তখনও ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা চুক্তি সই হয়নি। সে সময় একটি বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সময় বাংলাদেশের এক মন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে নিয়ে একটি ঘরে ঢুকে পড়লেন আলাদা করে কথা বলতে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই জ্যোতিবাবু বেরিয়ে এলেন, সর্বসমক্ষে বললেন— এই নিয়ে এত গোপনীয়তার কী আছে, দু’পক্ষেরই যাতে স্বার্থ বজায় থাকে, সেটা দেখতে হবে। উনি সব সময় বলতেন, আমরা দেখছি কী করা যায়। ‘জ্যোতিবাবুকে আমরা কখনও পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি হিসাবে ভাবিনি, সব সময় ভারতের প্রতিনিধি ভাবতাম’— গঙ্গা চুক্তি নিয়ে আড্ডায় মনে করালেন বাংলাদেশের এক প্রবীণ বিশেষজ্ঞ, যিনি গঙ্গা চুক্তি রূপায়ণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিলেন। তৎকলীন প্রধানমন্ত্রীরাও তাঁকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন।
উল্টো চিত্র বর্তমান জমানায়। বাংলাদেশের সঙ্গে নদীচুক্তিগুলির ক্ষেত্রে প্রথমে মনমোহন সিংহ সরকার ও বর্তমানের নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাছে ‘যথেষ্ট গুরুত্ব’ না পাওয়াতেই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার বীজ লুকিয়ে আছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নদীগুলিকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রয়োজন এবং অবশ্যই রাজনৈতিক স্বার্থ। কেন্দ্রীয় সরকার যতই বলুক যে, রাজ্যের আধিকারিকের মতামত গ্রহণ করা হয়েছিল গঙ্গা চুক্তি পুনর্নবীকরণ আলোচনা সম্প্রতি শুরু করার আগে, রাজনীতির শেষ বেঞ্চের ছাত্রও জানে যে, মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে এমন আলোচনা গোড়াতে বেলাইন হওয়ারই কথা। কেননা নদী নিয়ে সিদ্ধান্ত ভারতের সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র ও রাজ্যকে একযোগেই নিতে হয়। এমনকি দেশে ফিরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, তিনি নিজেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন। স্পষ্ট ইঙ্গিত— চুক্তির বিষয়ে মমতার সঙ্গে কেন্দ্রের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা শুরু করা উচিত। এই বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার জানে না, এমনটা ভাবা বেশ কঠিন। তবে কি চুক্তিগুলো করার দায় যেন নিজেদের উপর না পড়ে, বরং না-হওয়ার দায়টি যেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উপর বর্তায়— সেটাই মোদী সরকারের স্ট্র্যাটেজি?
গোড়া থেকেই গঙ্গা চুক্তির সঙ্গে রাজনীতি জুড়ে আছে দু’দেশেই। শেখ হাসিনার সঙ্গে যখন দেবগৌড়া ১৯৯৬-এর গঙ্গা চুক্তি করেন, তখন বাংলাদেশের অলিখিত মাপকাঠি ছিল তা যেন কোনও ভাবেই ১৯৭৭-এর বিএনপি-র করা চুক্তির তুলনায় দুর্বল বলে মনে না হয়। দু’টি চুক্তির সময়ই পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকারের উপর তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার বেশ খানিকটা নির্ভরশীল ছিল, যার ফলে চুক্তিতে কলকাতা বন্দর বাঁচাতে অন্তত ৪০০০০ কিউসেক জল ফিডার চ্যানেল দিয়ে আনার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে খানিকটা পিছিয়ে রাখা হয়েছিল। চুক্তিতে ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৮, অর্থাৎ চুক্তি সই হওয়ার প্রায় এক দশক আগে অবধি জলপ্রবাহ হিসাব করে দু’দেশের প্রাপ্য জলের হিসাব করা হয়। কিন্তু আগামী সময়ে জল কম হবে, না বেশি হবে— সে হিসাব তো দূর স্থান, কেন তৎকালীন জলপ্রবাহের হিসাবটুকুও করা হয়নি, সে প্রশ্নের সদুত্তর নেই।
তার উপরে যুক্ত হয়েছে পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কট। গঙ্গার উৎসেই জল কমছে। জলের ব্যবহার কৃষি, শিল্প ও নগরায়ণের জন্য বাড়ছে। অধ্যাপক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের গবেষণা বলছে, বিপুল পরিমাণে মাটির তলার জল তুলে নেওয়ার জন্যও গঙ্গার জল কমছে। ফলে গত দু’-দশকে বহু বার বাংলাদেশ প্রাপ্যের তুলনায় কম জল পেয়েছে। ভারতেও ফরাক্কার গায়ে লাগানো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে কয়েক দিন বন্ধ রাখতে হয়েছিল স্রেফ জলের অভাবে।
আর এখানেই উঠছে গঙ্গা চুক্তির রূপায়ণের ব্যর্থতার কথা। ১৯৭৭ ও ১৯৯৬, দুই চুক্তিতেই ৮ ও ৯ ধারায় বলা ছিল, আগামী দিনে নদীতে জল বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা করার কথা। কিন্তু তা কথার কথাই থেকে গেছে। বস্তুত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে সাম্প্রতিক চিঠিতে অভিযোগ করেছেন যে, ১৯৯৬ সালে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর রাজ্যের মধ্যে গঙ্গার উপর নজরদারি এবং ড্রেজিং-এর জন্য কেন্দ্রের অর্থ বরাদ্দ করার কথা বলা হলেও আজ অবধি সে খাতে কোনও অর্থ আসেনি। গঙ্গাজলের সমস্যার অন্যতম ভরকেন্দ্র উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড হলেও আজ অবধি এ নিয়ে কোনও অন্তর্দেশীয় আলোচনা কেন্দ্র রাজ্যগুলির সঙ্গে করেনি। প্রধানমন্ত্রী ন্যাশনাল গঙ্গা কাউন্সিল নিজের সভাপতিত্বে তৈরি করলেও গত আট বছরে দু’টি মিটিং হয়েছে। সেখানেও বিতর্কিত বিষয়গুলি ব্রাত্যই থেকে গেছে। তিস্তা নিয়ে আলোচনায় একের পর এক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র সমস্যার উৎস হলেও সে কথা ওঠেনি। বার বার গোটা গঙ্গা অববাহিকা নিয়ে সমস্যা সমাধান করার কথা উঠেছে, তবুও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও হেলদোল দেখা যায়নি।
যদি গাঙ্গেয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা করে কেন্দ্র নির্দিষ্ট ভাবে গঙ্গাজল ব্যবহার নীতি ঠিক না করে, বিজ্ঞান বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়কে গুরুত্ব না দেয়; বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শামিল না করে; তবে হয় ১৯৮২-র মতো আবার গঙ্গাচুক্তির পুনর্নবীকরণের প্রস্তাব মুখ থুবড়ে পড়বে, বা একটি দুর্বল চুক্তি হবে, যা দু’দেশের সাধারণ মানুষেরই কাজে আসবে না। আর তার দায় পড়বে ভারতের উপরেই।