মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে জন্ম। বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর মরাঠি, বংশপরম্পরায় গোয়ার মঙ্গেশি গ্রামের পূজারি ব্রাহ্মণ, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষক এবং নাট্যব্যক্তিত্ব। মা শিবন্তী। জন্মের পরে স্বামী-স্ত্রী মেয়ের নাম রেখেছিলেন হেমা। পরে নাম বদলে রাখা হয় লতা। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড় লতাই।
সুর চেনার প্রাথমিক পর্বের পাঠ সঙ্গীতজ্ঞ বাবার কাছেই। পাঁচ বছর বয়সে দীননাথের নাটকে অভিনয় করেছিলেন। বাড়িতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশ ছিল। কিন্তু হিন্দি ছায়াছবির গানের প্রথম সুপারস্টার কুন্দনলাল সায়গল ছাড়া আর কোনও শিল্পীর গান শোনার অনুমতি ছিল না। লতাও সায়গলের ভক্ত হয়ে পড়েন অচিরে। কিন্তু যে দিন প্রথম রেডিয়ো কেনার সামর্থ্য হল লতার, সে দিনই সায়গলের মৃত্যুসংবাদ পেলেন। লতা রেডিয়ো ফেরত দিয়েছিলেন দোকানে।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে পরিবারে দুর্যোগ ঘনাল। পিতৃহারা হলেন লতা। পাশে পেলেন পারিবারিক বন্ধু এবং নবযুগ চিত্রপট সিনেমা কোম্পানির মালিক বিনায়ক দামোদরকে। তিনিই লতাকে সাহায্য করেন পেশাগত ভাবে গান এবং অভিনয়ে যোগ দিতে। ১৯৪২ সালে লতার কাছে সুযোগ আসে মরাঠি ছবি কিটি হাসাল-এ গান গাওয়ার। কিন্তু গানটি ছবি থেকে বাদ যায়। সেই বছরই বিনায়ক লতাকে তাঁর প্রোডাকশন হাউসের পহেলি মঙ্গলা গৌর মরাঠি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ দেন। ১৯৪৩ সালে লতার গাওয়া প্রথম হিন্দি গানটিও গাজাভাও নামে মরাঠি ছবির। ১৯৪৫ সালে মাস্টার বিনায়কের সংস্থা মুম্বই চলে এলে লতাও সঙ্গে আসেন।
এই বছরই লতা শুরু করেন ভেন্ডিবাজার ঘরানার সঙ্গীতকার উস্তাদ আমানত আলি খানের কাছে হিন্দুস্থানি মার্গসঙ্গীতের তালিম নেওয়া। পাশাপাশি মরাঠি ও হিন্দি ছবিতে প্লে-ব্যাক করে শুরু হল পরিবারের অন্নসংস্থানের লড়াই। বিনায়কের প্রথম হিন্দি ছবিতে লতা এবং তাঁর বোন আশা ছোট ছোট চরিত্রে কাজ করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে বিনায়কের দ্বিতীয় ছবিতে কাজ করতে গিয়ে লতা পরিচিত হন সঙ্গীত পরিচালক বসন্ত দেশাইয়ের সঙ্গে। তার পর দেশভাগ। উস্তাদ আমানত আলি খান চলে যান পাকিস্তানে। এর পরে বেশ কিছু দিন লতা তালিম নেন পণ্ডিত তুলসীদাস শর্মার কাছে।
১৯৪৮ সালে বিনায়কের মৃত্যু আবারও লতাকে অভিভাবকহীন করে দেয়। কিন্তু তত দিনে হিন্দি ছবির জগতে পা রেখেছেন লতা। পরবর্তী সময়ে সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার বড় ভূমিকা নিলেন লতার জীবনে। ১৯৪৮ সালে মজবুর ছবিতে তাঁরই সুরে ‘দিল মেরা তোড়া’ বলিউডে প্রথম পরিচিতি দিল লতা মঙ্গেশকরকে। ১৯৪৯ সালে কর্মচন্দ প্রকাশের মহল ছবিতে লতার গাওয়া ‘আয়েগা আনেওয়ালা’য় ভাসল উপমহাদেশ।
এর পর বাকি ইতিহাস। পঞ্চাশের দশকে অনিল বিশ্বাস, শঙ্কর-জয়কিষণ, শচীন দেব বর্মণ, নৌশাদ আলি, সি রামচন্দ্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন, কল্যাণজি-আনন্দজি, সলিল চৌধুরীর মতো সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে যুগান্তকারী কাজ। ষাটের দশকেও জয়যাত্রা অব্যাহত। ১৯৬০ সালে মুঘল-এ-আজ়ম সিনেমায় মধুবালার ঠোঁটে লতার ‘প্যায়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’ নয়া ইতিহাস তৈরি করল।
সত্তরের দশকে যে সব গানকে লতাকণ্ঠ স্মরণীয় করে গিয়েছে, তার অধিকাংশই লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল এবং রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গে। রাহুল দেব বর্মণের সুর করা প্রথম ও শেষ, দু’টি ছবির গানেই রয়েছে লতার কণ্ঠ।
নব্বইয়ের দশকেও লতা পূর্ণপ্রভায় উপস্থিত। কাজ করেছেন আনন্দ-মিলিন্দ, যতীন-ললিত, অনু মালিক, উত্তর সিংহ থেকে এ আর রহমানের মতো সুরকারের সঙ্গে। এর পরেও লতা প্লে-ব্যাক করেছেন, কনসার্টে গান গেয়ে গিয়েছেন বয়সজনিত অসুস্থতা উপেক্ষা করেই। ২০১২ সালে নিজের সংস্থা থেকে প্রকাশ করেন ভজনের অ্যালবাম, যেখানে তাঁর সঙ্গে গেয়েছেন বোন উষা মঙ্গেশকর। গান গাওয়ার পাশাপাশি কিছু ছবিতে সঙ্গীত পরিচালকের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হন লতা। প্রথম কাজ ১৯৫৫ সালে, মরাঠি ছবি রাম রাম পবহন। প্রযোজনাও করেছেন কিছু ছবির।
জীবনে বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। পেয়েছেন ‘ভারতরত্ন’, দাদাসাহেব ফালকে সম্মান, ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান লেজিয়ঁ দ’নর পুরস্কার। এ ছাড়া রয়েছে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসাবে তিন বার জাতীয় পুরস্কার। ১৯৯৯ সালে লতা রাজ্যসভার সদস্য মনোনীত হন। তিনিই প্রথম ভারতীয় শিল্পী, যিনি রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে কনসার্ট করেছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে গিনেস বুক অব রেকর্ডসে লতা ছিলেন সর্বোচ্চ স্থানে। ছত্রিশটি ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন।
লতার বাংলা গানের সংখ্যা দু’শো ছুঁইছুঁই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, ভূপেন হাজরিকা, সুধীন দাশগুপ্ত, কিশোরকুমার প্রমুখের সুরে। তাঁকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করিয়েছিলেন হেমন্ত।
১৯৬২ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন লতা। অভিযোগ ওঠে বিষ প্রয়োগের। রাঁধুনির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও রাঁধুনি নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পরে বিষয়টি রহস্যই রয়ে গিয়েছে।
জীবনে মাত্র এক দিনের জন্য স্কুলে গিয়েছিলেন লতা। শোনা যায়, সেখানে বোন আশাকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি না মেলায় নাকি আর স্কুলমুখো হননি জীবনে। পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলেন বাড়িতেই। প্রথম দিকে লতার গায়কিতে সে সময়ের কিংবদন্তি শিল্পী নুরজাহানের ছাপ ছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই লতা স্বকীয়তা তৈরি করে নিলেন। সেই সময়ের বেশির ভাগ হিন্দি গানে উর্দুর বাহুল্য দেখা যেত। লতা উর্দুতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। তাঁর উচ্চারণে মরাঠি-আবেশ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য শুনে গৃহশিক্ষক রেখে উর্দু শেখা শুরু করেন লতা। বিশ্বের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে উপমহাদেশের এই কিন্নরকণ্ঠীকে।
তাঁর কণ্ঠের মাধুর্যে বুঁদ হয়েছে উপমহাদেশ। তাঁর দৃপ্ত তপস্বী ভঙ্গির আকর্ষণ আচ্ছন্ন করেছে শ্রুতি। কেউ কেউ এমনও ভেবেছেন, তাঁর কণ্ঠ আসলে ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের সেতুমাধ্যম।