English Language

বাজার ধরতে ইংরেজি চাই বলে

ঐতিহাসিক ভাবে ইংরেজি মাধ্যমে আমরা পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান দর্শন রাজনীতির নাগাল পেয়েছিলাম। ইংরেজি আমাদের উপকার ভিন্ন অপকার করেনি।

Advertisement

সেবন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৪৬
Share:

সম্মুখে উপবিষ্ট অভিভাবক বলে যাচ্ছিলেন, বাংলা নিয়ে ভবিষ্যতে করবেটা কী বলুন? পড়ছে তো সায়েন্স। ওর কী কাজে লাগবে? এমতাবস্থায় ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে অষ্টম অবধি তৃতীয় ভাষা, দশম অবধি দ্বিতীয় ভাষা ও একাদশে ইচ্ছুক বিষয় হিসেবে ক্রমে সংখ্যালঘু হয়ে আসা বাংলা ভাষার শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে বিশেষ কিছু উত্তর দেওয়ার থাকে না। বদলে ছাত্রটির চোখে চোখ রাখি। বাধ্যতামূলক নয়, তাই ওর আকাঙ্ক্ষার সম্মতি ছাড়া আমাদের হাতে থাকে আবছা হয়ে আসা এক পেনসিল। দশম অবধি লড়াইটা হিন্দি, সংস্কৃত বা কোথাও কোথাও জার্মান, ফরাসির মতো বিদেশি ভাষার সঙ্গেও। একাদশে যথাক্রমে হিন্দি, ফিজ়িক্যাল এডুকেশন, ইনফরমেশন টেকনোলজির বিকল্প হিসেবে বাংলা থাকে। ফলে ‘অপশনাল’ বাংলা নেওয়ার সময় অভিভাবক বা ছাত্রদের ‘ভালবাসা’র ভরসা ছাড়া গত্যন্তর নেই। অর্থাৎ, ইংরেজি স্কুলে যাঁরা নিজের সন্তানকে বাংলা পড়াতে চান, তাঁরা জীবনধারণের প্রয়োজনে নয়, বাঙালি অস্মিতা আর শ্লাঘার কারণে মাতৃভাষার পাশে দাঁড়ান।

Advertisement

ইংরেজি মাধ্যম নিয়ে বক্রোক্তি করার সময় যে দ্বিচারিতা লক্ষ করি, তাতে কিছু প্রশ্ন জাগে। আমরা যারা বাংলা মাধ্যমের গর্বিত বাঙালি, তারা অভিভাবক হিসেবে কোন ভূমিকা নিয়েছি? বাংলা মাধ্যমের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করাচ্ছেন কেন? এর উত্তরে যে তিক্ত তথ্যগুলি উঠে আসে তার একটি এই— অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়াদের শ্রেণি বিভাজনের সঙ্গে এখন একাত্ম হয়েছে বাংলা মাধ্যম। এই বৈষম্য আগে থাকলেও এমন অসেতুসম্ভব দূরত্ব ছিল না। তা হলে দাঁড়াচ্ছে এই, বাংলা মাধ্যমে যারা রইল, তাদের বেশির ভাগই থাকল অপারগতায়। স্বাচ্ছন্দ্যের সুযোগ পেলেই তারা ঢুকে পড়ছে হঠাৎ গজানো কোনও ইংরেজি মাধ্যমে— এ দৃষ্টান্তও দৃষ্টি এড়াচ্ছে না। বাংলা মাধ্যম স্কুলের বহু অনন্য শিক্ষকও পরিকাঠামোর অভাবে এই ‘দেশছাড়া’দের ধরে রাখতে পারছেন না। অন্য দিকে দীর্ঘ দিনের বাম মনোভাবাপন্ন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি, গৃহপরিচারিকার সন্তানের সঙ্গে এক বিদ্যালয়ে নিজের সন্তানকে পাঠাতে চাইছেন না। ফলে আজ হঠাৎ মাতৃভাষার প্রতি অতি স্পর্শকাতর হয়ে পড়লে আবেগ পুষ্টিলাভ করে, সমস্যার দিশা মেলে না।

