গত বছর মার্চে ইউনিসেফ উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল, “স্কুল-প্রক্রিয়া নষ্ট হওয়াটা আর দিনে গোনা হচ্ছে না, হচ্ছে মাস দিয়ে।” তার পর অবশ্য পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। বৈশ্বিক শিক্ষা সম্প্রদায়ের দুশ্চিন্তা ও তা থেকে উদ্ভূত কর্মোদ্যোগের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পিছনে কাজ করেছে একটা বাস্তব হিসেবনিকেশ— অসুখের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে স্কুল বন্ধ করে রাখার ফলে লাভক্ষতির তুল্যমূল্য বিচার।
ইউনিসেফ-এর সেই দলিলে বলা ছিল, বাচ্চাদের পড়া, লেখা, ও সংখ্যাগণনার সামর্থ্যের প্রবল ক্ষতি হয়েছে, শুধু তা-ই নয়— ফলস্বরূপ তাদের ভবিষ্যৎ বিকাশের পথ আটকে গেছে। কেবল শেখার ক্ষতিই নয়, স্কুল বন্ধ থাকার ফলে তাদের সাধারণ জৈবিক দক্ষতাগুলোরও বিকাশ হতে পারছে না। কোটি কোটি শিশু শিক্ষা-দারিদ্রের শিকার হয়ে পড়েছে, এবং সেই দারিদ্র তাদের ভবিষ্যৎ জীবন এবং পৃথিবীর আর্থিক ক্রিয়াকলাপের উপরও আঘাত হানছে। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা হল, কোটি কোটি শিশুর দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অকল্পনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। স্কুল-মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের পুষ্টির ঘাটতি বৃদ্ধি পাবে। এবং, সর্বোপরি, আঘাতটা সবচেয়ে বেশি এসে পড়বে সমাজের সুযোগবঞ্চিত শ্রেণিগুলির উপর। নষ্ট স্কুল-প্রক্রিয়া ও শিক্ষা-দারিদ্র তাদের খাদ্য-দারিদ্র, পুষ্টি-দারিদ্র, স্বাস্থ্য-দারিদ্র, সর্বোপরি সম্ভাবনা-দারিদ্রকে বাড়িয়ে তুলবে। সম্প্রতি, ২০২১-এ নীতি আয়োগ প্রকাশিত ন্যাশনাল মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স স্পষ্ট দেখাচ্ছে, দেশে পুষ্টি, স্বাস্থ্য, ও শিক্ষাগত দারিদ্রের ছবিটা কত ভয়াবহ। নষ্ট স্কুল-প্রক্রিয়া আমাদের মতো দেশে পরম্পরাগত ভাবে মেয়েদের প্রতি অত্যাচার ও বঞ্চনার উর্বর ভূমিতে এর সঙ্গে যোগ করেছে শিশুকন্যা-বিবাহ বেড়ে যাওয়া। আমাদের এই রাজ্যে শিশুকন্যা-বিবাহের হার অতি লজ্জাজনক।
স্কুল বন্ধ রাখলেই যে সংক্রমণ আটকে থাকে, এমন কোনও প্রমাণিত তথ্য কারও কাছে নেই। তা সত্ত্বেও, এ ব্যাপারে যদি কিছু সাফল্য কল্পনাও করে নেওয়া হয়, তা হলেও কি সেই লাভ সংক্রমণ আটকে রাখার নামে ঘটে যাওয়া বিপুল ক্ষতিকে ‘তুচ্ছ’ করে দিতে পারে? বিশ্বের তামাম রোগ-বিশারদ, সংক্রমণ-বিশারদ, স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞ মোটামুটি একমত যে, একেবারে গোড়ার কাজটা হচ্ছে শিশুদের অনতিবিলম্বে স্কুলে ফিরিয়ে আনা। শুধু ফিরিয়ে আনলেই চলবে না, পাশাপাশি চাই প্রয়োগসম্ভব পরিকল্পনা, যাতে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে তাদের শিক্ষাগত, মানসিক, দৈহিক, এবং আবেগজনিত ঘাটতিগুলো মেটানো যায়। এমনকি, আমাদের দেশেও যাঁরা ২০২০-র মার্চ মাসে ‘লকডাউন, লকডাউন, লকডাউন’ বলে কানফাটানো চিৎকার করছিলেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ স্কুল খোলার পক্ষে সরব হচ্ছেন। সুখের কথা, পৃথিবীর পথে হেঁটে ভারতের বেশির ভাগ রাজ্য সরকার স্কুল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অন্যতম ব্যতিক্রম, আমাদের এই রাজ্য। যে শ্লথতায় উঁচু ক্লাসগুলো চালু করা হয়েছিল, তার বহু গুণ বেগে সেগুলো ফের বন্ধ করে দেওয়া হল। প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক এবং উচ্চ-প্রাথমিক নিয়ে প্রকৃতপক্ষে কিছু ভাবাই হয়নি। লেখার শুরুতে বলেছি, স্কুল-প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়াটা দিনের জায়গায় মাসে গুনতে হচ্ছে বলে রাষ্ট্রপুঞ্জ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। আমাদের রাজ্যে আর মাসেও কুলোচ্ছে না, বছরের হিসাব কষতে হচ্ছে। অথচ শিক্ষা-পরিচালকরা যে উদ্বিগ্ন, এমন কোনও বার্তা রাজ্যবাসী পাননি। বরং, উল্টোটা হয়ে চলেছে। শিক্ষা দফতর আমাদের অভয় দিয়ে চলেছে, “উদ্বেগের কোনও কারণ নেই।” যে-রাজ্যে শেষতম জনগণনার হিসাব অনুযায়ী এক-চতুর্থাংশ লোক নিরক্ষর, যে রাজ্যে সব শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসার সর্বাধিক জরুরি কাজটা করতে লেগে গিয়েছে সাত দশক, যে রাজ্যের স্কুল-শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে পাওয়া শিক্ষার গুণমান আতঙ্কিত করে, যে রাজ্যে তিন-চতুর্থাংশ শিশুকেই প্রাইভেট টিউশনের উপর নির্ভর করতে হয়, যে রাজ্যে তীব্র সামাজিক বিভাজনের প্রতিফলনে শিক্ষাক্ষেত্রটি বৈষম্যের ফাঁসে আটকে থাকে, সেই রাজ্যে প্রায় দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকার পরেও মানুষের উদ্বেগের কারণ থাকবে না? শিশুদের দু’বছরের ক্ষতি রাতারাতি পূরণ হয়ে যাবে কোন মন্ত্রে? দু’বছরের ক্ষতি যে সত্তর বছর ধরে বিন্দু বিন্দু অর্জনটিকেও বিনষ্ট করতে উদ্যত, সেই বিপদকে রোধ করবে কে?
২০২০-র মার্চের পর হতচকিত অবস্থাটা কেটে যাওয়ার পর পরই রাজ্যের নানা জায়গায় শিশুদের পাড়ায় পাড়ায়, ছোট ছোট দলে বসিয়ে শিক্ষাদানের নানা নজির উঠে এসেছিল। প্রাথমিক শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত শিশুদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে উদ্বিগ্ন মানুষেরা সেই সব উৎসাহ ও কর্মকাণ্ড নিয়ে গবেষণামূলক প্রতিবেদন পেশ করেছেন। কিন্তু দফতর বিশ্বাস করে চলেছিল, উদ্বেগের কিছু নেই: বাচ্চাদের কাছে ‘ওয়ার্কশিট’ পাঠিয়ে, অনলাইনে পড়ানোর ব্যবস্থা করে তাদের শিক্ষার ঘাটতি মিটিয়ে ফেলা যাবে। স্কুলে মিড-ডে মিলের ঘাটতি মিটে যাবে মাসে খানিকটা চাল, আলু, ইত্যাদি বিতরণ করে।
মিটবার কথা ছিল না, তাই সেই ক্ষতি মেটেনি। অবশেষে দফতরও স্বীকার করে নিয়েছে, “সরকার একাংশের স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনলাইন ও তদ্রূপ পদ্ধতিতে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করেছে। অবশ্য, এই সব উদ্যোগ ফলপ্রসূ ভাবে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত চুইয়ে পড়তে পারেনি।” দফতরের আশঙ্কা, “যদি মোকাবেলা না করা হয়, শ্রেণিকক্ষে দীর্ঘ অনুপস্থিতি বাচ্চাদের মনে সামাজিক, বুদ্ধিগত এবং ভবিষ্যৎ মানসিক আচরণের দিক দিয়ে কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।” (‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ প্রকল্পের গাইডলাইন, ২৪ জানুয়ারি, ২০২২) সমস্যটি মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে দফতর ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ নামে একটি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে। উদ্দেশ্য সাধু। বাচ্চাদের যে ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, তার কিছুটা অন্তত এর মধ্যে দিয়ে পূরণ হতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, খোলা মনে, জনসমাজকে প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে এই প্রকল্প সফল করার ডাক দিলে, শিক্ষার যেমন উৎকর্ষ বৃদ্ধি হতে পারে, তেমনই আবার শিক্ষাকে কেন্দ্র করে ভিন্নতর এক জন-সামাজিক উদ্যোগের মুখও খুলে দেওয়া যেতে পারে, যে মুখটিকে আটকে রেখেছে দলীয়-উপদলীয় রাজনীতির পাথরের সুবিপুল চাঙড়।
কিন্তু, যতই সাধু হোক, এবং যে-সম্ভাবনাই থাকুক, স্কুল খোলার কোনও বিকল্প নেই। পাড়ায় শিক্ষালয় বড় জোর নিয়মিত স্কুল-প্রক্রিয়ার পরিপূরক হতে পারে। সারা বিশ্ব এটা মেনে নিয়েছে, কারণ শিক্ষাকে পরম মূল্যবান বলে মনে করা হয়েছে। স্কুল-ব্যবস্থাটা এক দিনে গড়ে ওঠেনি, বহু যুগের অভিজ্ঞতায় তার নির্মাণ। দুর্বিপাকে ভিন্ন পথের সন্ধান করা মানে এই নয় যে, মানবিক জ্ঞানের বিপুল অনুশীলন থেকে পাওয়া পরম ঐশ্বর্যটিকে তালা বন্ধ করে ফেলে রাখা যায়। নানা দেশ নানা চেষ্টা করেছে, কিন্তু সর্বাগ্রে চেষ্টা করেছে স্কুল খুলে দিতে। পশ্চিমবঙ্গ সেই শিক্ষা নেবে না কেন?