83

দেশপ্রেমের সন্ধান, আলোছায়ায়

কেমন সন্দেহ জাগে, দেশপ্রেম? না কি অন্য কোনও প্রেম? কিসের জন্য আজকের রাজপুত্ররা খেলেন?

Advertisement

চৈতালী চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:২২
Share:

৮৩-র সেই ম্যাচটা দেখেছিলাম। দিদি-জামাইবাবু, ছোড়দা, বড়দা সবাই এসে জড়ো হয়েছিল সে দিন বাড়িতে। মা মাংস দিয়ে ভুনিখিচুড়ি রেঁধেছিল। দেশ বিশ্বকাপ খেলবে, সেটা সপরিবার উদ্‌যাপন করা হবে, সংসারে এমন চিন্তাভাবনাই স্বাভাবিক ছিল তখন। আর জেতার পর? ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে পথে নেমে পড়েছিল। ছাদে ছাদে কাঁসর-ঘণ্টা বাজছিল। দেশ জিতেছে, কী আনন্দ সকলের। তার পর গঙ্গা, টেমস দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি বড় স্ক্রিনে দেখলাম ৮৩ (ছবিতে একটি দৃশ্য)। বেশ উপভোগ্য নির্মাণকুশলতা, অভিনয়। ধরনটা বায়োপিকের। মূল চরিত্রগুলোর সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্যতাও তারিফ পাওয়ার মতো।

Advertisement

আমার আচ্ছন্নতা কাটছে না। সিনেমা দেখতে বসে চোখ কাঁদোকাঁদো, হয়তো বয়সের কারণে। হয়তো বা আরও অন্য কিছু মনের মধ্যে খোঁচা মারছে, তাই। ইন্ডিয়ান টিম, ইন্ডিয়া! যে দেশাত্মবোধ আঁকড়ে মরিয়া হয়ে খেলে একটা দেশ। শুধু মাতৃভূমির মুখে আলো ঢেলে দেবে বলে। দেশের পতাকাকে স্বমহিমায় উড়তে দেবে বলে।

কিন্তু আমরা যারা সিনেমাটি দেখছিলাম, সংশয় জাগে, এই আমরাই তো সিনেমার প্রথমে জাতীয় সঙ্গীতের সময় ‘ওই এক নতুন সার্কাস শুরু হল’ বলে ব্যঙ্গের হাসি দিই। জাতীয় সঙ্গীতের তালে পা নাচাই। ঠিক, জাতীয় সঙ্গীত বাধ্যতামূলক ভাবে শোনালে রাগ হবেই। এ হল এক দিকের কথা। আর, জাতীয় সঙ্গীত আবার কী, যত সব বোকা বোকা! এ হল আর এক দিকের কথা।

Advertisement

সিনেমার দৃশ্যাবলি পর পর স্লাইড সাজিয়ে যায় মনের মধ্যে। সেই সময়ে, আজকের তুলনায়, অার্থিক কষ্টে দিন কাটত অনেক ক্রিকেটারেরই। আক্ষেপ করতেন, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের ভাল পাত্রী জোটে। কিন্তু তাঁদের দিনের পর দিন ডিম পাউরুটি ঘুগনি কিংবা ছিটেফোঁটা চিকেন স্টু খেয়ে নেট প্র্যাকটিস করতে হয়। তার পর দাঁতে দাঁত চেপে দেশের জন্য খেলতে হয়। এখনকার দিন অন্য রকম। ক্রিকেট মানেই গ্ল্যামার। সেই একই দেশ, একই ক্রিকেট। কিন্তু এখন যাঁরা খেলেন, তাঁরা অধিকাংশই স্বপ্নের রাজপুত্র। খেলতে শিখেই বিদেশি টিমের হয়ে খেলে প্রচুর টাকা উপার্জন। কেমন সন্দেহ জাগে, দেশপ্রেম? না কি অন্য কোনও প্রেম? কিসের জন্য আজকের রাজপুত্ররা খেলেন?

