Medical Education

ডাক্তারি শিক্ষার গোড়ায় গলদ

ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চলা প্রাইভেট কলেজগুলোর বেশির ভাগই শিক্ষকদের নামমাত্র পারিশ্রমিক দেয়।

Advertisement

অভিজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২২ ০৫:০৫
Share:

চিকিৎসার চলতি মান কেমন, ভাল চিকিৎসা কী, এই সব প্রশ্ন নিয়ে খুবই আলোচনা চলে। শুনি যে, এই রাজ্যে চিকিৎসা বলে আর কিছু রইল না, যা আছে তা চেন্নাই-বেঙ্গালুরুতে। এই রাজ্যের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে যে অভিযোগগুলো শুনি, তার কারণগুলো নিয়ে এই বার অন্তর্বীক্ষা ও আলোচনার সময় এসেছে।

Advertisement

যে গলদটা একেবারে গোড়ায়, তা আমাদের চিকিৎসা বিষয়ক লেখাপড়ার ব্যবস্থায়। সাড়ে চার বছর তালিম পেয়ে ‘মেধাবী’ ডাক্তারি ছাত্ররা ডাক্তারবাবুর ভগবৎ দৃষ্টি পাবে, সাধারণ মানুষের ধারণাটা এ রকমই। চিকিৎসাশিক্ষার কঠিন ধাপগুলো পেরোনোর সময় আলোআঁধারিতে ঘুরপাক খেতে খেতে চিকিৎসা শিক্ষার্থীকে যে ভাবে পথ খুঁজে নিতে হয়, তা প্রায় অজানাই থাকে বাইরের পৃথিবীর কাছে। সাড়ে চার বছরের বুনিয়াদি পাঠ, নিবদ্ধীকরণের আগে আরও এক বছর রোগীর পাশে থেকে হাতেকলমে কাজ, তার পর আবার নিট। চিকিৎসাশিক্ষা যেন শীতকালের রাতের মতো। পড়া শেষের ভোর আর হতেই চায় না।

মেডিক্যাল কলেজের চৌহদ্দিতে লেখাপড়া কেমন ভাবে চলছে, স্বাভাবিক কারণেই সেটা সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। তাঁরা ফলাফল দেখেন। কিন্তু, ছাত্রছাত্রীরা যখন বুঝতেই পারে না যে, কলেজে তাদের কী কী পাওয়ার ছিল; জানতে পারে না যে, এই চিকিৎসাশিক্ষার অতীতের ঐতিহ্য কত শৃঙ্খলা, কত নিষ্ঠা আর দায়িত্ব পালনের ইতিহাস বয়, তখন চিন্তিত হতেই হয়। প্রতি দিনের পড়াশোনার জায়গায় যদি বিশৃঙ্খলা, চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং ফাঁকিবাজি দৃশ্যমান হয়, তা আরও বেশি চিন্তার। এই রোগগুলো চিকিৎসাশিক্ষার মূল কাঠামোর পাটাতনকেই দুর্বল করে তোলে। এই ব্যাধির দিকে আঙুল তোলার কাজটা বৃহত্তর জনসমাজের পক্ষে অসম্ভব; সরকারও কাজটি করবে না। অতএব, পেশার মধ্যে থেকেই এই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। সরকারকে আড়াল করতে নয়, নিজের দায়িত্ব পালন করতে, ত্রুটি সংশোধনের ক্ষেত্র তৈরি করতে।

Advertisement

সময় আর পরিস্থিতির প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে আসনসংখ্যাও। বৃদ্ধির এই আলোর নীচে জমা হয়েছে অন্ধকার। শিক্ষাদানের শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা এগুলো চিকিৎসাশিক্ষার অন্যতম ভিত্তি। সপ্তাহে সাকুল্যে এক দিন বা দু’দিন শিক্ষক-চিকিৎসকের উপস্থিতি এখন যে ভাবে আর ব্যতিক্রম নয়, হক এবং রীতিমতো নিয়মের জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, তা ভীতিপ্রদ। বছর বিশেক আগে এটা ভাবাও যেত না। জেলার কলেজ পেরিয়ে এখন তা বিস্তৃত নগর কলকাতার প্রতিষ্ঠানগুলিতেও। প্রতি দিন সকাল ন’টায় কাজের জায়গায় যাওয়া এবং ক্লাস নেওয়া এখন যেন গর্হিত কোনও কাজ। কিছু পেশাদার যখন এমন বেসুরো গীতে সুর না মিলিয়ে নিজের কাজটা করে যান, তাঁদের বিদ্ধ হতে হয় বিদ্রুপের তীক্ষ্ণ বাণে।

এই সব অনিয়মের দিকে যাঁদের নজর রাখার কথা, সেই প্রশাসকরাও শান্তির উপাসক। না হলে কাজ বাড়ে, অপ্রিয়ও হতে হয়। শিক্ষার সর্বোচ্চ নিয়ামকরা পরীক্ষায় হোম-সেন্টারের ব্যবস্থা করেছেন। ছাত্রছাত্রীরা কিছু শিখুক বা না-ই শিখুক, তাদের ফেল করানোটা পরীক্ষকের ‘অপরাধ’, ছাত্রবিরোধী মনোভাবের পরিচায়ক। এখন ডাক্তারি পড়তে ঢুকলে যথাসময়ে পাশ করে বেরোনোর নিশ্চয়তা বিপুল। ছাত্রদের গুণে নয়, শিক্ষকদের গাফিলতি ঢাকার নিজস্ব তাগিদে। অবশ্য, সারা দেশ জুড়েই এই রোগের প্রকোপ যথেষ্ট।

ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চলা প্রাইভেট কলেজগুলোর বেশির ভাগই শিক্ষকদের নামমাত্র পারিশ্রমিক দেয়। সেখানে এ ব্যাধির ব্যাপকতা আরও বেশি এবং আরও নানা ফন্দিফিকির দিয়ে ভরা। ‘সরকার সব কিছু করবে না’— দেশের স্বাস্থ্যপরিচালকদের এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং শুধু অর্থোপার্জনমুখী দর্শনের উপর ভর করে প্রাইভেট কলেজের সংখ্যাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সব মিলিয়ে এ এক দমবন্ধ অবস্থা। চিকিৎসাশিক্ষার প্রসার এবং প্রকরণের প্রগতি অবশ্যই দরকার। কিন্তু তা যদি ‘ফাইলেরিয়াল গ্রোথ’ হয়ে পেশাশিক্ষার দেহটাকেই রোগগ্রস্ত করে তুলে অন্তঃসারশূন্য ডিগ্রি বিতরণের আখড়া বানায়, তবে তা চিন্তার।

এই ব্যবস্থার মধ্যেও ব্যতিক্রমী শিক্ষকরা আছেন, প্রবল পরিশ্রমী ও সৎ ছাত্ররা আছে। এ বছরেও সারা দেশের সব ক’টি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রবেশিকায় প্রথম হয়েছে এক বঙ্গতনয়। এটা ব্যতিক্রম নয়— ধারাবাহিকতা আছে এর। পড়াশোনার চর্চা যদি প্রতিটা কেন্দ্রে আরও একটু দায়িত্বশীল, শৃঙ্খলার সঙ্গে করা যায় তা হলে আরও ভাল হতে পারে। প্রশাসনের কর্তব্য শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিতি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। কলেজের দরজায় এক বার টোকা মেরে যাঁরা ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’র গানে মনোযোগী, তাঁদের দায়িত্বের কথা মনে করানোর কাজটাও প্রশাসনকেই করতে হবে। ঠিক ভাবে পড়ানো হলে অন্যান্য বিষয়ের মতো চিকিৎসাশাস্ত্রের বেশির ভাগ ছাত্রই সফল ভাবে পাশ করতে পারবে। তবে, পাশাপাশি তাদের বোঝাতে হবে, পরীক্ষা পাশের চেয়ে বড় একটা পাশ আছে— হিপোক্রেটিসের নামে নেওয়া শপথ, কোনও ভেদাভেদ ছাড়াই মানুষের সেবা করে যাওয়ার যে ধর্ম চিকিৎসকদের মহান করেছিল।

সচিব, লিভার ফাউন্ডেশন

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement