মুচিরাম গুড়ের কথা মনে পড়তে পারে। ২০১৫ থেকে টানা চার বছর ইউক্রেনে এক কমেডি টিভি সিরিজ় হত, নাম সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল, শ্রেষ্ঠাংশে কৌতুকাভিনেতা ভোলোদিমির জ়েলেনস্কি, বিষয় রাজনৈতিক প্রহসন। গল্পটা হল, স্কুলের এক ইতিহাস-শিক্ষক আচমকাই দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে গিয়েছেন। ক্লাসঘরে তিনি সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু বিরক্ত মন্তব্য করেছিলেন, এক ছাত্র তা ক্যামেরাবন্দি করে চার পাশে ছড়িয়ে দেয়— ভাইরাল। তা থেকে ক্ষমতাশীর্ষে। কাহিনি-ভাবনায় অভিনবত্ব কিছু নেই, দেশে-দেশে এমন ছবি তৈরি হয়েই থাকে। যা হয় না, তা এর পরবর্তী ঘটনাক্রম। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ওই সিরিজ়ের নামে সত্যি সত্যিই একটা রাজনৈতিক দল খুলে ফেললেন প্রযোজনা সংস্থা ‘ক্ভারতাল ৯৫’-এর সিইও ইভান বাকানোভ, নিজে হয়ে বসলেন পার্টির ফার্স্ট লিডার, ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হলেন জ়েলেনস্কি। এ পর্যন্তও ততখানি মাথা ঘামানোর ছিল না, যদি না ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কোকে হারিয়ে দিতেন তিনি, আবার ৭৩.২২ শতাংশ ভোট পেয়ে! যাত্রাওয়ালা মুচিরাম গুড় প্রথমে মুহুরি হয়, অতঃপর পেশকার থেকে ডেপুটি কালেক্টর, তার পর জমিদারি পত্তন ও অট্টালিকা ক্রয়, শেষ পর্যন্ত বেঙ্গল কাউন্সিলে আসন এবং রায়বাহাদুর! একটুখানি স্বযোগ্যতায়, বেশির ভাগটাই ভাগ্যচক্রে।
রায়বাহাদুর হয়ে মুচিরাম কী করেছিল, সে কথা আর বঙ্কিমচন্দ্র লেখেননি। জ়েলেনস্কি প্রেসিডেন্ট হলেন, অতঃপর বাঘা বাঘা সব রাজনীতিক তাঁকে ঘিরে ফেললেন। তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল, দেশের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে চলা সংঘর্ষে ইতি। কিন্তু যুদ্ধবিরতি বড় বিষম বস্তু, নেটো আর ক্রেমলিনের ট্রাপিজ়ের খেলায় প্রায় দিশাহারা হয়ে পড়লেন জ়েলেনস্কি। প্রথমে আপসের পথ, মস্কোর সঙ্গে আলোচনা, বন্দি আদানপ্রদান আর শান্তিপ্রক্রিয়া। যখন তা সাকার হল না, তখন কড়া হতে চাওয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও নেটোর সদস্যপদের পথে পা বাড়ানো। চটে গেলেন পুতিন। বস্তুত, রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার জালে জড়িয়ে পড়লেন জ়েলেনস্কি। রাষ্ট্রনেতা হিসাবে তাঁর যে দার্ঢ্যের প্রয়োজন ছিল, কৌতুকাভিনেতার মন নিয়ে তা ধরতে না পারারই কথা। আর, এমন পরিস্থিতিতেই তাঁর দেশকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছে বিশ্বের তাবৎ বৃহৎ শক্তি।
জ়েলেনস্কির জেদটি এর পরেও লক্ষণীয়। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লামিদির পুতিন যখন প্রায় যুদ্ধঘোষণা করে দিলেন, তখনও জ়েলেনস্কি স্পষ্ট ভাবে বললেন, “আমরা আমাদের দেশ রক্ষা করব, সহযোগীরা সমর্থন করুন বা না-করুন, তাঁরা অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র দিন বা পাঁচ হাজার হেলমেট। যে কোনও সহায়তাই স্বাগত, কিন্তু তাঁরা যেন একে দয়ার দান না-ভাবেন। ইউক্রেন ভিক্ষা চাইছে না, তাই এ দিয়ে বাঁধাও যাবে না। এগুলো শুধু মহতী সঙ্কেত, যে জন্য ইউক্রেন আনত মস্তকে অভিবাদন জানাতে পারে। এটা ইউরোপ ও বিশ্বের নিরাপত্তায় আপনাদেরই অবদান, যেখানে নির্ভরযোগ্য ঢালের মতো আট বছর কাজ করছে ইউক্রেন। এই আট বছর ধরেই সে প্রতিরোধ করেছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সেনাবাহিনীকে।”
কথাগুলো হয়তো কেউ চার্চিলের ‘ফাইনেস্ট আওয়ার’ বা রুজ়ভেল্টের ‘ইনফেমি স্পিচ’-এর মতো মনে রাখবেন না। কিন্তু, এত বড় যুদ্ধের মুখে শান্ত ভাবে তা বলতে পারা কম কথা নয়, বিশেষত অপেশাদার রাজনীতিকের পক্ষে। জ়েলেনস্কি জানেন, তিনি নিমিত্তমাত্র। তিনি পশ্চিমঘনিষ্ঠ, অতএব ক্রেমলিন তাঁর শত্রু, তবে পশ্চিমও সত্যিকারের বন্ধু নয়, তাদের কাছে কিভ হল মস্কোর উপর চাপ তৈরির ঘুঁটি। এমতাবস্থায় জ়েলেনস্কি ফিরেছেন তাঁর রাজনীতিবোধের আদিস্বরে— ‘ইউক্রেন সেন্ট্রিজ়ম’ বা ইউক্রেন-কেন্দ্রিকতায়। সোভিয়েট-ভাঙনের কালে এই প্রজাতন্ত্র খুব গোড়ার দিকেই পৃথক হয়েছিল, তার জাতীয়তাবাদের সুর বরাবরই উঁচু তারে বাঁধা। ক্রেমলিনের দীর্ঘ ছায়া কাটানো তবু সহজ নয়, ২০১৪ সালেও প্রকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে রক্তাক্ত হয়েছে কিভ, ইউরোময়দানের বিপ্লবে টেনে নামানো হয়েছে রুশ সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক লেনিনমূর্তি। পুতিনবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইউয়ানুকোভিচ সরে গিয়েছেন, স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন পশ্চিমের কাছের লোক পোরোশেঙ্কো, তবু সঙ্কট কাটেনি। সেই পূর্বাঞ্চলীয় সশস্ত্র বিদ্রোহ, সেই আকণ্ঠ দুর্নীতি। এর পর যে কী করে এক জন কমেডিয়ান অকস্মাৎ রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে গেলেন, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে আজও বিস্ময়। অনুমান, বিপ্লবোত্তর ব্যর্থতার মতো হতাশ্বাস সময় বোধ হয় কিছু নেই, খানিক কল্পনাতেও ভরসা করে ফেলেন মানুষ। তদুপরি তির্যক হাসির ক্ষমতা কে না জানে— স্মর্তব্য, উম্বের্তো একো-র দ্য নেম অব দ্য রোজ়। অধুনা বেকারত্ব-মাদকে নিমজ্জিত পঞ্জাবেও এক কমেডিয়ানই মুখ্যমন্ত্রিত্বের দৌড়ে অগ্রগামী। কিন্তু যে ব্যঙ্গকৌতুকের কাজ রাষ্ট্রক্ষমতাকে প্রশ্ন করা, সে নিজেই গদিতে বসে পড়লে তার সঙ্কট ঘটাও স্বাভাবিক। জ়েলেনস্কির বিরাট কৃতিত্ব: এর পরেও তিনি স্নায়ুর উপর ভরসা রেখে কঠিনতম পরিস্থিতি সামলে চলেছেন।
বড় বিপজ্জনক সময়। মানুষ দিশাহীন, দেশ আদর্শহীন। গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, সেনাশাসন। মস্কোপন্থী ও ইউরোপন্থী দুই পথেই হতাশ ইউক্রেনবাসী এক শূন্যতায় বেছেছিলেন জ়েলেনস্কিকে। তিনি কিন্তু রাজনীতিক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম তুলে ফেলেছেন।