ফাইল চিত্র।
হাওয়া চলছিল দল বদলের। তার মধ্যেই হঠাৎ পালাবদল বাংলার বিজেপিকে এক চমকপ্রদ বাঁকের মুখে দাঁড় করাল। চমক বলার কারণ এই যে, যাঁর হাতে এ বার দলের ভার পড়ল, সেই সুকান্ত মজুমদার বৃহত্তর রাজ্য রাজনীতিতে কার্যত নবাগত। ফলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পুঁজিও তাঁর খুব বেশি নয়।
বালুরঘাট থেকে গত লোকসভা নির্বাচনে জেতার আগে পর্যন্ত সুকান্তবাবুকে সে ভাবে দলীয় রাজনীতির পরিসরে দেখা যায়নি— সক্রিয়তা তো দূরের কথা! তাঁর ভূমিকা ছিল সঙ্ঘ পরিবার-কেন্দ্রিক। নিজের এলাকায় দীর্ঘ কাল ধরে আরএসএস-এর কার্যকর্তা হিসাবে পরিচিত ছিলেন গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
সাংসদ হওয়ার পরেও দিল্লিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে সঙ্ঘ থেকে যাওয়া পদাধিকারীদের সঙ্গেই তাঁর সখ্য বেশি। যেমন, বি এল সন্তোষ, শিবপ্রকাশ প্রমুখ। মাত্র গত বছর দল তাঁকে উত্তরবঙ্গের যুগ্ম আহ্বায়ক করেছিল। বিয়াল্লিশ বছর বয়সে সেখান থেকে সরাসরি তিনি বিজেপির রাজ্য সভাপতি।
উত্থানের এহেন গতি তাই চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। আরও বিশেষ করে এই জন্য যে, সুকান্তবাবু এলেন এমন এক সময়ে, যখন বিজেপির পালে হাওয়া কমার প্রবণতা স্পষ্ট। প্রকাশ্যে এসে পড়ছে মতভেদ। অতএব কাঁধে সেই বোঝা নিয়ে পদে বসতে হল তাঁকে।
মুখে যত যা-ই বলুন, এই পরিস্থিতিতে তাঁকে অঙ্ক কষতে হবে দলের ভিতরের সমীকরণ নিয়ে। যেখানে আছে নির্ভরতার প্রশ্ন। পাশাপাশি থাকবে তাঁকে ‘কব্জায়’ রাখার চেষ্টাও। সুকান্তবাবুর সামনে এটা এক ধরনের পরীক্ষাও বটে।
সোজা কথায় বললে, এখনকার রাজ্য বিজেপিতে ‘সমান্তরাল ক্ষমতাকেন্দ্র’ হয়ে ওঠা বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে নতুন রাজ্য সভাপতির ‘বোঝাপড়া’ এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে। কারণ, বিজেপির ‘আকালের বাজারে’ নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ভোটে জিতে আসা শুভেন্দু এখন দিল্লির দরবারে দৃশ্যতই মান্যতা পেয়েছেন। রাজ্যেও তার প্রভাব পড়েছে।
তবে সেই আলোচনার আগে প্রায় ছ’বছর ধরে রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব পালন করে যাওয়া দিলীপ ঘোষকে নিয়ে কিছু বলা দরকার। প্রথমেই বলব, নির্বাচিত পদে মেয়াদ ফুরোনোর আগে তাঁকে সরানোর সিদ্ধান্ত আকস্মিক মনে হলেও একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। বস্তুত দিলীপবাবুকে সরানোর উদ্যোগ চলছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। কেউ একটু জোরে, কেউ বা নিচু স্বরে তাঁর বিরুদ্ধে দিল্লিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কানও ভারী করছিলেন। এটা দিলীপবাবুর অজানা ছিল না।
মুকুল রায় যত দিন বিজেপিতে ছিলেন, তত দিন দিলীপবাবুর সঙ্গে তাঁর বনিবনা হয়নি। বাইরে যা দেখা যেত, সবটাই পোশাকি। কৈলাস বিজয়বর্গীয় তখন মুকুলের অন্যতম ভরসাস্থল। বাবুল সুপ্রিয়ের দিলীপ-বিরাগ তো প্রকাশ্য। এখন শুভেন্দুর সঙ্গে দিলীপ ঘোষের সম্পর্ক প্রকৃতপক্ষে কতটা ‘মধুর’, বিজেপির ভিতরে-বাইরে সেটাও আলোচনার বস্তু।
তবে এ সবই বাহ্যিক উপকরণ। আসলে বিধানসভা ভোটে দলের ভরাডুবি এবং তার জেরে পরবর্তী কালে ‘ঘর ওয়াপসি’-র দায় চাপানোর জন্য রাজ্য সভাপতি দিলীপবাবুকে বেছে নেওয়া ছিল বিজেপির সামনে একমাত্র ‘বিকল্প’। না হলে আঙুল উঠতে পারে দিল্লির দিকে। কারণ, দরজা হাট করে দল ভাঙানোর কৌশল থেকে শুরু করে গোটা ভোট-পর্ব, সবই তো হয়েছে দিল্লির শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছায়। কিন্তু কে বলবে সেই কথা? ঘণ্টা বাঁধবে, তেমন হিম্মত কার! অতএব ‘দিলীপ-হটাও’ হল এর সহজ সমাধান।
যেমন, নতুন সভাপতি সুকান্তবাবু তাঁর প্রথম সাংবাদিক বৈঠকে বলেছেন, স্ট্র্যাটেজিতে ভুল ছিল বলে ভোটে সাফল্য আসেনি। কিন্তু কোথায় ভুল, সেটা বিশদ করা হয়নি। তা হলে নিশ্চয় বোঝা যেত, দল ভাঙানোর কাজে সাবেক আরএসএস দিলীপবাবুর মনের সায় আদৌ ছিল কি না।
এ কথা ঠিক যে, দিলীপবাবুর অসংযত ও বিতর্কিত কথাবার্তা, শাসানি, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ইত্যাদি তাঁকে বহু মানুষের কাছে যথেষ্ট অপ্রিয় করে তুলেছে। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের সভাপতির মুখে বিভিন্ন অশোভন উক্তি এবং অর্থহীন বক্তব্য সুবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ মানতে পারেন না। এ সব নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁকে সতর্ক করলেও তিনি শুধরাননি। নেতৃত্বও তখন টুঁ শব্দটি করেননি।
আসলে এটা ঘটনা যে, দিলীপ ঘোষের আমলেই বিজেপি বাংলায় নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ফলে দল সেটা মেনে নিয়েছে। তিনিও অকপটে বলতে পেরেছেন যে, ভোটে জিতে আসতে না পারলে কি আদর্শ ধুয়ে জল খাব!
দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এক জন সহ-সভাপতির পদে তাঁর পুনর্বাসন শেষ পর্যন্ত কী চেহারা পাবে, সেটা সময়ে ভাল করে বোঝা যাবে। আপাতত মুকুল রায়ের মতো এক জনের উদাহরণ সামনে রয়েছে। ওই পদে থেকে যিনি জানতেই পারেননি তাঁর দায়িত্ব বা করণীয় কী!
যা-ই হোক, সে সব পরের কথা। আপাতত সুকান্ত-প্রসঙ্গে ফেরা যাক। তাঁকে রাজ্য সভাপতির পদে তুলে আনা হল কেন? বিজেপি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অনেকেরই বক্তব্য, ভোটে পরাজয়ের পরে রাজ্যে দলের ‘হতোদ্যম’ অবস্থা কাটাতে নবীন, অবিতর্কিত, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির এক জনকে সামনে রাখার প্রয়োজনীয়তা বুঝেছে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সঙ্ঘও এ বিষয়ে একই কথা বলে। সে ক্ষেত্রে সুকান্ত মজুমদার হলেন সর্বসম্মত সেই নাম।
গুঞ্জন আছে, এর নেপথ্যে নাকি শুভেন্দুর সুপারিশ ‘কাজ’ করেছে। তাঁর সঙ্গে সুকান্তের সম্পর্কও বেশ ভাল। তবে যত দূর জেনেছি, একা শুভেন্দু নন, সুকান্তের নাম চূড়ান্ত করার আগে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দিলীপ ঘোষেরও মতামত জানতে চেয়েছিলেন। কিছু দিন আগে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডা যখন তাঁকে দিল্লিতে বৈঠকে ডাকেন, তখন সেখানে সুকান্তবাবুর নাম বলে আসেন দিলীপবাবুও।
কিন্তু অন্যান্য মাপকাঠিতে অনেকের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও রাজ্যে প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষনেতা হওয়ার জন্য রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং উপযুক্ত সাংগঠনিক দক্ষতা অর্জন করা চাই। তার জন্য সব জেলাকে হাতের তালুর মতো চিনতে হয়। সুকান্তকে সবার আগে সেটা করতে হবে।
তবে এটা রাতারাতি সম্ভব হতে পারে না। আর সেখানেই শুভেন্দুর ভূমিকা এখন অর্থবহ হয়ে উঠবে বলে মনে হয়। ঘটনাচক্রে আজ রাজ্য বিজেপিতে শুভেন্দু এমন এক জন নেতা, তৃণমূল থেকে আসার আগে যাঁর রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক সব অভিজ্ঞতা হয়েছে। জেলাগুলিও তিনি অনেকের চেয়ে ভাল চেনেন।
বিজেপিতে এসে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা হয়ে তিনি ইতিমধ্যে দলীয় সভাপতির সমান্তরালে একটি স্বতন্ত্র অবস্থানও তৈরি করতে সক্ষম। দিলীপ ঘোষ সভাপতি থাকাকালীন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি বেশ বোঝা যেত। বিজেপির মতো একটি ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ’ দলে এটা উচিত কি না, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে অনেকের ধারণা, বিজেপির শীর্ষমহল ‘জেনে-বুঝে’ শুভেন্দুকে সেই পরিসর দিচ্ছেন। তিনিও তার ‘সদ্ব্যবহার’ করছেন।
এই অবস্থায় বয়স ও অভিজ্ঞতায় নবীন সুকান্ত মজুমদার অন্য কোনও পথে হেঁটে ‘ঝুঁকি’ নিতে যাবেন কেন? বরং স্বাভাবিক ভাবেই চাইবেন শুভেন্দুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ নির্ভরতার সম্পর্ক তৈরি করে নিতে। যার ইঙ্গিত সুকান্তবাবু প্রথম দিনই দিয়ে রেখেছেন।
নতুন কমিটি গঠন থেকে দল পরিচালনার নানা স্তরে শুভেন্দুর গুরুত্ব তাই আগামী দিনে বাড়বে বই কমবে না। পর্যবেক্ষকদের নজর থাকবে আর এক জনের দিকেও। তিনি অমিতাভ চক্রবর্তী। সঙ্ঘ তাঁকে রাজ্য বিজেপিতে সাংগঠনিক সাধারণ সম্পাদক করে পাঠিয়েছে।