কেবল খেলোয়াড়রা কেন, যাঁরা খেলা দেখেন, তাঁরাই বা কী ভাবেন? তাঁদের অনেকেই এই দেশে থেকেও মনে মনে অন্য দেশের বাসিন্দা। এঁদের জন্য আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা বোকা বোকা, ইংরেজি না বললে ‘পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়’। দেশের সাধারণ তথ্যও তাঁরা জানেন না, বিদেশের অ-সাধারণ খবরগুলিও রাখেন।

শিক্ষার জন্য জগৎ পাড়ি দেওয়া নতুন কথা নয়, মন্দ কথাও নয়। কিন্তু তাই বলে যে পরিমাণ ছেলেমেয়ে আজ প্রথম সুযোগেই দেশ ছেড়ে পিঠটান দেওয়ার সুখস্বপ্ন দেখে বড় হয়, এবং তাদের বাবা-মারাও বড় হন, সেটা একটু ভাবায় না কি? উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি-দেওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২০১৬-তে ছিল ৪৪০,০০০। ২০১৯-এ সেই সংখ্যা ৭৭০,০০০। ২০২৪-এ নাকি লাফ দিয়ে তা দাঁড়াতে পারে ১৮ লক্ষের কাছাকাছি! লেখাপড়া শিখে, দেশের মুখ উজ্জ্বল করার স্বপ্নই কি এরা সকলে দেখছে? না কি দেশান্তরি হয়ে নিজের ভবিষ্যৎ সোনা দিয়ে বাঁধাতে চাইছে? ভাবব না একেবারে, এই সব কথা?

বাবা-মায়েরা কেন সাত তাড়াতাড়ি বিদেশে পাঠাতে চান ছেলেমেয়েকে, যারা পরিযায়ী পাখির মতো বছরে এক-আধ বার দেশে উড়ে এসে ক্ষণিকের আবেগ ঝরিয়ে যাবে— এর উত্তরে বলার মতো যে অষ্টোত্তরশত কারণ আছে, জানি। তাও জিজ্ঞেস করেছিলাম দলছুট দু’-এক জনকে। ব্যাঙ্ক ব্যালান্স না বাড়িয়ে, দেশের মাটি কামড়ে ধরে, পেশাকে সেবায় পরিণত করতে চান খ্যাপাটের মতো— এমন এক জনকে প্রশ্ন করেছিলাম, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে আর ফিরে না আসা, কেন এত ঘটে ? তিনিও বেশ আত্মস্থ গলায় জবাব দিলেন, “দেশ ছেড়ে, মাখনের মতো মসৃণ জীবনের আকাঙ্ক্ষায় বিদেশে গিয়ে ঘরবসত বসানোই তো স্বাভাবিক সিস্টেম।”

এই ‘সিস্টেম’-এর মধ্যে যখন ৮৩-র মতো একটা সিনেমা কচুরিপানার অস্বচ্ছ জল কেটে ভেসে ওঠে, হঠাৎ এক পুরনো দেশাত্মবোধের মায়া আচ্ছন্ন করে ফেলে আমাদের। চার পাশে পাঁক সরিয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসি। তাই তো। দেশের জন্য সত্যি কিছু করতে হলে, পরবর্তী প্রজন্মকে দেশমুখী করতে হলে যা কিছু প্রয়োজন, ‌তার জন্য কোনও আলাদিনের প্রদীপের অপেক্ষাতেই কি বসে থাকব আমরা?

আমাদের বহুতলের বারান্দা দিয়ে সামনের বস্তি অঞ্চলের ঘরগুলির ভিতর অবধি প্রকট হয়ে ওঠে। এক বার ১৫ অগস্টের আগে তেমনই একটা ঘরে দেখেছিলাম, আলোছায়াময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আট-নয় বছরের বালক রুলটানা খাতার পাতা ছিঁড়ে, আধভাঙা রং পেনসিল টেনে টেনে পরম আনন্দে তৈরি করছে জাতীয় পতাকা। কী যেন ছিল দৃশ্যটায়। চোখ চিকচিক করে উঠেছিল, আজও মনে পড়ে।

৮৩ দেখে হল থেকে বেরিয়ে তেমনই চিকচিকিয়ে উঠল চোখ। চোখে চিপসের মশলা লাগল? না কি একটা ঘোর?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement