Pegasus Spyware

এ যুগের গুপ্তচরবৃত্তি যেমন

নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং গোপনীয়তা সংবিধান-স্বীকৃত, জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তিতেও তা কখনও খর্ব করা যায় না।

Advertisement

হুমায়ুন কবীর

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০২১ ০৪:২৯
Share:

কাকে বলে গুপ্তচরবৃত্তি? প্রতিপক্ষকে টেক্কা দিতে আড়ি পেতে তার দুর্বলতা ও পরিকল্পনার আঁচ করা। দুই বিশ্বযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি, এমনকি প্রাচীন সভ্যতাও— অনেক পথ পেরিয়ে তা আজকের ইজ়রায়েলে পৌঁছেছে। অন্য দিকে, ইন্টারনেটের যুগ হাট করে খুলে দিয়েছে জনতার গোপনীয়তা, গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের ব্যক্তিগত তথ্য। গুপ্তচরবৃত্তিও হচ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে। সিআইএ, আইএসআই, র, এমআই৬, মোসাড— বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর সংস্থা পৃথিবী জুড়ে নানা গোপনীয় উপায়ে তথ্য সংগ্রহের জাল বিস্তার করেছে। গোপন নথির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাদের ফাঁদে ফেলা কিংবা টাকার লোভ দেখিয়ে তথ্য হস্তান্তরের কাজ দ্রুত ও নিখুঁত করতে অত্যাধুনিক যন্ত্রের সহায়তা লাগেই। এজেন্টদের কাজে লাগিয়ে আড়ি পাতা, বন্ধুত্ব করা, ‘বাগিং’ করা, গোপন ক্যামেরা লাগানো ইত্যাদিই হল পন্থা। গোপনে জিপিএস দিয়ে কারও গতিবিধি মাপা অনৈতিক হলেও গুপ্তচরদের তা করতেই হয়।

Advertisement

এই সব কৌশলের থেকে আরও কয়েক যোজন এগিয়ে প্রযুক্তি সংস্থা ‘এনএসও’, যার আধুনিকতম স্পাইওয়্যার ‘পেগাসাস’ বিশ্বের তাবড় রাজনীতিবিদ, ধনকুবের, আমলা, সাংবাদিক, সমাজকর্মীদের উপর স্মার্টফোনের মাধ্যমে ‘রিমোট সার্ভেল্যান্স’ চালানোর ক্ষমতা রাখে। কিছু দিন আগেও অ্যাপের সাহায্যে ছদ্মবেশে কোনও ম্যালওয়্যার ফোনে ঢোকাতে গেলে গ্রাহকের অনুমতি লাগত, কিংবা একটা ক্লিক করতে হত কোনও ওয়েবপেজ খুলতে, কিংবা ডাউনলোড করতে হত কোনও অ্যাপ বা লিঙ্ক। পেগাসাস অনুমতির ধার ধারে না— ‘জ়িরো ক্লিক’ পে-লোড— অজানতে ঢুকে পড়ে গ্যাজেটে। এর উপস্থিতি টেরও পাওয়া যায় না, কোনও সূত্র না রেখেই তা আবার যন্ত্র থেকে বেরিয়েও যায়। মিসড কল, ভুয়ো ওয়েবসাইট, অ্যাপ, ইমেল বা যে কোনও ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে তা আসতে পারে। যেন তাকে আহ্বান জানাতে তৈরিই রয়েছে আধুনিক গ্যাজেট। এই স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে ভাইরাস ঢুকিয়ে যন্ত্রের যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নেওয়া যায়, তা সার্ভারে জমা রেখে ইচ্ছেমতো ব্যবহারও করা যায়।

গ্যাজেট যত আধুনিক, হানার আশঙ্কা তত বেশি। এটি সিস্টেমের মধ্যে ঢুকে যন্ত্রের সার্কিট আর প্রসেসরকে কব্জা করে, জমানো তথ্য সংগ্রহ করে, মাইক্রোফোন ও ক্যামেরার মাধ্যমে চার পাশের ঘটনাবলি রেকর্ড করে, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের তথ্য তুলে নেয়। হোয়াটসঅ্যাপ যতই ‘এন্ড-টু-এন্ড’ এনক্রিপশনের কথা বলুক, তার আগেই তথ্য জমা হয়ে যায় পেগাসাসের সার্ভারে।

Advertisement

পেগাসাস বাজারে আসার খবর ছিল ২০১৬ সালেই। ২০১৯-এ ভারতে প্রথম তার উপস্থিতি টের পায় হোয়াটসঅ্যাপ, হ্যাক হয়েছিল হাজারখানেক ফোন। এনএসও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। কার কার ফোনে ভাইরাস ঢুকিয়ে তথ্য হাতানো হয়েছে, এবং তা কাদের অঙ্গুলিহেলনে, এত দিনে সে নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলা মহিলা কর্মী, ইস্তানবুলে সৌদি আরবের দূতাবাসে খুন হয়ে যাওয়া সাংবাদিক জামাল খাশোগি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান— পেগাসাসের পরিধি এমনই সুবিপুল। এজেন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এনএসও আধিকারিকদের, যদিও খাতায়-কলমে তারা শুধুমাত্র কোনও দেশের সরকারকেই সাহায্য করে। অথচ, ৫৫-৬০ কোটি টাকা খরচেই সরাসরি ইজ়রায়েল থেকে সংস্থার লোকেরা এসে পৌঁছে দেয় প্রোগ্রামিং করা ল্যাপটপ। তাতে পছন্দমতো টার্গেটে স্পাই ভাইরাস ঢোকানো যায়। আগে শুধু নির্দিষ্ট আইপি (ইন্টারনেট প্রোটোকল) নম্বরটি নিতে হয়, কিনতে হয় বা ভাড়া করতে হয় সার্ভার, অপহৃত তথ্য জমানোর জন্য। এই স্পাই-কে ব্লক করা প্রায় অসম্ভব। যদিও শোনা গিয়েছে, ভিআইপি-দের গোপন খবর সুরক্ষিত রাখতে নাকি অ্যান্টিভাইরাস বানিয়ে ফেলেছেন আমেরিকার সাইবার বিশেষজ্ঞেরা। এই ভাইরাস খুঁজতে সাইবার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ‘মোবাইল ভেরিফিকেশন টুল’-এর মাধ্যমে গ্যাজেট স্ক্যান করানোও যায়। অবশ্য ভাইরাস খুঁজে পেলেও, কে পাঠিয়েছে বোঝার উপায় নেই। তাই আইনি ব্যবস্থা করলেও কার বিরুদ্ধে করতে হবে, উত্তরটি অজানা।

আইনও কি রয়েছে? সরকার চাইলে দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ‘লিগ্যাল ইন্টারসেপশন’ বা আইনি ভাবে নজর রাখতে পারে। সে জন্য নোডাল অফিসার ঠিক করার বিধানও রয়েছে। আইবি, সিবিআই, ইডি, সিআইডি, এমনকি পুলিশও তদন্তের স্বার্থে ফোন ‘ট্যাপ’ করে কথা শুনতে পারে। আছে ‘অফ-এয়ার ইন্টারসেপশন’। কার মাউন্টেড, ব্যাক-প্যাক ক্যারেড আর হ্যান্ড-হেল্ড— এই তিন ধরনের ডিভাইসের মাধ্যমে দেড়-দুই বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে সন্দেহজনক ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের উপর নজরদারি করা হয়। অপরাধ বিষয়ক তথ্যের ফাঁকে ব্যক্তিগত কিছু ফাঁস হয়ে গেলেও তা গোপন রাখাই নীতি। আইনসম্মত ভাবে কারও বাড়িতে হানা দিয়ে সন্দেহজনক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে সরকার, কিন্তু ঘরে চোর ঢুকিয়ে জিনিস চুরি করাতে বা তথ্য হাতাতে পারে না। নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং গোপনীয়তা সংবিধান-স্বীকৃত, জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তিতেও তা কখনও খর্ব করা যায় না। সে ক্ষেত্রে আইনানুসারে শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে।

এনএসও দাবি করে, তাদের স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে বহু সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ থামানো গিয়েছে, একাধিক যুদ্ধ ঠেকানো গিয়েছে, অনেক প্লেন হাইজ্যাক হওয়ার হাত থেকে বেঁচেছে, অনেক উগ্রপন্থী ধরা পড়েছে। এর সবটা মিথ্যাও নয়। তবে, যার হাতে তা রয়েছে বেশির ভাগটাই নির্ভর করে তার মতলবের উপর। অতএব, নাগরিকের কাছে নিয়তিই ভরসা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement