তিনি ‘আমাদেরই লোক’!
Netaji Subhas Chandra Bose

নেতাজির উত্তরাধিকার ভোট-রাজনীতির তেলে সাঁতলে নিতে হয়

দেশভাগের মাত্র ছয় মাস আগে আজাদ হিন্দ ফৌজের যে সংগ্রামী উত্তরাধিকার হিন্দু-মুসলমান-শিখকে একত্র করতে পেরেছিল, তাকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা কম হয়নি।

Advertisement

অনিকেত দে

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:১৪
Share:

বিপ্লবী: নেতাজি সুভাষচন্দ্র এবং তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতারা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

নেতাজির স্মৃতি যে রক্ষা করা হয়েছে, তা নিয়ে আজ আর কোনও প্রশ্ন নেই। তাঁর জন্মদিনে গুন্ডা-বদমায়েশরা নেতাজি ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ভক্তিভরে স্লোগান দিয়েছেন, কোটি কোটি টাকা দিয়ে সরকারি কমিটি হয়েছে, মায় তাঁকে সম্মান জানানোর জন্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছাদও তাঁর ছবিতে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। এমন মোচ্ছবের পর তো আর কিছু বলার থাকে না, কেবল মাঝে মাঝে, ভয়ে ভয়ে, মনে হয় একটু বিরাম, একটু বিশ্রাম হলে মন্দ হত না। অন্তত ভেবে দেখা যেত যে, দেশের আইনে দেশদ্রোহের সাজা এত কড়া, যেখানে স্বাধীনচেতা নাগরিককে পদে পদে হেনস্থা হতে হয়, সেখানে সরকারি ছকের বাইরে সুভাষচন্দ্রের বিদ্রোহের ইতিহাস কিসের ইঙ্গিত দেয়।

Advertisement

যুদ্ধশেষের পর নেতাজি ইংরেজের হাত ফস্কে চিরতরে চলে যান, কিন্তু গ্রেফতার হন তাঁর তিন সেনানী গুরবক্স সিং ধিলোঁ, শাহ নওয়াজ় খান, এবং প্রেম কুমার সহগল, তাঁদের নামে রাজদ্রোহের মামলা করে লাল কেল্লার এক ব্যারাকে বিচার শুরু হয়। সাহেবরা বিচার নিয়ে যে এত জলঘোলা হবে তা ভাবেইনি, চুপচাপ ফাঁসি বা দ্বীপান্তর একটা কিছু দিয়ে দেওয়া যাবে, দু’শো বছরে অমন বিচার করে করে তারা বেশ দড় হয়ে উঠেছে। সুভাষচন্দ্রকে ধরলে ওই আইনেই তাঁর বিচার হত, এবং আজও ওই আইনেরই বিভিন্ন উত্তরসূরির ভিত্তিতে অগুনতি সমাজকর্মী-রাজনীতিবিদকে জেলে পোরা হয়। ইংরেজি কাগজগুলো তখনও ব্যঙ্গ করে কোটেশন মার্কে ‘আইএনএ’ লিখত: পলাতক সিপাইদের ওটা নাকি আবার একটা বাহিনী, তার আবার বিচার! আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রধান উকিল ভুলাভাই দেশাই (এবং, অবশ্যই নেহরু) বেশ জানতেন যে এই বিচার প্রহসনমাত্র, ইংরেজের কোনও আইনের সাহায্যেই এঁদের বাঁচানো সম্ভব নয়।

ভুলাভাই প্রখর আইনজ্ঞ, তিনি ইংরেজের আইনের ধারপাশ দিয়েই গেলেন না। সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, যদি স্বাধীন দেশ আত্মরক্ষার্থে আক্রমণকারীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে, পরাধীন জাতির কেন নিজের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের অধিকার থাকবে না? তা হলে তো হিটলারের দখল করা ইউরোপের দেশগুলির নাৎসি-বিরোধী সংগ্রামকেও বেআইনি বলতে হয়। তখনও আন্তর্জাতিক বিধি ততটা তৈরি হয়নি, এমন সওয়ালে ভুলাভাই পথিকৃৎ, তিনি স্বাধীন দেশের সংজ্ঞা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিলেন। আজাদ হিন্দ সরকার জাপানের পুতুল সরকার নয়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র তাকে বহু বার স্বাধীন ভারতের সরকার হিসাবে ঘোষণা করেছেন, অতএব তার সংগ্রামের অধিকার আছে, একে নিছক রাজদ্রোহ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কারণ ইংরেজের আইন-ই আমরা মানি না, তার ভিত্তিতে আর এক স্বাধীন দেশের বিচার হতে পারে না।