বিষয়টি ঠিক ইংরেজি বনাম বাংলা মাধ্যমের তুল্যমূল্য বিচার নয়। তথাকথিত কর্পোরেটের উপযুক্ত হওয়ার জন্য, পেশাগত সাফল্যের জন্য বেসরকারি স্কুলের লোভনীয় মরীচিকায় ছেলেমেয়েদের প্রবেশ করাচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা ঠিক ইংরেজি শেখানোর জন্য পাঠাচ্ছেন, এমন নয়। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার অর্ধেক অর্জন হল, জিন ও পরিবেশবাহিত সব বিচিত্র অভ্যাস পরিত্যাগ পূর্বক নিজেকে জগৎসভায় নিখুঁত ভাবে উপস্থিত করা। সম্ভবত বিতর্কের বিষয়টি এখানেই। ইংরেজি মাধ্যমের সুফল হিসেবে ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর কবিতা বা শশী তারুরের ইংরেজির রসগ্রহণ নয়, আদবকায়দায় সন্তানকে কেতাদুরস্ত করাই অভিভাবকদের প্রাথমিক লক্ষ্য।

Advertisement

ঐতিহাসিক ভাবে ইংরেজি মাধ্যমে আমরা পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান দর্শন রাজনীতির নাগাল পেয়েছিলাম। ইংরেজি আমাদের উপকার ভিন্ন অপকার করেনি। পেশাগত সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করে ছাত্রের পরিশ্রম ও গ্রহণ ক্ষমতার উপর। বাজার অর্থনীতির নিয়ম মেনেই ক্ষমতাশালীর শর্ত হিসেবে ইংরেজি তার প্রভাব বিস্তার করবে এবং চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেই। মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা সম্ভব হচ্ছে না বলে অধিকাংশ অভিভাবক বাচ্চাদের পরিশ্রম লাঘবের জন্য প্রথম থেকে মাধ্যম বদলে দিচ্ছেন। অনায়াসে যা লাভ করা যায়, তা সব সময়ই লক্ষ্যে পৌঁছে দেয় না। ইংরেজি মাধ্যমের সুযোগ পাচ্ছে বলে তারা চার কদম এগিয়ে গেল, মনে করার কোনও কারণ নেই। ইংরেজি মাধ্যমের অনেক শিক্ষকই বাংলা মাধ্যম থেকে এসেছেন। বেশ পরিশ্রম করেই তাঁদের অন্য মাধ্যমে স্বচ্ছন্দ হতে হয়েছে। ফল হয়েছে এই যে, দু’টি ভাষায় সমান দক্ষ হয়েছেন তাঁরা। এই উদাহরণ ছাত্রদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মাধ্যম নয়, উদ্যোগ, সদিচ্ছা ও পরিশ্রম এক ছাত্র থেকে অন্যটিকে আলাদা করে দেয়।

মনে পড়ছে ক’দিন আগের একটি ঘটনা। ঝাঁ-চকচকে পাবলিক স্কুলের বারো ক্লাসের বিদায় অনুষ্ঠান। চতুর্দিকে দশ-বিশ হাজারি শাড়ি, লহেঙ্গা, ঝলমলে কিশোরী মুখে মহার্ঘ ফ্যাশন দুনিয়া। স্কুল সেরা হওয়ার মঞ্চে এদের পাশে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক জনের দিকে চোখ চলে যাবেই। পরনে কটকি প্রিন্টের ব্লাউজ আর সাদা তাঁতের শাড়ি। চশমার আড়ালে যে চোখ তাতে মেধার ঝিলিক। বিচারকের প্রশ্ন এল, তুমি বিচারক হলে কোন নিরিখে নির্বাচন করতে? আঠারো না-পেরোনো সেই কন্যার উত্তর, বাইরের চাকচিক্য নয়, দামি পোশাক নয়, অন্তরের সৌন্দর্য, সততা ও মেধার বিচারে বিচার করতাম।

বাংলা মাধ্যম স্কুলের বহু শিক্ষক উপযুক্ত পরিকাঠামো পেলে এই ‘দেশছাড়া’দের ধরে রাখতে পারবেন অবশ্যই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement