বিলগ্নিকরণের ডাকনাম
toy train

বেসরকারি হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ দিলে মানুষের স্বার্থরক্ষা হবে কি

বেসরকারি সংস্থার হাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ তুলে দিলেই তার কুশলী ব্যবহার হবে, এই কথাটা খুব বিশ্বাসযোগ্য শোনাচ্ছে কি?

Advertisement

বিশ্বজিৎ ধর

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৪:৪৯
Share:

পরিবর্তন: বেসরকারি হাতে চলে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী টয় ট্রেনের পরিচালনার ভার

এই বছরের বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানিয়েছিলেন যে, সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত পরিকাঠামো সম্পদ থেকে অর্থ উপার্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থমন্ত্রী বললেন, নতুন পরিকাঠামো তৈরির জন্য টাকা জোগাড় করার এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পথ। তার জন্য সরকার তৈরি করবে ‘ন্যাশনাল মনিটাইজ়েশন পাইপলাইন’ বা এনএমপি।

Advertisement

অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার সাত মাস পরে প্রকাশিত হল সেই মনিটাইজ়েশন পাইপলাইন। দেখা গেল, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ‘কোর অ্যাসেট’ থেকে সরকার আগামী চার বছরে ছয় লক্ষ কোটি টাকা তুলতে চায়। বর্তমান সরকারের অভিধানে ‘মনিটাইজ়েশন’ কথাটা একেবারেই নতুন নয়। এয়ার ইন্ডিয়া এবং অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার প্রস্তাবিত বিলগ্নিকরণের সময়ও সরকার এই শব্দটাই ব্যবহার করেছিল। অর্থাৎ, ‘মনিটাইজ়েশন’ হল রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বেসরকারিকরণের ডাকনাম।

সরকারি কাগজপত্রে হঠাৎ ডাকনামের প্রয়োজন পড়ল কেন, তার একটা সম্ভাব্য কারণ হল রাজনীতি। ‘বেসরকারিকরণ’ কথাটার একটা তীব্র রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে। নীতি আয়োগ দু’খণ্ডে একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যেটা ‘অ্যাসেট মনিটাইজ়েশন গাইডবুক’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। তাতে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ‘মনিটাইজ়েশন’-এর জন্য একটি অভিন্ন নীতিকাঠামো তৈরির কাজে সাহায্য করবে এনএমপি। এবং, এটি যে বেসরকারিকরণের থেকে আলাদা, সেই পার্থক্য প্রতিষ্ঠাতেও সাহায্য করবে। কিন্তু, নীতি আয়োগ যা-ই বলুক না কেন, বেসরকারিকরণ আর মনিটাইজ়েশন কি আলাদা?

Advertisement

নীতি আয়োগের রিপোর্টে অ্যাসেট মনিটাইজ়েশনের যে সংজ্ঞা পাওয়া যাচ্ছে, তার মূল কথা হল: এই প্রক্রিয়ায় পারফর্মিং বা কার্যকর ‘আইডল’ বা ‘নিষ্কর্মা’ পুঁজিকে অন্য কোনও সম্পদে, বা প্রকল্পে, ব্যবহার করার জন্য তার হস্তান্তর, এবং সেই পথে উন্নততর বা বাড়তি মুনাফা অর্জনই হল মনিটাইজ়েশন। এই সংজ্ঞা মানলে অন্তত তিনটি প্রশ্ন ওঠে। প্রথমত, যে সম্পদের মনিটাইজ়েশন হবে, সেগুলো কি কার্যকর, না কি নিষ্কর্মা? দুটোই এক সঙ্গে হওয়া তো অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, এই যে উন্নততর বা বাড়তি মুনাফা অর্জিত হবে বলে আয়োগের আশা, দেশের মানুষ কি তার ভাগ পাওয়ার আশা করতে পারে? তৃতীয়ত, করদাতাদের অর্থে নির্মিত সম্পদ বেচে দেওয়ার আগে সরকার কি খতিয়ে দেখেছিল, অন্য কোনও ভাবে অর্থের সংস্থান করা যায় কি না?

