পশ্চিমবঙ্গ সরকার মেয়েদের জন্য ‘উৎকর্ষ বাংলা’ নামে একটা প্রকল্প চালায়। সব মেয়ের জন্য অবশ্য নয়— তাঁদের জন্য, যাঁরা লোকের বাড়িতে কাজ করেন। আগে লোকে যাঁদের অনায়াসে ঝি বলত; এখন যাঁদের আড়ালে কাজের লোক বলে, আর প্রকাশ্যে বলে গৃহকর্মসহায়িকা। নাম যেমন পাল্টেছে, তাঁদের কাজের ধরনও পাল্টেছে। আগে শিলনোড়ায় মশলা বাটতে হত— এখন মিক্সি আছে; কলপাড়ে কাপড় কাচার বদলে ওয়াশিং মেশিন আছে; এমনকি, কোনও কোনও বাড়িতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনারও আছে। সেই সব যন্ত্র চালাতে শেখাবে এই কোর্স। শেখাবে, কী ভাবে ঘর গুছিয়ে রাখতে হয়, অসুস্থ মানুষের দেখভাল করতে হয়, কী ভাবে রাঁধতে হয় সেই সব সুখাদ্য, যা মুখে রুচবে উচ্চমধ্যবিত্ত সবেধন নীলমণিদের।
তার মানে কি এই যে, সরকার কোর্স চালাচ্ছে, যাতে উন্নততর কাজের মেয়ে তৈরি করা যায়?
মাসখানেক আগে এই প্রকল্প সংক্রান্ত একটা খবর যে দিন সমাজমাধ্যমে দিয়েছিল কোনও এক সংবাদসংস্থা, সে দিন অনেকেই খুব দ্রুত পৌঁছে গিয়েছিলেন এই সিদ্ধান্তে— এই রাজ্যে চাকরি শিল্প আসে না, চাকরি হয় না; চপ শিল্প থেকে ঝি পরিষেবায় পৌঁছে যাওয়াই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজত্বে উন্নয়নের চূড়ান্ত। শিল্প তৈরি হয়ে সব মেয়েই যদি চাকরি পেত কারখানায়, বা বড় শিল্পের অনুসারী কোনও ছোট শিল্পে— লোকের বাড়িতে কাজ করার চেয়ে কেন সেটাই ভাল, আগে এক বার এই প্রশ্নটার উত্তর খোঁজা যাক। পশ্চিমবঙ্গে এক জন গৃহকর্মসহায়িকা গড়ে কত টাকা মাইনে পান, জানার উপায় নেই। কিন্তু চেনাপরিচিতদের কাছে যেটুকু শুনি, তাতে গৃহস্থ বাড়িতে থেকে কাজ করলে মাসে অনেকেরই উপার্জন দশ-বারো হাজার টাকার মতো। কারখানার অর্ধদক্ষ মহিলা শ্রমিকের মাইনে এর থেকে বেশি হবেই, নিশ্চিত ভাবে বলা কঠিন। তা হলে কি কারখানার কাজের পরিস্থিতি গৃহস্থ বাড়ির চেয়ে ভাল? শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশ থেকে চিন, ভিয়েতনাম থেকে ফিলিপিন্স, উন্নয়নশীল দুনিয়ার কোথাও এই কথাটা নিশ্চিত ভাবে বলার উপায় নেই— অনেক গৃহস্থ বাড়িতে পরিচারিকার উপর কম-বেশি অত্যাচার হওয়া সত্ত্বেও; কার্যত সব বাড়িতেই পরিচারিকাকে ঊন-মানব মনে করা সত্ত্বেও। চাকরির নিশ্চয়তা, শারীরিক সুরক্ষা, শ্রমিকের অধিকার— বাস্তব অভিজ্ঞতা বলবে, কোনও মাপকাঠিতেই কারখানায় মেয়েদের চাকরিকে নির্দ্বিধায় এগিয়ে রাখার উপায় নেই। তা হলে, সেই চাকরির জন্য হাহুতাশ কেন?
আর কথা বাড়ানোর আগেই আত্মপক্ষ সমর্থন করে রাখা ভাল— এই যুক্তিক্রম সাজিয়ে আমি কৌশলে বলতে চাইছি না যে, শিল্পের প্রয়োজন নেই, লোকের বাড়িতে কাজ করার সুযোগই যথেষ্ট। শিল্পের নিজস্ব সমস্যা আছে ঢের; যে কোনও উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে শিল্পকে রাখতেই হবে, এমন দাবিও খুব সমর্থনযোগ্য নয়; কিন্তু, গৃহস্থ বাড়িতে পরিচারিকার কাজের চেয়ে কারখানার চাকরি কোনও মেয়ের পক্ষে প্রশ্নাতীত রকম ভাল নয়— এই যুক্তি ব্যবহার করে শিল্পের প্রয়োজন অস্বীকার করাটা নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। তা হলে এতগুলো কথা খরচ করলাম কেন? এটা মনে করিয়ে দিতে যে, কোনও অর্থেই ‘স্ট্রিক্টলি সুপিরিয়র’ না হওয়া সত্ত্বেও সমাজ সাধারণ ভাবে কারখানার অর্ধদক্ষ শ্রমিকের চাকরিকে গৃহকর্মসহায়িকার চাকরির চেয়ে ভাল মনে করে। কেন করে, তার অনেক রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। যেমন, কারখানার চাকরির মধ্যে একটা চলমানতার আশ্বাস আছে— অর্থাৎ, এক জায়গায় কাজ শিখে সেই অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে অন্য জায়গায় আগের চেয়ে ভাল কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা, অন্তত খাতায়-কলমে, আছে। আর একটা কারণ সম্ভবত এটাও যে, পরিচারিকার কাজের মধ্যে যে সামাজিক সম্পর্ক আছে, সেটা চরিত্রে সামন্ততান্ত্রিক— নিয়োগকর্তা-কর্মচারীর সম্পর্ক নয়, বরং মালিক-ভৃত্যের সম্পর্ক। পৌনে দু’শো বছরের শিল্পায়নের ইতিহাস শিল্প-শ্রমিককে যে ‘মর্যাদা’ দিয়েছে, গৃহপরিচারিকার কাজের সেই মর্যাদা নেই।
গৃহপরিচারিকাদের জন্য তৈরি ট্রেনিং প্রোগ্রাম কি এই সামাজিক সমীকরণটাকে ভাঙতে পারে?
এমন প্রশিক্ষণের কথা পশ্চিমবঙ্গ সরকারই প্রথম ভাবল, তেমন দাবি করার উপায় নেই মোটে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন অন্তত দশ বছর ধরে এই প্রশিক্ষণের কথা বলছে। বিশ্বের বেশ কিছু দেশে এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে— কোথাও সরকারি উদ্যোগে, কোথাও বেসরকারি উদ্যোগে। এমনকি ভারতেও হয়েছে। ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন তৈরি করেছিল ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স কনভেনশন— গৃহকর্মসহায়কদের সনদ। সেই সনদের সুরেও ছিল পরিচারিকাদের প্রশিক্ষণের কথা। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি কোথাও বিশেষ কৃতিত্ব দাবি করতে পারে, তবে সেটা এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করায় নয়— বরং, গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পশ্চাৎপদ শ্রেণির মানুষকে, বিশেষত মহিলাদের, উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে নিয়ে আসার যে চেষ্টা রাজ্যে হচ্ছে, এই প্রশিক্ষণকে সেই কর্মসূচির পাশে জায়গা করে দেওয়ায়। এই
প্রশিক্ষণ যে উন্নততর কাজের লোক তৈরি করার জন্য নয়, বরং এটা ক্ষমতায়নের গল্প— সেটা মনে করানোয়।
ক্ষমতায়নের একটা ধাপ চেনা, সহজও। যে মেয়েরা লোকের বাড়িতে কাজ করতে যান, তাঁরা যদি জানেন যে তাঁরা কাজ শিখে যাচ্ছেন, সেই জানা একটা আত্মবিশ্বাস জোগায়। এই প্রশিক্ষণ পাল্টে দিতে পারে বাজারের চাহিদা-জোগানের হিসেবও। কাজের মেয়ের জোগান অনেক— হয়তো অপরিসীম— কিন্তু, প্রশিক্ষিত কাজের মেয়ের জোগান সীমিত। ফলে, নিজেদের অর্জিত দক্ষতার কারণে একেবারে বাজারের নিয়ম মেনেই বাড়তে পারে তাঁদের দাম। আর, সেই টানেই আরও অনেক মেয়ে এই প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন। খুলে যেতে পারে নতুন কাজের বাজারও। এই প্রশিক্ষণে তাঁরা যে দক্ষতাগুলো অর্জন করবেন, তার বেশির ভাগই ‘ট্রান্সফারেব্ল’— অর্থাৎ, যে কাজের কথা মাথায় রেখে এই দক্ষতা অর্জন করা, তার বদলে অন্য কোনও কাজেও ব্যবহার করা যায় সেই দক্ষতা। হোটেল-রেস্তরাঁ, পর্যটন শিল্প, চিকিৎসা পরিষেবা— এমন বহু ক্ষেত্রে তৈরি হতে পারে কাজের সুযোগ।
উৎকর্ষ বাংলার ওয়েবসাইটে গৃহকর্মসহায়কদের প্রশিক্ষণের চারটে আলাদা কোর্সের উল্লেখ আছে আপাতত। কোনটির পরে কী কাজের সুযোগ আছে, তার উত্তরে চার জায়গাতেই এক কথা লেখা— বিভিন্ন শিল্পে, কর্পোরেট সংস্থায়, পরিষেবা ক্ষেত্রে চাকরি হতে পারে, এমনকি প্রশিক্ষিত কর্মী নিজের ব্যবসাও আরম্ভ করতে পারেন। একই কথা কপি-পেস্ট করা নিতান্তই আলস্যের প্রমাণ— কিন্তু, এক অর্থে কথাটা সত্যিও নয় কি? সত্যিই কি এই প্রশিক্ষণ থেকে শেখা কাজ বহুমুখী দরজা খুলে দিতে পারে না? কারখানার চাকরির যে চলমানতা, এই প্রশিক্ষণ তার সুযোগ এনে দিতে পারে গৃহসহায়িকাদেরও। যাঁরা শেষ অবধি অন্য পেশায় যাবেন না, গৃহসহায়িকার কাজই করবেন, এই চলমানতা তাঁদের পক্ষেও লাভজনক হবে। এই ক্ষেত্রে কর্মীর জোগানে টান পড়লেই পাল্টাতে থাকবে কর্মক্ষেত্রের সমীকরণও। মাইনে বাড়বে, কর্মীরা অনেক সহজে নিজেদের শর্তে কাজ করতে পারবেন। গৃহস্থালির শ্রমের বাজার চিরকাল ঝুঁকে ছিল নিয়োগকর্তাদের দিকে। এই প্রশিক্ষণ সেই সম্পর্কে ভারসাম্য আনতে পারে।
কিন্তু, প্রশিক্ষণ শিবিরে যে শুধু ‘কাজ’ই শেখা যায়, কে বলল? সরকারের কোর্স মডিউলে গৃহকর্মসহায়কদের সনদের কথা আছে কি না, জানি না— কিন্তু, থাকতেই পারে। থাকা উচিত। প্রশিক্ষণ নিতে আসা মেয়েরা যাতে জানতে পারেন যে, তাঁদের জন্য কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে দেশের সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিয়োগকর্তার বাড়িতে থাকলেও তাঁর কাজের সময় বাঁধা হবে, সেই সময়ের বাইরে তাঁকে কাজ করতে আদেশ করা যাবে না; তাঁর থাকার জন্য নিরাপদ ও ব্যক্তিগত জায়গা চাই; সপ্তাহে অন্তত এক দিন পুরো ছুটি দিতেই হবে; নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা রাখতেই হবে— এমন আরও অনেক কিছু যে তাঁদের অধিকার, কাজের মেয়েরা এই কথাটা জানলে গৃহস্থালিতে কাজের পরিবেশও পাল্টাবে। এক দিনে নয়, বিনা প্রতিরোধেও নয়। কিন্তু, নিজেদের অধিকারের কথা জেনে যখন এই মেয়েরা কাজ করতে যাবেন, তাঁদের সেই জানাটাই পাল্টে দেবে গৃহস্থালির অভ্যন্তরে নিয়োগের সম্পর্কের সমীকরণ। শিল্পক্ষেত্রে যেমন মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক পাল্টেছিল। প্রথম বিশ্বের দেশগুলোয় যেমন পাল্টেছে গৃহসহায়িকাদের সামাজিক অবস্থান। নিজেদের অধিকারের, এবং তার প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতার কথা জানলে গৃহসহায়িকারা দাবি করতে পারবেন শ্রমের মর্যাদা। সেই দাবি না মিটিয়ে শেষ অবধি উপায় থাকবে না নিয়োগকর্তাদের।
এই প্রশ্নটাও শেষ অবধি তবে রাজনীতিরই। শ্রমিকের অধিকার বুঝে নেওয়ার রাজনীতির, কর্মক্ষেত্রের চরিত্র পাল্টানোর রাজনীতির। তাকে চিনে নিতে হবে, এই যা।