দু’টি বছরের অধীর প্রতীক্ষার পর খুলেছে ইস্কুলের দরজা। শিশুকণ্ঠের কলরব, মিড-ডে মিল-এর রান্নার ঘ্রাণ, ক্লাসঘরের উষ্ণতা, সব মিলে যখন আমরা সবে পাচ্ছি মুক্ত বায়ুর আশ্বাস, তখনই ওয়ার্নিং বেল বেজে উঠল— শুরু হতে চলেছে মাধ্যমিক পরীক্ষা। এক অর্থে এই ঘণ্টাধ্বনি আমাদের স্কুলজীবনের চেনা ছন্দে ফেরার সঙ্কেত। আবার সেই সঙ্গে বুকে ঢেউ তোলে গোপন উদ্বেগ। প্রায় দু’টি বছর যারা ক্লাসে বসতে পেল না, যাদের অধিকাংশেরই নেই মোবাইল ফোন, এমনকি যারা নিজের স্কুলেও অনেক দিন পর প্রবেশ করল, তারা সেই বিচ্ছিন্নতা থেকে একটা অন্য স্কুলে বসে কঠোর শৃঙ্খলায়, কেন্দ্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষায় কী ভাবে স্বচ্ছন্দ হবে?
পরীক্ষার হলে নজরদারির কাজ করতে করতে অতিমারি-উত্তর পড়ুয়াসমাজের টুকরো টুকরো ছবি উঠে এল। এই ‘নজরদারি’-র রীতিটা আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার একটা বেশ মন্দ দিক। কারণ এটা পড়ুয়া আর শিক্ষক, উভয়েরই পারস্পরিক বিশ্বাস আর মর্যাদাবোধকে অসম্মান করে। তার উপর হালফিলের দু’একটি অবাঞ্ছিত ঘটনার পরে সমগ্র শিক্ষককুলও নজরদারির অধীনে এসেছে। পরীক্ষাকেন্দ্রে পুলিশ বা আশাকর্মীর হাতে সচল মোবাইল ফোন থাকলেও, শিক্ষকের সঙ্গে ফোন থাকা বারণ। এমনকি জানা গেল, কোথাও কোথাও লিখিত নির্দেশনামা ছাড়াই দিদিমণির হাতব্যাগটিও তাঁর কাছে না রাখার আদেশ দিয়েছেন কোনও কোনও কর্তাব্যক্তি। অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এমন অপমানজনক, অসুবিধাজনক শর্তের প্রতিবাদও করেছেন। এ সব খবর ছড়িয়েছে মুখে মুখে। রক্তকরবী নাটকের যক্ষপুরীর মতো আবহে, মুখোশ-পরা কিছু মানুষ পারস্পরিক অবিশ্বাসের পরিবেশে পরীক্ষা সম্পন্ন করলেন।
আমাদের দেশে যে কোনও পরীক্ষার ঘরে নকলনবিশ থাকেই দু’-এক জন, কারণ এখানে শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুমনের স্বাস্থ্যের দিকে নজর করা হয়নি কোনও কালে। রবীন্দ্রনাথ একেই বলতেন ‘মার্কা’ দেওয়ার কল। কিন্তু সবিস্ময়ে এ বার লক্ষ করলাম, পরীক্ষার হলে পড়ুয়াদের নকল করার নজির নজর করার মতো কম। এমনকি পরীক্ষা শুরুর আগে শেষ মুহূর্তে বইয়ের পাতায় নজর বুলিয়ে নেওয়ার আকুলতা, অথবা প্রশ্ন হাতে পেয়ে সহপাঠীর সঙ্গে চঞ্চল দৃষ্টি বিনিময়, এ সবও প্রায় নেই। এই শিশুরা নিঃসঙ্গ, এমনকি নির্লিপ্তও। প্রশ্ন সহজ না কঠিন, পরীক্ষার্থী যেন সেটাও ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছে না।
এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা বলি। হঠাৎ এক মাস্টারমশাইকে পরীক্ষার্থী ছাত্র ইশারায় ডেকে বেশ স্পষ্ট স্বরেই পাশের আর একটি ছেলেকে দেখিয়ে বলল, “স্যর, ও নকল করছে।” মাস্টারমশাই তাঁর করণীয় কাজটি তখনই করলেন। তবে পরীক্ষার শেষে সেই ছেলেটিকে জনান্তিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, তুই তোর বন্ধুকে ধরিয়ে দিলি!” উত্তর এল, “স্যর, ওকে আমি ভাল করে চিনি না।”
“তোর ক্লাসের বন্ধু নয় ও?”
“হ্যাঁ স্যর, কিন্তু চিনি না ঠিকমতো।” দু’বছরের বন্ধ দুয়ার আমাদের শুধু গৃহবাসীই নয়, পরবাসী করে রেখেছে, নজর দেওয়ার সময় এসেছে সেই সত্যের প্রতিও। নষ্ট হয়ে গিয়েছে সামুদায়িক বোধ, মুছে গিয়েছে একত্র বাঁচার অভ্যাস, এক সঙ্গে জোট বেঁধে দুষ্টুমি করার স্বাভাবিক প্রবণতাও। কত পড়ুয়া পরীক্ষা দিল না এ বছর, তাদের কত জন মেয়ে, তারা স্কুলের উঠোন থেকে ছিটকে কোথায় গেল, কেন তাদের রাখা গেল না স্কুলে, তার উত্তর তো খুঁজতে হবেই আমাদের। কিন্তু যারা রইল, তারা কেমন রয়েছে, শৈশব-কৈশোরের স্বাভাবিক স্ফূর্তি, বন্ধুত্বের অমূল্য সম্পদ, বইয়ের পাতায় অজানা বিশ্বকে আবিষ্কারের হাতছানি, সব হারিয়ে কেবল পাশ নম্বরের অপেক্ষা করছে কি না, তা-ও বুঝতে হবে।
পরীক্ষার শেষ দিন। ইদানীং মফস্সল স্কুলে একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিছু ছাত্র একেবারে শেষ দিনে পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কী এক ক্ষোভে আঘাত করছে বসার আসনটিকে, লেখার বেঞ্চকে, অথবা মাথার উপরের পাখাটিকে। হয়তো নিজেরাই জানে না, কিসের এই রাগ। শেষ দিনে প্রায় পুলিশি সতর্কতায় শিক্ষকদের দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে প্রহরী সেজে। এই প্রহরীর সাজ মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, আমাদের শিক্ষার জগতে লক্ষ্যের থেকে উপলক্ষ কত বড় হয়ে উঠেছে!
আবার অন্য ছবিও রয়েছে। পরীক্ষাকেন্দ্রের একটি ঘরে পরীক্ষা দিল দু’টি কিশোর। তারা, আধুনিক বয়ান অনুযায়ী, ‘বিশেষ ভাবে সক্ষম’। একটি কিশোর হুইলচেয়ারে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে। পাশের জন বালকস্বভাব। ধীরে, খুব কষ্ট করে লিখে উঠতে পারে অক্ষর। মানসিক বৃদ্ধিতে কোনও সমস্যা আছে তার। সে রোজ দেখে, হুইলচেয়ারের ছেলেটিকে বিশেষ কারণে কিছু সময় অন্তর একটু বিস্কুট আর জল দিতে হয়। শিক্ষকই সে দায়িত্ব পালন করেন। শেষ দিনের শেষ ঘণ্টা বাজল ‘ঢং’ শব্দে। বালকস্বভাব কিশোর খাতাটি শিক্ষকের হাতে সঁপে দিয়ে বলে উঠল, “স্যর, আমি কি ভাইকে একটা বিস্কুট খাইয়ে দিতে পারি?”