সময়টা ১৯৮০ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। স্থান, জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসি শহর। তিন দিনব্যাপী ভারত-সোভিয়েট যৌথ আলোচনাচক্রে আমার পরিচয় ঘটেছিল বিশিষ্ট ভারত বিশেষজ্ঞ, সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ঘনিষ্ঠ আলেকজান্দার চিচেরভ-এর সঙ্গে। ব্রেজনেভ জমানার তখন শেষ পর্ব। এক আশ্চর্য কথোপকথনে লিপ্ত হয়েছিলাম, যার শুরুটা হয়েছিল তাঁর এ রকম একটি বাক্য দিয়ে— “বন্ধু, যে সোভিয়েট-ব্যবস্থা দেখে আপনি হয়তো উল্লসিত ও উচ্ছ্বসিত, জানবেন এই ব্যবস্থা অচিরেই ভেঙে পড়বে। এর পতন অনিবার্য, অপ্রতিরোধ্য।”
হ্যাঁ, সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন অনিবার্যই ছিল। ইতিহাসের পরিহাস যে, ১৯৮৫ সালে গর্বাচভ ক্ষমতাসীন হয়ে এই পতন-প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করে সেটিকে রোধ করতে যখন সচেষ্ট হলেন, তখন এক দিকে যেমন গ্লাসনস্ত (মুক্তচিন্তা) ও পেরেস্ত্রোইকা (পুনর্গঠন) খুলে দিল সমাজতন্ত্র নির্মাণের এক নতুন প্রেক্ষিত, অপর দিকে তার সঙ্গে সংঘাত বাধল সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর। তার পরিণতিতে সৃষ্ট হল যে সঙ্কট, তার ধাক্কায় এক দিকে ভেঙে পড়ল সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং অপর দিকে গর্বাচভ আখ্যায়িত হলেন ইতিহাসের ‘এক কলঙ্কিত নায়ক’ হিসাবে। তাই সোভিয়েট ইউনিয়নের অবলুপ্তির জন্য গর্বাচভকে দোষী সাব্যস্ত করাটাই সহজতম রাস্তা হিসাবে অনেকে বেছে নিলেন। উপেক্ষিত থেকে গেল পতনের যথার্থ আলোচনা ও বিশ্লেষণ। এক জন ব্যক্তিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আড়াল করা হল একটা ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত গলদ ও সীমাবদ্ধতাকে। খেয়াল করা হল না, এই পতনের সূত্রগুলি ইতিহাসগত ভাবে নিহিত ছিল বিপ্লবোত্তর সোভিয়েট ইউনিয়নের জটিল কালপর্বের গভীরে।
ব্রেজনেভ জমানার দীর্ঘ সময়কালে (১৯৬৪-১৯৮২) অর্থনীতিতে স্থবিরত্ব, পার্টির অভ্যন্তরে দুর্নীতি, জনগণের ইচ্ছা ও স্বায়ত্তশাসনের ভাবনাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে এক প্রবল পার্টি-রাষ্ট্রের উপস্থিতি সোভিয়েট ইউনিয়নকে যে এক গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত করেছিল, তা প্রথম উপলব্ধি করেন কেজিবি-র দীর্ঘ দিনের অধিকর্তা ইয়ুরি আন্দ্রোপভ, ব্রেজনেভ পর্বের অবসানে যখন তিনি নেতৃত্বে আসীন হলেন। কড়া হাতে তাঁর পূর্বসূরির অনুসৃত পথ থেকে সোভিয়েট-ব্যবস্থাকে মুক্ত করতে তিনি যখন পদক্ষেপ শুরু করলেন, তখনই তাঁর জীবনাবসান হল (১৯৮৪)। একদা ব্রেজনেভ-ঘনিষ্ঠ কনস্তানতিন চেরনেনকো তাঁর উত্তরসূরি, কিন্তু তাঁরও জীবৎকালে অচিরেই ইতি পড়ল (১৯৮৫)। এ বারে নেতৃত্বে এলেন আন্দ্রোপভের অত্যন্ত আস্থাভাজন তরুণ মিখাইল গর্বাচভ, যদিও কেন্দ্রীয় কমিটির ব্রেজনেভ-ঘনিষ্ঠ রক্ষণশীলদের এই সিদ্ধান্তে সায় ছিল না।
আন্দ্রোপভের অসমাপ্ত কর্মসূচিকে ভিত্তি করেই গর্বাচভ তাঁর ভাবনার বিস্তার ঘটালেন, যার মূল কথা ছিল— প্রথমত, পার্টির অভ্যন্তরে জাঁকিয়ে বসা আমলাতন্ত্রকে উচ্ছেদ করা, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে কার্যত আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার যে রীতি বহু দশক জুড়ে চালু ছিল, তাকে বাতিল করে আহ্বান জানানো হল পার্টির অভ্যন্তরে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে, নির্মোহ আত্মসমালোচনাকে, তৃণমূল স্তরে পার্টি ইউনিটগুলির ভাবনাকে, সোভিয়েটগুলিকে পার্টির নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে তাদের স্বাধীন সত্তাকে মান্যতা দেওয়ার বিষয়টিকে। দ্বিতীয়ত, পার্টি-রাষ্ট্রের চৌহদ্দিকে বেঁধে দিয়ে, পার্টি নেতৃত্বের বদলে শ্রমজীবী মানুষের কণ্ঠস্বরকে প্রাধান্য দিয়ে পার্টির ভূমিকাকে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করা হল। বিযুক্ত করা হল পার্টি থেকে রাষ্ট্রকে, গুরুত্ব দেওয়া হল রাষ্ট্রের প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্যকে। তৃতীয়ত, প্রবর্তিত হল একটি নতুন শব্দবন্ধ, ‘সমাজতান্ত্রিক বহুত্ববাদ’, অর্থাৎ স্বীকৃতি পেল বহু স্বরের উপস্থিতি, বহুমাত্রিকতা। চতুর্থত, বিপ্লবোত্তর সোভিয়েট ইউনিয়নের ইতিহাস নতুন ভাবে লেখার উদ্যোগ হল। লেনিনের ভাবনায় গণতন্ত্রের উপাদানকে চিহ্নিত করে শুরু হল তাঁর পুনঃপাঠ, খারিজ হল স্তালিনীয় একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি, মান্যতা পেল গণতন্ত্রের হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরগুলি। বুখারিন প্রমুখ ব্রাত্যজন আবার ঠাঁই পেলেন ইতিহাসের পাতায়।
ইতিহাসের পরিহাস এটাই যে, গণতন্ত্রীকরণের এই প্রক্রিয়াই সূচনা করল এক গভীর সঙ্কট। বহুত্ববাদের সুবাদে পার্টির অভ্যন্তরে গজিয়ে উঠল তিনটি বিবদমান গোষ্ঠী। গর্বাচভ ও তাঁর অনুগামীরা বহুত্ববাদকে সমর্থন করলেন, কিন্তু বিরোধিতা করলেন বহুদলীয় ব্যবস্থার এবং সমাজতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপের। বরিস ইয়েলৎসিনের নেতৃত্বে অপর একটি গোষ্ঠী সওয়াল করলেন সরাসরি বাজার অর্থনীতি, পুঁজিবাদের পক্ষে। তৃতীয় গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিলেন অতীব রক্ষণশীলেরা, যাঁরা ছিলেন গর্বাচভের কর্মসূচির সম্পূর্ণ বিরোধী। ‘কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটিজ়’-এর অধিবেশনগুলিতে এবং ২৮তম পার্টি কংগ্রেসে (১৯৮৮) এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে এল। তার পরিণতিতে বেসামাল হয়ে পড়ল সোভিয়েট অর্থনীতি, অপর দিকে বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রে প্রবল ভাবে মাথাচাড়া দিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হল ব্রেজনেভ পর্বের বহুল প্রচারিত শব্দবন্ধ ‘সমগ্র জনগণের রাষ্ট্র’। রুশ নিয়ন্ত্রণবাদের সঙ্গে সংঘাত বাধল আঞ্চলিক জাত্যভিমানের, অর্থাৎ সমাজতন্ত্রও সংঘাত ও বৈরিতামুক্ত নয়। একই ঘটনা পরিলক্ষিত হল পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে সোভিয়েট ইউনিয়নের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও, যার পরিণতিতে ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতন, এবং রোমানিয়া, পোল্যান্ড-সহ একাধিক দেশে প্রবল সোভিয়েট-বিরোধী বিক্ষোভ গোটা সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে ভাঙনের মুখে এনে দাঁড় করাল।
গর্বাচভের সামনে এই সংঘাত নিরসনের দু’টি পথ খোলা ছিল। এক, ঘটমান বাস্তবকে মান্যতা দেওয়া, কারণ সোভিয়েট ইউনিয়নের অখণ্ডতাকে বজায় রাখার জন্য তাঁর আবেদনে কর্ণপাত করলেন না কেউই। অন্য বিকল্পটি ছিল বলপ্রয়োগের পথ গ্রহণ। পূর্ব ইউরোপের ক্ষেত্রে অতীতের শিক্ষা নিয়ে (হাঙ্গেরি ১৯৫৬, চেকোস্লোভাকিয়া ১৯৬৮) গর্বাচভ সে পথে হাঁটলেন না। ফলে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েট জমানার অবসান রোমানিয়া ছাড়া অন্যত্র তেমন ভাবে হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারল না, এড়ানো গেল গৃহযুদ্ধ। কিন্তু দেশের মধ্যে পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিল। সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে রক্ষণশীল গোষ্ঠীটি সেনাবাহিনী ও কেজিবি-র একাংশের সহায়তায় ১৯৯১-এর অগস্টে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে এবং গর্বাচভকে গৃহবন্দি করে ক্ষমতা দখলের যে চেষ্টা করল, সেই ঘটনাই ছিল ১৯৯১-এর ডিসেম্বরে সোভিয়েট ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক পতনের সূচক। তাঁর গ্রেফতারির সুযোগে মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন বাজার অর্থনীতির কট্টর সমর্থক বরিস ইয়েলৎসিন, যিনি নিজেকে দেশবাসীর কাছে প্রতিষ্ঠিত করলেন সামরিক শাসনের বিরোধী এবং গণতন্ত্রের মুখ হিসাবে।
গর্বাচভ যখন মুক্তি পেলেন, সামরিক অভ্যুত্থানের নায়করা যখন পর্যুদস্ত, ক্ষমতার রাশ তখন চলে গিয়েছে ইয়েলৎসিনের হাতে। গণতন্ত্রবিরোধী যে অভ্যুত্থানের অংশীদার ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, তার সাধারণ সম্পাদক হিসাবে গর্বাচভের পক্ষে দায়িত্বে থাকা আর সম্ভব ছিল না। তাঁর পদত্যাগ, সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির অবলুপ্তি, ইয়েলৎসিনের ক্ষমতাসীন হওয়া— এ সবই ছিল সময়ের অপেক্ষামাত্র। গণতন্ত্রীকরণের কর্মসূচির মাধ্যমে গর্বাচভ সোভিয়েট সমাজতন্ত্রের যে মানবায়নকে সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, তারই সুযোগ নিলেন দীর্ঘ দিনের চলে আসা স্বৈরতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতিভূরা, যার সুবাদে অপসৃত হলেন গর্বাচভ, ক্ষমতায় আসীন হলেন ইয়েলৎসিন। সমাজতন্ত্রের বিসর্জন প্রতিষ্ঠা দিল ধনতন্ত্রকে। গর্বাচভ আখ্যায়িত হলেন ‘খলনায়ক’ হিসাবে, যদিও এই দায় হয়তো বা তিনি এড়াতে পারতেন, যদি আঁচ করতে পারতেন বরিস পুগো, গেন্নাদি ইয়ানায়েভ প্রমুখ মন্ত্রী, সামরিক বাহিনীর কর্তাব্যক্তি ও কেজিবি-র একাংশের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানকে, এবং ভেঙে দিতে পারতেন পার্টির অভ্যন্তরস্থ ইয়েলৎসিন গোষ্ঠীকে।
৩০ বছর পরে যখন এই মহাপতনের ঘটনার দিকে ফিরে দেখি, তখন আবার মনে করতে ইচ্ছে হয় রাশিয়ার চিঠি-তে কবির সেই সাবধানবাণী— ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব টিকবে না। কোথায় যেন আশ্চর্য ভাবে মিলে গেল ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের অমোঘ উচ্চারণের সঙ্গে ১৯৮০ সালে আলেকজান্দার চিচেরভের সতর্কবাণী। ১৯৮০ সালে প্রবীণ রুশ ইতিহাসবিদের বক্তব্যকে আমল দিতে মন সায় দেয়নি। ১৯৯১ সালে তাকে মান্যতা দিতে হল।