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের কোন কোন কার্যকর সম্পদ বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে তুলে দেওয়া হবে, সরকার তার একটা তালিকা বানিয়েছে। যে সম্পদগুলোর নাম সেই তালিকায় রয়েছে, সেগুলো যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনই তাদের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব। এই তালিকায় রয়েছে ২৬,৭০০ কিলোমিটার হাইওয়ে, ৪০০ রেল স্টেশন, নব্বইটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন, চারটে পার্বত্য রেলওয়ে, যার মধ্যে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েও আছে। তা ছাড়াও রয়েছে টেলিকম, বিদ্যুৎ বহন ও বণ্টনের পরিকাঠামো, পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য পেট্রোপণ্য, প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন ইত্যাদি। এই সম্পদগুলোকে যদি মনিটাইজ়েশনের জন্য বেছে নেওয়া না হত, তা হলেও কি বেসরকারি ক্ষেত্র এই মনিটাইজ়েশনের প্রক্রিয়ায় আগ্রহী হত?

এনএমপি-তে সরকার এই সম্পদগুলিকে বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে দীর্ঘমেয়াদি লিজ়ে তুলে দিতে চায়, এককালীন এবং/অথবা ধারাবাহিক ভাড়ার বিনিময়ে। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, সরকারের এই প্রবল আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে এই ভাড়া বা বিলগ্নিকরণ বাবদ পাওয়া টাকা সরকারের পক্ষে খুবই লাভজনক হবে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষের শেষে কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬০ শতাংশ, আগের বছর এই অনুপাতটি ছিল ৪৮.৬ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবর্ষের ক্ষেত্রে অনুমান হল, সরকারের ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৬২ শতাংশে দাঁড়াবে। এই অবস্থায় এনএমপি থেকে টাকা এলে সরকারের সুবিধা হবে, অস্বীকার করার উপায় নেই।

এনএমপি-তে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে তুলে দেওয়ার ফলে দেশের সাধারণ মানুষের উপর কী প্রভাব পড়বে, অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় তার কোনও উল্লেখ নেই। এখানে দুটো কথা স্পষ্ট ভাবে বুঝে নেওয়া দরকার। এক, যে সম্পদগুলি ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, অথবা বিলগ্নিকরণ করা হচ্ছে, তার সবই তৈরি হয়েছিল করদাতাদের টাকায়। কাজেই, এই সম্পদের ব্যবহার ও পরিচালনার উপর সাধারণ মানুষের অধিকার ছিল। দুই, এত দিন অবধি সম্পদগুলি পরিচালনার দায়িত্বে ছিল সরকার, বা বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। সেই সংস্থাগুলি মুনাফা অর্জনের লক্ষে চালিত হয় না, তাদের কাজ জনস্বার্থ রক্ষা। কাজেই, এত দিন অবধি এই সম্পদগুলি ব্যবহার করতে সাধারণ মানুষকে খুব বেশি টাকা খরচ করতে হত না। হাইওয়ে থেকে রেললাইন, টেলিকম থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিকাঠামো যদি বেসরকারি সংস্থার হাতে পরিচালিত হয়, তবে দেশের নাগরিকদের উপর প্রকৃত প্রস্তাবে দ্বিগুণ কর আরোপিত হবে। প্রথম, তাঁদের টাকাতেই এই সম্পদ নির্মিত; দ্বিতীয়, সেই সম্পদ ব্যবহার করতে তাঁদের অনেক বেশি ইউজ়ার চার্জ দিতে হবে।

বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত হয় মুনাফার যুক্তিতে— এবং, তার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। তার লক্ষ্য হল লগ্নিকারীদের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন। কাজেই, সরকার যদি তেমন সংস্থার হাতে কার্যকর সম্পদ পরিচালনার ভার তুলে দেয়, সেখানে সরকারের একটা দায়িত্ব থেকে যায়— তাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, কর্পোরেট সংস্থা এই সম্পদগুলির উপর এমন ইউজ়ার চার্জ আরোপ করবে না, যা বহু উপভোক্তার সাধ্যের অতীত হয়ে যায়। নীতি আয়োগের রিপোর্টে এই দায়িত্বের কোনও স্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন উল্লেখ নেই।

অতীতে বিলগ্নিকরণের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা বলছে, উপভোক্তাদের স্বার্থ প্রায়শই লঙ্ঘিত হয়েছে। দিল্লির বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার কথাই ধরা যাক। তৎকালীন কংগ্রেস সরকার বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ করল। তার ফল হল বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। সেই বোঝা গরিব মানুষের পক্ষে দুঃসহ তো বটেই, মধ্যবিত্তেরও নাভিশ্বাস ওঠে। আম আদমি পার্টির অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল যে, তারা ক্ষমতায় এলে বিদ্যুতের মাসুল কমাবে। নির্বাচনে জিতে তারা গ্রাহকদের জন্য ভর্তুকিরও ব্যবস্থা করে। কিন্তু, সেই ভর্তুকির টাকা আসে কোথা থেকে? যাঁরা ভর্তুকি পাচ্ছেন, তাঁদেরই দেওয়া কর থেকে। অর্থাৎ, ‘সস্তায়’ বিদ্যুৎ পেতে গ্রাহকরা হয় বাড়তি কর দিচ্ছেন, অথবা করের টাকায় অন্য যে সুবিধাগুলি তাঁদের প্রাপ্য ছিল, সেগুলি হারাচ্ছেন। অন্য দিকে, বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার লাভ অব্যাহত।

শেষ প্রশ্ন: মনিটাইজ়েশনের বদলে অন্য কোনও পথে কি সরকারের পক্ষে রাজস্ব ঘাটতি মেটানো সম্ভব ছিল? একটা উপায় হতে পারত কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো। ভারতে করের পরিমাণ জিডিপির ১৭.৪ শতাংশ— অধিকাংশ উন্নত দেশের তুলনায় এই হার কম। যাঁরা করের আওতায় পড়েন, তাঁদের কর দিতে বাধ্য করা, করব্যবস্থার ফাঁকফোকর ভরাট করা ইত্যাদি জরুরি— এই পথে হাঁটলে কর রাজস্বের পরিমাণ বাড়বে। একটা উদাহরণ থেকে ছবিটা স্পষ্ট ভাবে বোঝা সম্ভব। ২০০৫-০৬ সাল থেকে ভারতে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির বাৎসরিক লাভ এবং প্রদত্ত করের পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০০৫-০৬ সালে এই সংস্থাগুলির ৪০ শতাংশ ঘোষণা করেছিল যে, তারা কোনও মুনাফা অর্জন করেনি। ২০১৮-১৯ সালে অনুপাতটি বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ শতাংশে। অন্য দিকে, ২০০৫-০৬ সালে ৫৫ শতাংশ সংস্থা জানিয়েছিল, তাদের মুনাফার পরিমাণ এক কোটি টাকা বা তার কম। ২০১৮-১৯ সালে এই অনুপাত কমে হয়েছে ৪৩ শতাংশ। লাভের অঙ্ক কমিয়ে দেখানোর সুবর্ণ সুযোগ না থাকলে এই গোত্রের পরিসংখ্যানের দিনের আলো দেখার কথা নয়।

নীতি আয়োগের মতে, এনএমপি-র উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের গায়ে বেসরকারি পুঁজির কুশলী সোনার কাঠি ছুঁইয়ে তার ঘুম ভাঙানো। উপরের পরিসংখ্যানে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে দেখা যাচ্ছে, তাতে তাদের ব্যবসা পরিচালনার কুশলতায় খুব ভরসা করা তো মুশকিল। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির অবস্থা বরং অনেক ভাল। ২০১৯-২০ সালে যখন দেশের সব সংস্থা ৪৭ শতাংশ ক্ষতিতে চলছিল, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ক্ষেত্রে সেই অনুপাত ছিল ৩৩ শতাংশ। এই অবস্থায়, বেসরকারি সংস্থার হাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ তুলে দিলেই তার কুশলী ব্যবহার হবে, এই কথাটা খুব বিশ্বাসযোগ্য শোনাচ্ছে কি?

অর্থনীতি বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement