তখন বাংলাদেশের বাখরগঞ্জ থেকে নৌকাপথে কলকাতার বাজারে মাছ আসতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছনো গুরুত্বপূর্ণ। এক দল মাঝি কয়েক বার মাছ নিয়ে কলকাতা গিয়ে দেখলেন, কিছুতেই সময়ে পৌঁছতে পারছেন না। ঠিক করলেন, এক জন তাঁদের দিকে লক্ষ রাখবেন। কেউ কাজে ফাঁকি দিলেই সতর্ক করবেন। সমস্যা মিটল। তাঁরা ঠিক সময়ে কলকাতায় পৌঁছতে লাগলেন।
সদ্য প্রকাশিত স্পেশাল বুলেটিন অন মেটারনাল মর্টালিটি ইন ইন্ডিয়া ২০১৭-১৯’এ দেশের ও রাজ্যগুলির মাতৃমৃত্যুর অনুপাত অর্থাৎ ১ লক্ষ জীবন্ত শিশুর জন্মপ্রতি মায়ের মৃত্যুর পরিসংখ্যান রয়েছে। জানা যাচ্ছে, এই সময়কালে মাতৃমৃত্যুর অনুপাতের সর্বভারতীয় গড় ১০৩। তামিলনাড়ুতে ৫৮, মহারাষ্ট্রে ৩৮ আর পশ্চিমবঙ্গে ১০৯। অর্থাৎ সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে রাজ্যের গড় অনেকটাই বেশি। ইদানীং রাজ্যের এই অনুপাত ঊর্ধ্বমুখী। ২০০১-০৩’এ ভারতে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত ছিল ৩০১, এ রাজ্যে ১৯৪। ২০১৬-১৮’তেও সর্বভারতীয় গড় ১১৩ আর রাজ্যের অনুপাত ৯৮। রাষ্ট্রপুঞ্জ এই মাতৃমৃত্যুর অনুপাত ২০৩০-এর মধ্যে ৭০-এর নীচে আনার লক্ষ্য স্থির করেছে। দেড়শো বছর আগের মাঝি-মাল্লাদের গল্পটি আজও প্রাসঙ্গিক।
মেটারনাল মর্টালিটি রেট বা এমএমআর মেয়েদের উন্নয়ন পরিমাপের যৌগিক সূচক। তাঁদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থান, শিক্ষার হার ও স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণের সুযোগ— সবই এই সূচকের মাধ্যমে ফোটে। বাল্যবিবাহের ফলে অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভবতীর স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন, রক্তাল্পতা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার, গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা মাতৃমৃত্যুর হারকে প্রভাবিত করে।
বাল্যবিবাহের বর্তমান পরিস্থিতি ধরা পড়েছে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে ২০১৯-২১’এ (এনএফএইচএস-৫)। বাল্যবিবাহে অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়ে, বাড়ে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত। এই প্রতিবেদনে, এ রাজ্যে ২০-২৪ বছরের বিবাহিতাদের মধ্যে বাল্যবিবাহের হার ৪১.৬%— যা দেশে সর্বাধিক। দেশের গড় হার অনেক কম, ২৩.৩%। পূর্ব বর্ধমান (৫০.৪), মুর্শিদাবাদ (৫৫.৪), পশ্চিম মেদিনীপুর (৫৫.৭) জেলায় এই হার ৫০%-এরও বেশি! সর্বাধিক পূর্ব মেদিনীপুরে (৫৭.৬)।
রাজ্যে ১৫-৪৯ বছরের ‘আন্ডারওয়েট’ মেয়েদের হার ১৪.৮ %— সর্বভারতীয় গড়ের (১৮.৭%) চেয়ে কম। সমস্যা গভীর বাঁকুড়া (২৮%) ও পুরুলিয়ায় (৩৩.৭%)। আন্ডারওয়েট মহিলা গর্ভবতী হলে তাঁর মৃত্যুর ঝুঁকি, প্রিম্যাচিয়োর সন্তান প্রসবের এবং খুবই আন্ডারওয়েট শিশু জন্মানোর সম্ভাবনা প্রবল। রাজ্যে অনেক স্পেশাল নিয়োনেটাল কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ) চালু হয়েছে। এসএনসিইউ-তেও এক কিলোগ্রাম বা তার কম ওজনের শিশুর বেঁচে যাওয়ার হার কম। অপুষ্টিতে ভোগা মায়েদের সমস্যা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হবে। আমরা অপুষ্টির দুষ্টচক্রের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকব।
রক্তাল্পতাও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। এনএফএইচএস-৫’এর প্রতিবেদনে, রাজ্যে ১৫-৪৯ বছরের মহিলাদের রক্তাল্পতার হার সর্বাধিক ৭১.৪%। তা সর্বভারতীয় গড়ের (৫৭%) থেকে অনেকটাই বেশি। দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান জেলার পরিস্থিতি ভয়াবহ। প্রতি পাঁচ জনে চার জনই রক্তাল্পতার রোগী। রক্তাল্পতা দূর করে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে গর্ভবতীদের আয়রন, ফোলিক অ্যাসিড দেওয়া হয়। এ রাজ্যে নাকি ১০০ দিন আয়রন, ফোলিক অ্যাসিড খেয়েছেন মাত্র ৬২.৫% গর্ভবতী। ওঁরা খান না কেন? এই প্রশ্নে আশাকর্মীদের প্রায় একই উত্তর, “খেলে বমি বমি ভাব বাড়ে, অস্বস্তি হয়! তাই খেতে চান না।” এক আশাকর্মী বললেন, তাঁর গ্রামে এই সমস্যা প্রায় নেই। কারণ, তিনি গর্ভবতীদের বলছেন, এটি না খেলে সন্তানের ক্ষতি হবে। মনে মনে হাসলাম, আচরণগত অর্থনীতির ‘নাজ’-এর দুর্দান্ত প্রয়োগ করেছেন তিনি।
এ রাজ্যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হারের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে ১৫ বছরে। এনএফএইচএস-৩ (২০০৫-০৬) জানিয়েছিল, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার তখন ৪৩.১%। এনএফএইচএস-৫’এ তা বেড়ে ৯১.৭%। সর্বভারতীয় গড় ৮৮.৬%। তামিলনাড়ুতে এই হার ৯৯.৬%। এই আলোচনায় কেরল নেই। কারণ এই ধরনের পরিসংখ্যানে কেরল অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে ঢের এগিয়ে। মাতৃমৃত্যুর অনুপাত দেশে ১০৩, বাংলায় ১০৯, কেরলে ৩০।
গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবাও মাতৃমৃত্যু ঠেকাতে কার্যকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গর্ভবতীকে স্বাস্থ্যকর্মীর অন্তত চার বার পরিদর্শন করা অত্যন্ত জরুরি। এই পরিষেবার সর্বভারতীয় গড় ৫৮.১%। রাজ্যে পরিষেবাটি (৭৫.৮%) সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় যথেষ্ট ভাল। খুবই ভাল উত্তর ২৪ পরগনা (৮৮.৯%), জলপাইগুড়ি (৮৮.৪%)। পিছিয়ে পুরুলিয়া (৫৭.৮%) ও পূর্ব মেদিনীপুর (৫৬.৮%)।
সেই মাঝিদের সমস্যার মতো এ যাত্রায়ও মুশকিল আসান হবে কড়া নজরদারিতেই। মেয়েদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে আর নতুন প্রকল্প নয়, চালু প্রকল্পগুলির ঠিক রূপায়ণই জরুরি। একমাত্র তাতেই এই ঊর্ধ্বমুখী মাতৃমৃত্যুর অনুপাত দ্রুত কমতে পারে।