Advertisement

ইংরেজ বিচারকরা ভুলাভাইয়ের যুক্তি ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু তাঁর আপসহীন বক্তব্যের দৃঢ়তায় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের প্রকৃত বিদ্রোহী আদর্শের ছোঁয়া দেখা যায়। পরে দিলীপকুমার রায়কে ভুলাভাই বলেন, যে মামলা শুরুর আগে তিনি সুভাষচন্দ্রের প্রবাস-জীবন নিয়ে বেশি কিছু জানতেন না, নথিপত্র দেখতে দেখতে পুরো ঘটনাটা তাঁর চোখে ভেসে আসে, নেতাজির সংগ্রামের রীতিমতো অনুরাগী হয়ে ওঠেন, এমন দুঃসাহসী সওয়াল করার সাহস পান। সে দিন ইংরেজের বিচারশালায় তাঁর হার হলেও, এই আজাদ হিন্দ মামলার জেরেই গোটা দেশের সামনে প্রথম বারের জন্য আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্বের ইতিহাস প্রকাশ পায়। অজস্র মিছিলে, পথসভায়, শোভাযাত্রায় ভুলাভাইয়ের যুক্তিটি ঘুরে ফিরে আসে। বিচার শুরুর দিনেই, শ্রদ্ধানন্দ পার্কের মহাসভায়, প্রশ্ন তোলেন অবিভক্ত বাংলার স্পিকার সৈয়দ নৌশের আলি: চার্চিল বলেছিলেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজ হারলেও আমেরিকা বা অন্য কোথাও থেকে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; সে কথা যদি ‘দেশপ্রেমের পরিচায়ক’ হয়, “তবে আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যাবলিও শাস্তির যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে কি না বলা কঠিন।”

সেই বিপ্লবী মুহূর্তের সবচেয়ে বড় দান— পরাধীন থাকা সত্ত্বেও এক জাতি কী ভাবে দৃঢ় ভাবে নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। এই মামলার পরে নিউ ইয়র্ক টাইমস নেতাজিকে ভারতের জর্জ ওয়াশিংটন বলে অভিহিত করে। যখন কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ দুই-ই সাহেবের সঙ্গে দর কষাকষি করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত, তখন নেতাজি ইংরেজ শাসনের ভিত্তি নিয়েই প্রশ্ন তুলে বসেন: আমাদের স্বাধীনতার জন্য ওদের দাক্ষিণ্য দরকার নেই। আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাপত্রে তিনি স্পষ্ট বলেন, আজাদ হিন্দ ফৌজের পূর্বসূরি সিরাজ-উদ-দৌল্লা, মোহনলাল, পেশোয়া বাজিরাও, হায়দর আলি, টিপু সুলতান, যাঁরা নিজেদের জোরে আক্রমণকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন— বিদেশির আইনের তোয়াক্কা না করে, নিজেদের জোরে।

নাগরিকের এই সংগ্রামের অধিকার নেতাজির প্রকৃত সৎ বিপ্লবী উত্তরাধিকার। কিন্তু আজকের ভারত রাষ্ট্র তা সামলাতে পারবে তো? ভারতের সংবিধান ভুলাভাই যাকে বলেছিলেন ‘সংগ্রামের অধিকার’, তাকে এই ভারত স্বীকার না করে বরং উল্টে যে সমস্ত ব্রিটিশ আইনে দেশদ্রোহের সাজা হয়েছিল, তাকে মহাসমারোহে বলবৎ রেখেছে। রাষ্ট্রের দ্বারা নিপীড়িত ভারতের জনগোষ্ঠীগুলি যখনই নিজেদের জাতিসত্তার কথা বলেছে, বা সহ্যের সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে অস্ত্র তুলে নিয়েছে, সরকারের পর সরকার তাদের বলেছে জঙ্গি, বিচ্ছিন্নতাবাদী, রাষ্ট্রদ্রোহী, বিদেশি শক্তির মদতে পুষ্ট শয়তান— ঠিক যে ভাষায় ইংরেজরা নেতাজি আর আজাদ হিন্দ ফৌজের কথা বলত। এক দিন মুক্তিযোদ্ধারা নেতাজির আদর্শ বুকে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, এখন যদি ভারতেরও সৈন্যবল দিয়ে দমিয়ে রাখা জনগোষ্ঠীরা বলে আমাদেরও পরাধীন করে রাখা হয়েছে, তাই সংগ্রামের অধিকার আমাদেরও আছে, অতএব, তা হলে তো ভারী চিন্তার ব্যাপার। তাই হয়তো তাঁর প্রকৃত বিপ্লবী আদর্শটা লুকিয়ে রেখে নানা রকম গুজব ভড়ং উৎসব ইত্যাদি দিয়ে আগেই সরকারি ভাবে নেতাজিকে বরণ করে নেওয়া, ‘আমাদের লোক’ বলে দেখানোর এই ব্যস্ততা!

আজকের ভারত-রাষ্ট্রের প্রতি প্রেম এবং নেতাজি-প্রেম দেখানো খানিকটা দ্বিচারিতা— সব রঙের রাজনীতিতেই। দেশভাগ-উত্তর এই রাষ্ট্র ব্রিটিশ শাসকের রাষ্ট্রের উত্তরসূরি— ঠিক যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ছিল সুভাষ-সহ সমস্ত বিপ্লবীর সংগ্রাম, ভারতের মানুষের মিলিত শক্তির ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। ব্রিটিশের রাষ্ট্রযুক্তি না মানলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দেশভাগ হয় না, সুভাষ তাই বার বার ইঙ্গিত করেছেন মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহর দিকে, ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময় যার নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল হিন্দু-মুসলমান দুই-ই। নেতাজির চোখে সেই ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা শেষ করবে তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ। জাপানিরা বর্মা দখলের পর নেতাজি বর্মার দেশনায়ক বা ম’র সঙ্গে রেঙ্গুনে বাহাদুর শাহর সমাধি দর্শন করে মনে করিয়ে দেন হিন্দু-মুসলমানের মিলিত শক্তিতেই মহাবিদ্রোহ হয়েছিল। তাঁর বিপ্লবী দৃষ্টিতে সেই ছিল আদর্শ।

নেতাজি দিল্লি পৌঁছতে পারেননি, কিন্তু লাল কেল্লায় যে ব্যারাকে তাঁর তিন সেনানীর বিচার হল, তার বারান্দা থেকে পুব দিকে তাকালেই দেখা যায় সম্রাট শাহজাহানের দেওয়ান-ই-খাস, যেখানে মহাবিদ্রোহের পর আর এক শীতের ভোরে বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহকে তড়িঘড়ি রাজদ্রোহী ঘোষণা করে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয়। সেই বিচারে আইনের হিসাব খানিক গোলমাল হয়ে যায়, কে রাজা আর কে প্রজা সেটাই তো স্পষ্ট নয়, কারণ সে দিনের বেনিয়া ইংরেজ খাতায় কলমে তখনও রাজদণ্ড নেয়নি, স্বয়ং মোগল সম্রাটকে কী করে তাঁর নিজেরই রাজত্বে রাজদ্রোহে দায়ী করে! সে দিন তারা গায়ের জোরে জিতে যায়, কিন্তু প্রায় নব্বই বছর পর, আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের সময় ফিরে আসে সেই স্মৃতি। শুরু হয় গুজগুজ ফিসফাস, লাল কেল্লার বিচারে আবার কি ‘নূতনতর সম্ভাবনা’ তৈরি হবে! স্বয়ং নেহরু লেখেন যে, এক দিন লাল কেল্লার এক বিচারে মোগল সাম্রাজ্য শেষ হয়েছিল, এ বারে কি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পালা? নেতাজির দৃঢ় স্বাধীনতা-ঘোষণায় তাঁকে কংগ্রেসি নেতার চেয়ে মোগল সম্রাটের কাছাকাছি মনে হয়, আজাদ হিন্দ ফৌজের দেখাদেখি বম্বের নৌবাহিনী সংগ্রামের অধিকার কায়েম করে, রণক্লান্ত ইংরেজ শাহ নওয়াজ-ধিলোঁ-সহগলকে ছেড়ে মানে মানে কেটে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভুলাভাইয়ের সওয়াল ইংরেজের আদালতে না টিকলেও জনতার দরবারে বিপুল সমর্থন পায়।

দেশভাগের মাত্র ছয় মাস আগে আজাদ হিন্দ ফৌজের যে সংগ্রামী উত্তরাধিকার হিন্দু-মুসলমান-শিখকে একত্র করতে পেরেছিল, তাকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা কম হয়নি, সেই চেষ্টায় ইংরেজের আইন-কানুন-সংবিধান বড়ই কার্যকর হয়েছে। তাই আমরা বিচ্ছিন্নতা-জঙ্গিবাদ-‘দেশের শত্রু’ ইত্যাদি আইনি লব্জ ছাড়া জাতিসত্তার স্বাধীনতার কথা আর ভাবতেই পারি না, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের উত্তরাধিকারও ভোট-রাজনীতির তেলে সাঁতলে নিয়ে বুঝতে হয়। নেতাজি যে সংগ্রামের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন, তা আজও আমাদের নতুন দেশভাবনার রসদ হতে পারে। যে দেশের নাগরিকরা স্ব-অধিকার বুঝে নেয়, মানবিক ভাবে একে অপরের সংগ্রামের সম্মান দেয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement