নির্ভয়া তহবিল’, ‘ওয়ান স্টপ সেন্টার’ ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা শুনেছি। ভারতের মহিলাদের পথঘাটে নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নাকি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ আরও এক উদ্যোগ করেছেন। লোকাল ট্রেনের মহিলা যাত্রীদের জন্য একটি টেলিফোন নম্বর নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যাতে রাত আটটার পর মুশকিলে পড়লে তাতে ফোন করে মেয়েরা সাহায্য পেতে পারেন। এর আগে এমন সব প্রকল্প বা ফোন নম্বর মহিলাদের দরকারে যথার্থ ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে, এমন উদাহরণ হাতে গোনা। কাজেই পথঘাটে নিরাপত্তাহীন ভারতীয় মেয়েরা আজও নির্যাতনের শিকার হন। প্রতি ষোলো মিনিটে এ দেশের এক জন নারী ধর্ষিত হন। অনেকে খুনও হয়ে যান। বিশ্বের অনেক দেশই ভারতকে ‘ধর্ষণের রাজধানী’ (যদিও এই নিয়ে বিতর্ক আছে) বলতে শুরু করেছে। তারা এই দেশকে নারীর পক্ষে এমন বিপজ্জনক মনে করে যে, এখানে একা পর্যটন করতেও মেয়েদের নিষেধ করে।
কয়েক গুচ্ছ সরকারি শপথ এবং আয়োজনের পরও কেন আমাদের দেশ মেয়েদেরকে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে পারে না? এ দেশে যাঁরা আইন প্রণয়ন করেন, নারী নিরাপত্তার স্লোগান তুলে ভোটে লড়েন সেই সব নেতা, মন্ত্রী, রাজনীতিকরা কি ভারতীয় নারীর নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে সত্যি চিন্তিত? ‘রক্ষক’-এর দায়িত্ব নেওয়া স্বনিযুক্ত অভিভাবক অথবা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত মহামহিমগণ ‘ভক্ষক’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন বা হওয়াকে সমর্থন করছেন, এ অভিযোগ কম নয়। লোকসভায় ৫৪৩ জন সদস্যের মধ্যে ২৩৩ জনের বিরুদ্ধেই অপরাধমূলক কাজের লিখিত অভিযোগ— যার মধ্যে ধর্ষণ বা নারীনির্যাতন অনেক। কংগ্রেস, জেডিইউ, ডিএমকে, টিএমসি ইত্যাদি প্রায় সব দলই এই ধরনের অভিযুক্তদের টিকিট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। তবে শাসক দল বিজেপি এ ক্ষেত্রে সোনার মেডেল পেতে পারে। এই দলের ৩০৩ জন সাংসদের মধ্যে এই অভিযোগ রয়েছে ১১৬ জনের বিরুদ্ধে।
প্রসঙ্গত, কাঠুয়া কাণ্ডের সময় ধর্ষকের সমর্থনে আইনপ্রণয়নকারী নিজেই মিছিলে যোগ দেন। উন্নাও কাণ্ডের সাক্ষী ‘দুর্ঘটনা’য় মারা পড়েন। অভিযোগকারিণীর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। হাথরস কাণ্ডে অভিযুক্তদের সামনে আনাই যায় না।
২০১২ সালে দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ড ভারতের নারীর নিরাপত্তাহীন অবস্থাকে সারা বিশ্বের সামনে বেআব্রু করে দিয়েছিল। দেশময় প্রতিবাদ আন্দোলনের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। সে বছরই খাপ পঞ্চায়েত নেতা জীতেন্দ্র ছত্তর বলেছিলেন, “আমার মতে ফাস্টফুড খেলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।” পরের বছর বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেছিলেন, ধর্ষণ হল “মেয়েদের অধিকারের সীমানা অতিক্রম করার মূল্য।” আশারাম বাপু রীতিমতো ‘আধ্যাত্মিক’ স্বরে বলেছিলেন, “দিল্লির ধর্ষণের শিকার মেয়েটি যদি ধর্ষকদের ‘ভাই’ সম্বোধন করতেন, ধর্ষণ হতই না।” তিনি আবার মেয়েটিকে ধর্ষিত হওয়ার মুহূর্তে ‘সরস্বতী স্তোত্র’ আওড়াতেও পরামর্শ দিয়েছিলেন। সমাজবাদী দলের নেতা আবু আজম বলেছিলেন, “ধর্ষিত হয়ে বেঁচে যাওয়া মেয়েদের ফাঁসি হওয়া উচিত।” আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেন, “ধর্ষণ গ্রামে হয় না, শহরে হয়। আত্মীয় ছাড়া মেয়েদের অন্য পুরুষের সঙ্গে বাইরে বেরোনো বন্ধ করা উচিত।” মধ্যপ্রদেশের আর এক বিজেপি নেতা বাবুলাল গৌর বলেন, “মহিলারা কতখানি ঢেকেঢুকে পোশাক পরেন এবং কত বার মন্দিরে যান, এর উপরেই তাঁদের উপর ঘটা অপরাধের হার নির্ভর করে।” হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওম প্রকাশ চৌটালা বলেন, “মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধ বা ধর্ষণের আসল দাওয়াই হল বাল্যবিবাহ।”
রাজনীতিতে মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন যাঁরা, মহিলা নাগরিকের স্বাধীনতা, স্বাধিকার, মর্যাদা এবং নিরাপত্তার বিষয়টিকে তাঁরাই যদি এমন চোখে দেখেন, লোকাল ট্রেনের মহিলা যাত্রীদের ফোন নম্বর দিয়ে নিরাপদে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার আয়োজনের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। কত জন ধর্ষক শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে, তার মধ্যে কত জনের সাজা হয়— সে সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও সরকারকেই লজ্জা দিয়ে এই মুহূর্তে আমাদের লাভ নেই। কিন্তু আমরা এইটুকু করতে পারি যে, সরকার যাঁরা গঠন করেন, যাঁরা সেই সরকারি দলের স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন— মহিলাদের স্বাতন্ত্র্য ও নিরাপত্তা নিয়ে তাঁরা যাতে এমন বক্তব্য করে পার না পান, সেটা নিশ্চিত করা। ফোন নম্বর দিয়ে, তহবিল গড়ে, মিছিলে নেমে পরিস্থিতি কিছুটা বদলানো যাবে কি না জানা নেই, কিন্তু সেই সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আলোচনা কক্ষের চৌকাঠ থেকে যদি এই বিকৃত মানসিকতার ক্ষমতাধরদের এখনই বিদায় করে না দেওয়া হয়, অন্তত তাঁদের বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ্য প্রকাশটুকু যদি বন্ধ না করা হয়, তা হলে সত্তর-ঊর্ধ্ব দেশের নারী-দিবস পালন অর্থহীন। ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছেই জনগণের তরফ থেকে দাবি রইল— ধর্ষণ বা অন্য অপরাধে অভিযুক্তদের নির্বাচনে প্রার্থী করা বন্ধ হোক।