ে? শিখিয়ে দিল, না-ছুঁয়েও ছুঁয়ে দেখা যায়, না-স্পর্শ করেও সংস্পর্শে থাকা যায়। সামাজিক মেলামেশা দুম করে বন্ধ হয়ে যাওয়া, সে তো ১৯৯২ সালের কার্ফুর ক’দিনও অভ্যাস করতে হয়েছিল প্রেমিক প্রজন্মকে। নচিকেতা লিখেছিলেন, “যুবতীর কটাক্ষ, চিরে দেয় এ বক্ষ, হায়রে এমন দিনে সেই অবকাশ নেই।” কিন্তু যোগাযোগহীনতার এ যাতনা সে সময়ে অতিমারির মতো সাংঘাতিক চেহারা নেয়নি, ফলে দূর সংযোগের জন্য পৃথিবী ব্যাকুল হয়নি— ব্যাকুল না হলে কি আর বিপ্লব হয়?

অতীত তার তীব্র প্যাশনের দোহাই দিয়ে যে দূরবর্তিতা কিছুতেই সহ্য করত না, আজকের প্রেম কিন্তু প্রয়োজনে দূরে থেকেও নিজেকে শান্ত, সুসংহত রাখতে পারে। প্রেমের ইতিহাস বলে, শরীরবাদ তথা বস্তুবাদ তথা ভোগবাদ সসম্ভ্রমে অধ্যাত্মবাদকে রাস্তা ছেড়ে দিয়েছে বার বার, প্রয়োজন হলেই। সে ভাবেই তো আধ্যাত্মিক মিলনের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই নিজেদের শেষ করে দিয়েছে কত শত ট্র্যাজেডির নায়কনায়িকা, সমাজ যাদের যূথবদ্ধতাকে স্বীকৃতি দেয়নি। এ ভাবেই আমরা দেখেছি রাধাকে, আমরা পেয়েছি মীরাকে। শরীরী সমস্ত আশ্লেষ এদের হাত ধরেই স্পিরিচুয়ালিটির অঙ্গনে প্রবেশ করেছে। আমার রচিত গানের লিরিক বলে টেলিফোনের রিসিভারকে প্রেমিকাবোধে চুম্বন করতে, আজকের যুগে মোবাইল ফোনের পর্দাও কি এই ধারাতেই চুম্বনসিক্ত হচ্ছে না?

এটা কি শরীরবাদ? না কি আধ্যাত্মিক? আধ্যাত্মিক না হলে কি আদৌ উপাসনাকালে পাথরপ্রতিমায় প্রাণের সঞ্চার অনুভব করা যায়, না দূরভাষকে ভাবা যায় চুম্বনপ্রত্যাশী ওষ্ঠ? আমার হিসাব গুলিয়ে যায় ভাবতে ভাবতে, লিখতে লিখতে। আর তখনই মনে পড়ে যায়, আরে, কী মুশকিল! প্রেম নিয়ে লিখছি তো! সব কিছু এমন ভাবে গুলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তো প্রেমেরই আছে।

গুলিয়ে আরও যাচ্ছে, ঘেঁটে যাচ্ছে পুরোটাই। আমি যদি একটা গান লিখতাম, বা লিখে ফেলতাম আস্ত একটা কবিতার বই— কিচ্ছু ঘাঁটত না। সব কিছু কেমন চমৎকার সরলরৈখিক হত। গল্পহীন গদ্য লিখতে আসাটাই যত সমস্যার মূলে। প্রেমকে কে ধরবে তত্ত্ব দিয়ে, কার ঘাড়ে ক’টা মাথা? তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করতে গেলেই সেই দশা হবে, যা আমার হয়েছে, হচ্ছে। এই কথাটা তো মানবেন— প্রেম হল এক ধরনের ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া, ভেঙেচুরে ফেলা তাণ্ডবনাচ, এক প্রলয়ঙ্কর বিপ্লব। ছোট করে বললে, ভাঙন। কিন্তু এই ভাঙন আদৌ কি স্থিরতাপ্রত্যাশী? প্রেম কি আদৌ কোনও প্রাপ্তিযোগে বিশ্বাসী? তা হলে না-পাওয়া প্রেম, পাওয়া প্রেমের চেয়ে বড় হয় কোন ফর্মুলায়? শেষ দৃশ্যে বেজে উঠল সামাজিকতার সানাই, ব্যস— সিনেমার মতো প্রেমের রোমাঞ্চেরও এক প্রকারের দি এন্ড।

না না, এর জন্য আমি দোষ দিচ্ছি না কাউকেই, সংসার একটা অন্য দিগন্ত— দিগ্‌ভ্রষ্টমাত্রই জানে। এটা জানি বলেই বলছি, প্রেমের বিপ্লব আদৌ সেই সংগ্রামের সাফল্যপ্রয়াসী কি না, তা নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। দেখুন, সংসারের কথা এলে দুটো খুব দরকারি শব্দ আসে। একটা নির্ভরতা, অন্যটা অভ্যস্ততা। প্রেমের রাসায়নিক উন্মাদনা স্তিমিত হলে জীবনকে একটা সর্বজনগ্রাহ্য ধারণা দেওয়ার কামরায় এই দুটো বিষয়ের ভূমিকা চেয়ার আর খাটের মতো, কেউ সাহায্য করে বসতে, কেউ শুতে। আচ্ছা, এগুলোও কি প্রেম? বিচক্ষণের মতে, এরা হল প্রেমেরই অভিযোজন। প্রেম যদি না থাকত, আদৌ কারও উপরে চোখ বুজে নির্ভর করতে পারা যেত কি? সমালোচক বলবেন— আহা, চোখ বুজে যদি নির্ভরই করবে, তা হলে তো তুমি স্থিতাবস্থার কথা বলছ হে! দামাল বিপ্লবী কি কোনও দিন থিতু হতে পারে? সে যদি থিতুও হয়, প্রেম কি সে ক্ষেত্রে গৃহপালিত প্রাণীর অবয়ব নেবে? ঘুরঘুর করবে পালকপ্রভুর পায়ে পায়ে? না কি সে শয়তানের মতো ফিসফিসিয়ে বলবে ইভের কানে কানে, “জ্ঞানফল খাবে না? দেখবে না এক বার, কী হয় খেলে? জীবন তো একটাই! আদৌ যা পেয়েছ, তা প্রেম তো?”

যা পাইনি তার রোমাঞ্চ তো না-পাওয়াতেই। যা পেয়েছি তার উদ্‌যাপনের অধিকারও কেড়ে নিতে পারে না এ পৃথিবী। এখন এই দুই হিসাবকে যদি প্রেমের স্বার্থেই উলটপালট না করে ফেলি, তখন এক নিরুপদ্রব বাস্তুতন্ত্রের নকশা ফুটে উঠবে চোখের সামনে। তখনই আবার, কেউ এক জন জোরে আমার মাথাটা ঠুকে দেবে দেওয়ালে। হিংস্র ভাবে বলবে— “ইডিয়ট, এতটা নিরুপদ্রব কোনও প্রেমের গল্প হতে পারে? হওয়া সম্ভব?”

সেই ধমক খেয়ে দৃশ্যত বিব্রত আমি নেমে পড়ব রাস্তায়। গিয়ে দাঁড়াব নাটকীয় এক চৌমাথার সন্ধিক্ষণে। আমি জানিই তো, রাস্তা পেরিয়ে ছুটে আসবে এক সাইকেল-আরোহী কিশোরী, নেহাতই সে আসবে বলে কথা দিয়েছে, আর সেই কথা দেওয়াকে ভালবেসে ফেলেছি আমি। ভালবাসার সেই বোধ এখন, এখনই বাড়ছে আমার মধ্যে। বাড়ছে অস্বস্তির মতো, বাড়ছে যন্ত্রণার মতো। আমি কে? আমি এক জন মানববোমা। আসলে প্রেমের সেই চৌমাথায় দাঁড়িয়ে আত্মবিস্ফোরণের অপেক্ষা করছি আমি যুগ থেকে যুগান্তরে। এমন সময়ই ঠিক ম্যাজিক হবে। চৌমাথাটা প্রসারিত হয়ে সাত মাথার মোড় হয়ে যাবে। প্রত্যেকটা প্রেমিক-রাস্তা নিজেদের আবারও বিভাজিত করতে থাকবে আমার চোখের সামনে। আঠারোটা মোড়, সাতাশটা মোড়, ছাপ্পান্নটা, তেষট্টিটা... অবাক হয়ে সেই বিভাজন-সংযোজন দেখব; ভাবব, আচ্ছা, প্রেমের কি কোনও শেষ নেই?

আমি মোড় গুনে যাচ্ছি। বিড়বিড় করছি কবিতার লাইন। আর নাছোড়বান্দা গদ্যবোধ আমার বিড়বিড়ানি থামাতে চাইছে বাস্তবনির্ভর সংলাপে, প্রবল যুক্তির হিসাবি রোলকলে ডুবিয়ে দিতে চাইছে আমার মন্ত্রোচ্চারণ, আরও রেগে গেলে পাথর ছুড়ে মারছে। বেশি দেরি নেই, এ বার ওরা মারণাস্ত্র তুলে নেবে হাতে। কারণ প্রহর জানে, যার আসার কথা ছিল, সে আসেনি। শহর আলবাত জানে, বিশ্বাস করে— আমি এক জন অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত, উন্মাদ। খালি আমার মনে হতে থাকে, কেমনধারা সরল বিশ্বাসে তা সত্যিই এখন আর জানি না, আমি আদতে এক জন প্রেমিক। সেই তখনও যেটা মনে হত, আজও যে তেমনটাই মনে হচ্ছে। কী করব? কোথায় টাঙিয়ে রাখব আমার লক্ষ লক্ষ ভালবাসার নির্ঘুম-নির্ঘোষ? কী ভাবেই বা একটু পরে দু’হাত মাথার উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করব তোমার সমীপে? অথবা তোমার আগ্নেয়াস্ত্রের ছুটে আসা বুলেটকে কী ভাবেই বা আদর করব আমি, প্রিয়তমা?

মহাপ্রলয়ে উড়িয়ে দেব

যত বিস্ফোরণের শুকনো ছাই

আমি ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি ধুলোয়

লিখে দেব, শুধু তোমাকে চাই

তুমি হয়তো এখনও জানো না

কারও সাধ্য নেই আমায় আটকায়

আমি ভালবাসব আবার তোমায়

যত বেশি ভালবাসা যায়...

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement