ওরা ভাল নেই।” গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যত বার প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তত বারই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথাটা শুনতে হয়েছে। এক জন-দু’জন নয়, অনেকের কাছ থেকে। কাজের সূত্রে বহু প্রাথমিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়। ‘ওরা’ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু। মাস্টারমশাইদের কথার সারসংক্ষেপ: স্কুল বন্ধ বলেই ওরা ভাল নেই। বিক্ষিপ্ত ভাবে নানা জনে নানা চেষ্টা করছেন, যাতে স্কুল বন্ধ থাকা অবস্থায় লেখাপড়ার সঙ্গে বাচ্চাদের সংযোগটা বজায় রাখা যায়। খবর আসে, পাঠ দানের ছোট ছোট ভিডিয়ো, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সাহায্যে যোগাযোগ, ফোনে কথা, মা-বাবাদের পাঠ্য বিষয় বুঝিয়ে দেওয়া, বাড়িতে কাজ করার জন্য ওয়ার্কশিট বানিয়ে পাঠানো ইত্যাদি নানা পদ্ধতিতে শিশুপাঠ জারি রাখার। “যত যা-ই করুন, এগুলো সিন্ধুতে বিন্দু। ক’জনের স্মার্টফোন আছে? ক’জনই বা ইন্টারনেটের সুবিধা পায়?” এখানে শিক্ষকেরা যে প্রশ্ন তুলছেন, সেটাকেই প্রমাণ করছে সম্প্রতি ইউনিসেফ প্রকাশিত একটি সমীক্ষা— সারা পৃথিবীর অন্তত ৩০ শতাংশ বাচ্চার কাছে ফোন বা ইন্টারনেটের সুবিধা নেই। ভারতে এই অনুপাতটা অনেক বেশি হবে। তার উপর সমীক্ষা বলছে, বঞ্চিতদের তিন-চতুর্থাংশই গ্রামাঞ্চলের এবং দরিদ্র পরিবারের। প্রাথমিক শিক্ষকদের মঞ্চ ‘শিক্ষা আলোচনা’র সদস্য বন্ধুরা জানাচ্ছেন, শুধু গ্রামে নয়, শহরেও বহু শিশুর কাছে স্মার্টফোন জাতীয় সুবিধা স্বপ্নের ব্যাপার। ফলে একটা দুশ্চিন্তা এই যে, দীর্ঘ দিন স্কুলের সঙ্গে অ-সংযোগের কারণে বাচ্চাদের অনেকেই স্কুলছুট হয়ে যাবে। পৃথিবীর অভিজ্ঞতাও তাই বলে। ইবোলা মহামারির কারণে সাত মাস স্কুল বন্ধ ছিল লাইবেরিয়ায়, স্কুলছুট হয়েছিল ২৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আমাদের দেশে অনুপাতটা অনেক বেশি হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা মনে করছে, ২০০০ সালের পর বিশ্বে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কমে যাওয়া শিশুশ্রমের হার (৯৪ শতাংশ) আবার উল্টো পথ নিতে পারে। অচিরেই বিশ্বে এবং ভারতের মতো দেশগুলোতে বহু শিশুকে সস্তা মজুরের বাজারে দেখতে পাওয়া যাবে।
সেই সঙ্গে দুঃস্বপ্নের মতো নেমে আসছে আর এক সঙ্কট। একটা গোটা প্রজন্ম পাঠের অন্তর্গত বিষয়ের প্রায় কিছুই শিখতে পারবে না। আজ়িম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির করা একটি গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে যথাক্রমে ৯০ শতাংশ ও ৮২ শতাংশ শিশু ভাষা ও গণিত বিষয়ক সামর্থ্যের দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। “এমনিতেই এক-দু’সপ্তাহ কামাই হয়ে গেলে বাচ্চারা অনেক কিছু ভুলে যায়, তাদের নতুন করে শেখাতে হয়। এখানে তো মাসের পর মাস পড়ার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। কী হবে বলুন তো? আবার অনেকে শিশু শ্রেণির বা প্রথম শ্রেণির ক্লাসে আসতেই পারেনি। তাদের অবস্থা ভাবুন।”— বলছিলেন এক শিক্ষক।
“গোটা প্রজন্মটাই অন্ধকারে চলে গেল। এ যে কত বড় ক্ষতি, অনুমান করতেও ভয় লাগে।” তিনি যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখছেন: “শুধু গণিত, বাংলা, ইংরেজি, পরিবেশের মতো পাঠ্য বিষয়ের ক্ষতি হলে একটা কথা ছিল। বাচ্চাদের মানুষ হয়ে ওঠার পথটাই আটকে গেল। তাদের মানসিক বিকাশের অনেকটাই ঘটে ইস্কুলে। এখন ওরা নিঃসঙ্গ। একেবারে একা।” শিক্ষাবিজ্ঞান আমাদের জানায় যে ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গত সামর্থ্য যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি শিশুদের সামাজিক-আবেগগত শিক্ষা (সোশিয়ো-ইমোশনাল লার্নিং)। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হওয়া, খেলতে না পারা, বাইরে বেরোতে না পারা, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ না থাকা ইত্যাদি কারণে শিশুরা বিষণ্ণতার শিকার হচ্ছে, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব পরিবারেই। বিত্তশালী বাড়ির বাচ্চারা হয়তো প্রযুক্তি, মা-বাবা, প্রাইভেট টিউশন প্রভৃতির সাহায্যে পাঠ্য বিষয় শিখে উঠতে পারছে, এবং প্রতিযোগিতার বাজারে তাদের দরিদ্র সহপাঠীদের থেকে হাজার হাজার মাইল এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়ায় বঞ্চিত হচ্ছে তারাও। তাদের মধ্যেও বেড়ে উঠছে ফোন বা ইন্টারনেটকে সঙ্গী করে, ঘরের মধ্যেই এক বিচ্ছিন্ন বিশ্বে নিজেকে বন্দি করে রাখার ঝোঁক।
দরিদ্রের সমস্যা ঘোরতর। এক দিকে ক্ষুধা, অনাহার, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যের বিপদ, অন্য দিকে, তাদের মনের উপর নিরন্তর চাপ। সারা ক্ষণ রোগ নিয়ে কথা, মা-বাবার অনিশ্চিত রোজগার নিয়ে কথা, মৃত্যু নিয়ে কথা। তাদের জীবন এমনিতেই আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় ভরা, স্কুল তাদের সেই সব সঙ্কট থেকে খানিক মুক্তি দিত। “ইস্কুল বন্ধ হয়ে তাদের জীবনটাকেই ছারখার করে দিল। তাদের কত জনের বুদ্ধি স্বাভাবিক পথে এগোবে, বলা কঠিন। কেউ মুষড়ে পড়ছে, কেউ আরও একাকিত্বে সেঁধিয়ে যাচ্ছে, কেউ বা অপরাধের দিকে ঝুঁকছে”, বলছিলেন এক শিক্ষিকা। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি: “তাদের মধ্যে যারা ইস্কুলে ফিরতে পারবে, তাদের কত জনকে আমরা একটা সুস্থ জীবনের পথ দেখাতে পারব, আমার জানা নেই।”
এক কথায়, দেশের কয়েক কোটি শিশুর জীবন থেকে তাদের শৈশব কেড়ে নেওয়া হল। বন্ধু, শিক্ষক, স্কুল, কলতলা, খেলার মাঠ, আকাশের রং, গাছের পাতা, পাখির ডাক, আইসক্রিম বিক্রেতার ঘণ্টি, কাগজের নৌকা, মাটির গন্ধ— সব কেড়ে নেওয়া হল। কেড়ে নেওয়া হল, কারণ সেটাই সবচেয়ে সহজ, তার জোরালো ঐতিহ্য আছে। আমরা এমন এক দেশের বাসিন্দা, যেখানে শিশুদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে জেনেও ভোট, পুলিশ ক্যাম্প, পার্টির মিটিংয়ের মতো নানা কাজে সর্বাগ্রে স্কুলটার দখল নেওয়া হয়। সেই ঐতিহ্য মেনেই, কোভিডের ত্রাহি রব শুরু হওয়ামাত্র সরকার প্রথমেই যেটা করল, তা হল স্কুল বন্ধ করে দেওয়া। শিশুদের লেখাপড়ার কী হবে, তাদের জীবনের কী হবে, এ সব ভাবনা সরকারের নীতিতে জায়গা পায়নি। আবার নাগরিক সমাজও বোধ হয় অতিমারির আতঙ্কে এতটাই বিহ্বল যে, দেশের শিশুদের কথা তার মাথায় আসেনি। তাই যদি বা কেউ প্রশ্নটা তোলার চেষ্টা করেছেন, তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগে প্রাণ বাঁচাতে হবে, তার পরে লেখাপড়া, ও সব পরে হবে।
সামান্য তলিয়ে ভাবলে সত্যটা অন্য ভাবে ধরা দিত। লেখাপড়া ও শিশুদের জীবনের গড়নের কাজটা অতিমারি প্রতিরোধের বিরোধী নয়। এবং, মারিতে যে ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে— জীবনহানি, দুর্ভোগ, আয়ের ক্ষতি ইত্যাদি— তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি হয়ে চলেছে মাসের পর মাস স্কুল বন্ধ থাকায়। শিশুরাই যদি ভাল না থাকে, দেশ কী করে ভাল থাকবে? বস্তুত, এই চিন্তা থেকেই বিশ্বের কিছু কিছু দেশে অতিমারির মধ্যে বাচ্চাদের লেখাপড়া ও গোটা জীবনকে অক্ষত রাখার জন্য নানা ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন, সুইডেন স্কুল খোলা রেখেছে, শিশুদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থেকেছে। ইউরোপের যে সব দেশ স্কুল বন্ধ রেখেছিল, তাদের মধ্যে অনেক দেশই আবার স্কুল খুলে দিয়েছে বা দিচ্ছে। কিছু দেশে স্কুল পুরো খোলা হয়নি, কিন্তু পাড়ায় গিয়ে ছোট ছোট দলে শিশুদের লেখাপড়া করানো হচ্ছে। বহু দেশে ইস্কুল বন্ধ থাকা অবস্থাতেও দৈনিক স্কুলের খাবার দেওয়া হয়েছে; আমাদের এখানে যে রকম মাসিক চাল, আলু ইত্যাদির প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তেমন নয়। খাবার দেওয়ার প্রক্রিয়ায় বাচ্চাদের সঙ্গে খানিকটা হলেও স্কুলের যোগাযোগ বজায় রাখার চেষ্টা হচ্ছে।
আমরা কি পারতাম না? কিছু শিক্ষক তো ছোট ছোট আকারে বাচ্চাদের স্বাভাবিক জীবন ধরে রাখার কাজে নানা উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিশুদের বাড়ির কাছে কোনও ফাঁকা জায়গায় ছোট দলে ভাগ করে, অথবা বিভিন্ন বয়সের বা শ্রেণির শিশুদের জন্য পালা করে ক্লাস চালানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ রাজ্যেও কিছু কিছু জায়গায় শিক্ষকেরা স্থানীয় শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের সাহায্যে এ রকম ক্লাস চালাচ্ছেন। আবার, কোথাও স্থানীয় নেতাদের অতি সতর্কতার দাপটে উদ্যোগ শুরু করেও থেমে যেতে হয়েছে। সরকার চাইলেই শিশুদের জীবন স্বাভাবিক রাখার জন্য এই সমস্ত শিক্ষক, সমাজের অন্যান্য মানুষ ও রোগ-বিশারদদের সঙ্গে পরামর্শ করে নানা ভাবে স্কুল খোলার ব্যবস্থা করতে পারত। সেটা শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন অবদান রাখতে পারত। রোগ-বিশারদ ও জনস্বাস্থ্যবিদদের মধ্যেও জোরালো আওয়াজ উঠছে স্কুল খোলার, যার উদাহরণ— দ্য গ্রেট ব্যারিংটন ডিক্লারেশন।
সাবধানতা মেনেই স্কুল খোলা যায়। কিন্তু সাবধানতার নামে ছোটদের জীবনের গতিটাকে রুদ্ধ করে দেওয়া চলে না। তাদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করার জন্য কথা বলতে হবে, কথা শুনতে হবে, চিন্তা করতে হবে এবং শিশুদের জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তাটা অনুভব করতে হবে। স্বীকার করতে হবে যে— ওরা ভাল নেই।