পুতিনের রাশিয়া কেন ইউক্রেন আক্রমণ করল তার গোটা দশেক কারণ দর্শাচ্ছেন পণ্ডিতেরা। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির নেটো-তে ঢোকার আবেদন। ১৯৪৯ সালে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন যখন গঠিত হয়, ১২টি দেশ এর সদস্য, এর মধ্যে আমেরিকা, ব্রিটেন আর ফ্রান্স সবচেয়ে শক্তিশালী। ১৯৯১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর, ২০০৪ সালে অতীতের সোভিয়েট ইউনিয়নে থাকা ৭টি রাষ্ট্র এর আওতায় আসে। ক্রমশ এ ভাবে আমেরিকার প্রভাব বাড়তে থাকে পূর্ব ইউরোপে, রাশিয়ার কব্জা আলগা হয়। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো ২০০৮ সালে জ়েলেনস্কির নেটো-তে ঢোকার আবেদন পুতিনকে খেপিয়ে তোলে। ২০১৪ সালেও রাশিয়া বিদ্রোহীদের সাহায্য করার নামে ইউক্রেনকে আক্রমণ করে বসেছিল। সেই সময়েই পূর্ব ইউক্রেনের বিস্তৃত অংশ রাশিয়া দখল করে। দখল করে ক্রাইমিয়া-ও। ১৪০০০ মানুষ মারা যাওয়ার পর, মিনস্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, কাজের কাজ কিছু হয়নি।
এই আক্রমণের নেপথ্যে খেলে বেড়াচ্ছে আশপাশের দেশগুলিকে রুশীকরণের যুক্তি। পুতিনের রাশিয়ার মতে বিভিন্ন জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার একটা ব্যাধি, যা রুশ আত্মমর্যাদাকে আঘাত করে। সনাতন রুশ সাম্রাজ্যের ‘গৌরব’ ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী পুতিনের মতে এই সোভিয়েটের ইউক্রেন আসলে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ইউক্রেন। তাঁর মতে, লেনিন-স্তালিনের সোভিয়েট নীতি, যা বিভিন্ন জাতিসত্তাকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিয়েছিল, তা আসলে রুশদের আত্মমর্যাদায় আঘাত। ডনবাস অঞ্চলকে ইউক্রেনের অঙ্গীভূত করাটা সোভিয়েট নীতির ভুল।
ফিরে তাকালে দেখা যাবে, প্রতিবেশী জাতিসত্তাগুলিকে রুশীকরণের উদ্যোগ জ়ারের সময় থেকেই প্রবহমান। জ়ারের পতন হলেও ১৯২১ সালের মার্চে বন্দর-শহর কনস্টাড্ট বিদ্রোহের সময় বলশেভিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে গেল: জ়ার যে ভাবে দমন করতেন সাধারণ মানুষকে, যে ভাবে চলত সব কিছু রুশীকরণের চেষ্টা, বলশেভিকরাও তা-ই করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের জার্মানি ইউক্রেন দিয়ে রাশিয়ায় ঢোকে। প্রায় আড়াই বৎসরকাল জার্মানির কব্জায় ছিল ইউক্রেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য যতই লিখুন, ‘তোমার ভাণ্ডার ভরে দেবে জানি নতুন ইউক্রেন’, তখন থেকেই ইউক্রেন সম্পর্কে একটি হালকা অবিশ্বাস ছিল রুশ শাসকদের, নির্ঘাত ওই অঞ্চলে নব্য নাৎসিদের গুপ্ত ঘাঁটি আছে। বস্তুত, সোভিয়েট ইউনিয়নের সীমানার মধ্যে এবং প্রতিবেশী দেশের সব কিছুকে রাশিয়ার মতো করার উৎসাহে বহু জনগোষ্ঠীর জীবন, বহু জাতির সংস্কৃতিকে এলোমেলো করে দিয়েছে রুশ শাসকেরা। কোনও অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমানা বিস্তৃত করেছে, কোনও অঞ্চলকে ছোট করেছে।
২০-২১ অগস্ট ১৯৬৮, দখল করার উদ্দেশ্যে চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করে বসল সোভিয়েট ইউনিয়ন। কেন? পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়ন তাদের প্রভাবের বৃত্ত মনে করত, এবং তা অক্ষুণ্ণ রাখতে জার্মানি, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়ার মতো তাঁবেদার রাষ্ট্রের সহযোগে যথাযথ ব্যবস্থা করত। তাদের প্রভাব (কারও কারও মতে নয়া ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন) জারি রাখতে সোভিয়েট ইউনিয়ন ‘সোভিয়েট ইউনিয়ন কাউন্সিল অব মিউচুয়াল ইকনমিক এড’ বা ‘কমেকন’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন তৈরি করে; এরই পাশাপাশি ছিল ওয়ারশ চুক্তি। এর মাধ্যমে ওই দেশগুলির উপর সামরিক আধিপত্য বজায় রাখত রাশিয়া। কব্জা করা যায়নি আমেরিকা ঘেঁষা যুগোস্লাভিয়াকে, বা মাওপন্থী আলবেনিয়াকে।
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে সোভিয়েট ইউনিয়নের দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। ১৯৬৮-তে সোভিয়েটপন্থী নোভোতনি চক্রকে সরিয়ে চেকোস্লোভাকিয়ার ক্ষমতায় আসে আমেরিকার অনুসারী দুবচেক চক্র, কমেকন-এর বিরুদ্ধে আঙুল তোলে, আমেরিকার ঋণ নিতে আগ্রহী হয়ে পড়ে। রুষ্ট সোভিয়েট ইউনিয়ন চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করে। দুবচেক সরকার প্রতিরোধ গড়তে পারেনি, অবশ্য প্রতিরোধ করেছিলেন ছাত্র ও শ্রমজীবীরা।
আজ ইউক্রেন আক্রমণ করতে যে-যে যুক্তির অবতারণা করা হচ্ছে, সে দিনও চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করতে তা-ই বলা হয়েছিল। সে দিন ভারতের কমিউনিস্টদের অনেকেই বিশ্বাস করতেন সোভিয়েট ইউনিয়ন, আমেরিকার মতো অন্য দেশে দখলদারি করবে না; নিশ্চয় আমেরিকা চক্রান্তমূলক কাজ করছে ওই দেশে, সেখানে কমিউনিস্টদের সাহায্য করতেই এই আক্রমণ! এই ঘটনাতেই চারু মজুমদারদের সঙ্গে বিরোধ হয় পরিমল দাশগুপ্তের। চিনের কমিউনিস্টরা সোভিয়েট ইউনিয়নকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী বলা শুরু করে— কথায় সমাজতন্ত্রের সমর্থক কিন্তু কাজ সাম্রাজ্যবাদীদের মতো। একই যুক্তিতে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৯ আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে সোভিয়েট ইউনিয়ন।
পুতিন এ বার ইউক্রেন আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি যে যুক্তির স্রোত বইয়ে দিয়েছেন তার মধ্যে একটি চতুর স্লোগান হল, ‘নব্য নাৎসিদের হটাও’। নাৎসি শব্দটি সারা বিশ্বে এখনও এতটাই ঘৃণ্য যে, তার বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের লড়াই, কমিউনিস্ট-সহ সংখ্যাগরিষ্ঠের মান্যতা পেয়ে যায়। পুতিন ভেবেছেন, এমন করলে তাঁর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম যে দল সেই কমিউনিস্ট পার্টিও তাঁকে সমর্থন করবে, সমর্থন করবে পৃথিবীর সম্পূর্ণ নাৎসি-বিরোধী শক্তি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের বড় কমিউনিস্ট পার্টি দু’টির অবস্থা বেশ মজার। দুই পার্টির কেউই রাশিয়ার দিকে আঙুল তোলেনি, কেউই বলেনি রাশিয়া সাম্রাজ্যবাদী দেশের মতো আচরণ করছে। কোনও ভুল বোঝাবুঝি থাকলে, যুদ্ধ বন্ধ করে তা আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়ার গোল্লা-গোল্লা পরামর্শ দিয়েছে তারা। সিপিআই (এমএল) লিবারেশনও যুদ্ধ থামিয়ে মিনস্ক-২ চুক্তি অনুসরণ করে সমস্যা মেটানোর পরামর্শ দিয়েছে, একই সঙ্গে আমেরিকা ও নেটো-র প্রভাব বৃদ্ধির বিরোধিতাও করেছে তারা। এরা কেউই রাশিয়াকে ফ্যাসিস্ট বলেনি, যেমন বলেছেন সেই রুশ সেনা, যিনি তাঁর মাকে শেষ চিঠিতে লিখেেছন: “ইউক্রেনে আছি, ওরা আমাদের ফ্যাসিস্ট বলে। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে ইচ্ছে করছে।... সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করছি।”
১৯৬৮-তে চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণের কয়েক মাস পরেই চিনের সীমান্ত আক্রমণ করে সোভিয়েট ইউনিয়ন। ১৫ মার্চ ১৯৬৯ সালে যুদ্ধবাজ সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘ মিছিল বেরোয় কলকাতায়। মনুমেন্ট ময়দান থেকে বেরোনো, নকশালপন্থীদের লালসালুর সেই মিছিল, পার্ক স্ট্রিট হয়ে পৌঁছয় উড স্ট্রিটের রুশ দূতাবাসে।
আজ আর সেই কলকাতাও নেই, সেই মিছিলও নেই!