কোনও সাফল্যই বোধ হয় তরুণ প্রজন্মকে বাদ দিয়ে হয় না। আনন্দবাজার পত্রিকা-ও প্রথম থেকেই উপলব্ধিতে বর্ষীয়ান হয়েও উৎসাহ ও উদ্দীপনায় তরুণ ও তারুণ্যের সমর্থক। বিগত শতকের বিশ, তিরিশ বা চল্লিশ দশকে দেশের তরুণ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথাই হোক, বা বিদেশের রাজনীতি ও খেলাধুলোর ক্ষেত্রের তরুণ তুর্কিদের কথাই হোক, এই পত্রিকা তা সাদরে তুলে ধরেছে পাঠকদের সামনে। প্রিয় এক দাদার কাছে শুনেছি, ষাটের দশকের প্রথম দিকে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় বেরিয়েছিল সেই সময়কার আলোড়ন ফেলে দেওয়া এক রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির কথা। ব্রিটিশ সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ওয়ার, জন প্রফুমো ও ক্রিস্টিন কিলারের গোপন সম্পর্কের কথা! যাকে বলা হয় ‘প্রফুমো অ্যাফেয়ার’! এর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল কোল্ড ওয়ার, রাশিয়ান স্পাইয়ের মতো রোমহর্ষক সব ঘটনা! বিশ্ব রাজনীতির এই ঘটনা তখন তরুণ বাঙালির কাছে একটা আলাদা জগৎ নিয়ে এসেছিল। তার সঙ্গে এনে দিয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবেদন, বা চে গেভারার বিপ্লব! আবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এই পত্রিকায় কতখানি গুরুত্ব পেয়েছিল, সবাই জানি।
সব মিলিয়ে, কিশোর থেকে যুবক হয়ে ওঠার পথে একাধিক প্রজন্মের বাঙালিকে বিশ্বভুবনের স্বাদ দিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। আন্তর্জাতিক ঘটনার প্রতি করে তুলেছে আগ্রহী, সচেতন। পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশকের ক্রমশ উত্তাল হয়ে ওঠা নানা রাজনীতি ও সামাজিক ঘটনার ধারাবিবরণী তরুণদের আগ্রহ জাগানোর মতো করে তুলে ধরত এই পত্রিকা।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও জানি কী ভাবে আমি ও আমার সমবয়সিরা প্রভাবিত হতে শুরু করলাম। ১৯৮৩ সালে ভারতের প্রুডেনশিয়াল কাপ মানে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ জেতার খবর বিরাট বড় ছাপার অক্ষরে আনন্দবাজার পত্রিকা-য়। মনে আছে, আমাদের ছোট মফস্সলে সে দিন আনন্দবাজার কাগজ নিয়ে কী তুমুল কাড়াকাড়ি! শেষে পাড়ার ক্লাবের দেওয়ালে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হল সেই কাগজ! সেজো কাকার কাঁধে বসে সেই সাত বছরের আমি প্রথম পড়েছিলাম এই পত্রিকা! তার পরের বছর এই পত্রিকার পাতাতেই পড়েছিলাম ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার খবর। আমার নিজের জীবনে পড়া প্রথম গোটা একটা খবর!
সত্যি বলতে, খেলাধুলোর জগৎ আমাদের সামনে আনন্দবাজার পত্রিকা যে ভাবে তুলে ধরেছে তা নজিরবিহীন। ষাট ও পরে সত্তর দশকের সেই প্রবল ফুটবল উন্মাদনা। দলবদলের টানাপড়েন। টান টান থ্রিলার নভেলের মতো খেলোয়াড়দের সই করানো, তাঁদের বাড়ির সামনে সারা রাত পাহারা দেওয়ার বা সবার অলক্ষ্যে তুলে নিয়ে যাওয়ার সব ঘটনা আমাদের ঘরে ঘরে এনে দিয়েছে। আবার উল্টো দিকে, হাবিব, আকবর, সমরেশ, গৌতম, সুধীর, সুভাষ, শ্যাম, সুরজিৎ, মনোরঞ্জন-সহ বহু তরুণ তুর্কি খেলোয়াড়কে আলাদা করে এনে দিয়েছে প্রচারের আলোয়।
পরে আমি ও আমার বন্ধুবান্ধবেরাও সেই উত্তেজনার শরিক হয়েছি আশির দশকে। সেই সদ্য কিশোর হয়ে ওঠা আমাদের সঙ্গে এই পত্রিকা আলাপ করিয়ে দিয়েছে চিমা-কৃশানুদের সঙ্গে।
আর এক দিকে, তরুণদের কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া ও তাদের উৎসাহ দেওয়ার কথাটাও বলতে হয়। একদম প্রথম থেকে এই বিষয়ে আনন্দবাজার-এর সুনাম। ষাটের দশকে যুবক বরুণ সেনগুপ্ত বা গৌরকিশোর ঘোষের কথা কে না জানে! পরবর্তী সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মতি নন্দী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, জয় গোস্বামী থেকে শুরু করে আরও বহু তরুণ লেখক উঠে এসেছেন এর পাতায় পাতায়। কখনও ফিচার, আবার কখনও রবিবাসরীয় পাতায় তাঁদের গল্পের জন্য উন্মুখ হয়ে থেকেছে পাঠককুল।
এ কথা বললে ভুল হবে কি, বাঙালি তরুণ বা তরুণী যে-ই কোনও কৃতিত্বের নজির গড়েছেন, আনন্দবাজার পত্রিকা তাঁকে মহোৎসাহে সর্বতো ভাবে সমর্থন করে গিয়েছে? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সেই ১৯৯২ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের তিক্ত স্মৃতি কাটিয়ে উঠে যখন ১৯৯৬ সালে লর্ডসের মাঠে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছেন, তাঁকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় এই পত্রিকা। আবার, আমাদের আজকের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যখন তরুণী বয়সে লড়াই করছিলেন, তাঁকেও ‘অগ্নিকন্যা’ নামে সকলের সামনে এনেছিল এই পত্রিকাই। খেলার জগতের ঝুলন গোস্বামী, দীপা কর্মকার, ভাইচুং ভুটিয়া থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র জগতের বহু নবীন তারকা ও নির্দেশক— অনেকেই এই পত্রিকার সমর্থনের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন। যোগ্য সম্মান দিয়ে তুলে ধরবে এই পত্রিকা, এমন আশা করেছেন। প্রসঙ্গত, এই মুহূর্তেও আনন্দবাজার পত্রিকা-র অফিসে গেলে দেখা যাবে কর্মীদের অধিকাংশই তরুণী এবং তরুণ!
বাড়ির বড়দের কাছে শুনেছিলাম, সেই পুরনো সময়ে বাড়িতে যখন খবরের কাগজ আসত, তাতে অনেক সময়ই নাকি ছাপার কালি হাতে লেগে যেত! বর্ষায় বৃষ্টির সামান্য ছাঁটেই কাগজ ভিজে যেত একদম। ভাল করে কাগজ না শুকিয়ে পড়া যেত না! এখনকার কাগজের ইলেকট্রনিক সংস্করণ আর ঝকঝকে ছাপার সময়ে এসে এ সব ব্যাপার কেউ ভাবতেই পারে না।
যুগের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকা-ও পাল্টে গিয়েছে অনেক। কিন্তু যা প্রথম থেকে আজও পাল্টায়নি, তা হল এই পত্রিকার তারুণ্যের স্পিরিট।