হিন্দু আধিপত্যের রহস্য
BJP

বিজেপি শাসনে যাঁরা বিপন্ন, তাঁরাও যোগীকে ভোট দিলেন কেন

যে সরকার এই দুর্দিনে মাগনা একটু আটা আর নুন খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাকেই ভোট দেবেন। যে খাওয়াচ্ছে, তাকে ভোট দেব না?

Advertisement

রাজর্ষি দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২২ ০৫:৫০
Share:

উল্লাস: উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়লাভের পর লখনউয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমর্থকদের উদ্‌যাপন। পিটিআই

দেখতে দেখতে এসে পড়লাম হিন্দু রাষ্ট্রে। বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয়ের অন্য অর্থ খোঁজা মানে ভাবের ঘরে চুরি করা। চারটি রাজ্যের জনতা যে স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে, তাতে যেমন ধর্মনিরপেক্ষ এবং সংখ্যালঘু মানুষের মনে আশঙ্কা বেড়েছে, তেমনই উচ্ছ্বসিত গেরুয়া শিবির। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে— যাকে হিন্দু রাষ্ট্রের প্রয়োগশালা বলা যায়— সেখানে কট্টরবাদী যোগীর দু’বার জিতে ফেরার গুরুত্বকে কোনও ভাবেই খাটো করা যায় না। এই প্রদেশেই ঘটে গিয়েছে হাথরস, উন্নাওয়ের ঘটনা, গঙ্গাবক্ষে ভেসেছে অগণিত শব, অক্সিজেনের অভাবে মাথা কুটেছেন মধ্যবিত্ত রোগীরাও, বেকার যুবকরা প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের মার খেয়েছেন সে দিনও। প্রায় এক বছর ধরে পশ্চিম প্রান্তে আন্দোলন চলেছে কৃষকদের, হার মানতে বাধ্য হয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।

Advertisement

এমন নয় যে কৃষি আইন, মূল্যবৃদ্ধি, বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবা, চাকরির হাহাকার বা সরকারি মদতপুষ্ট হিংসা নিয়ে জনতার ক্ষোভের কোনও রাজনৈতিক চেহারা ছিল না। এমনটাও নয় যে, ইতস্তত প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন থিতিয়ে যেতেই বিজেপি অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছিল। যোগীর বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে তৈরি ছিল অখিলেশ যাদবের প্রতিস্পর্ধী জোট। শাসক দলের নজরদারি এড়িয়ে নেপথ্যে দানা বেঁধেছে জাঠ-যাদব-মুসলিম-দলিত-ওবিসির তলার থাকের বোঝাপড়া। ভোটের মুখে বিজেপির জোট ছেড়েছিলেন বেশ কিছু ডাকাবুকো নিম্নবর্গের নেতা। পশ্চিমবঙ্গের পর ফের স্নায়ুচাপের ছাপ ছিল বিজেপির চালচলনে। বিভিন্ন সামাজিক মঞ্চ থেকে বিদ্বেষী বয়ান ও মেরুকরণের হুমকিতে আগের মতো আগুন জ্বলে ওঠেনি। হিন্দিভাষী গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে পাওয়া গিয়েছে গ্রামগঞ্জে জনগণের হাতে বিজেপি নেতাদের খেদিয়ে দেওয়ার ঘটনা। বাহুবলী মন্ত্রীর গাড়ির তলায় চাষি চাপা পড়ার পর স্বচ্ছন্দ লাগেনি আইনশৃঙ্খলা নিয়ে যোগীর ন্যারেটিভ। সমাজমাধ্যমে মাঝে মাঝেই ঢেউ তুলেছে সমাজবাদীর পালে হাওয়ার ঝোঁক।

নির্বাচনের ফলাফল বলে দিল, এই সমস্ত লক্ষণ ছাপিয়ে ভোটবাক্সে বিজেপির সমর্থন বেড়েছে বই কমেনি। হ্যাঁ, গত বারের তুলনায় প্রায় পঞ্চাশটি আসন কমেছে— কিছু মন্ত্রী, এক জন উপ-মুখ্যমন্ত্রী হেরেছেন, জনা তিনেক প্রার্থীর জমানত বাজেয়াপ্তও হয়েছে। কিন্তু সেটুকু ক্ষতি যে কোনও ক্ষমতাসীন দলের কাছে স্বাভাবিক। প্রাপ্তির মাত্রা সেই তুলনায় বিশাল এবং অপ্রত্যাশিত। নিঃসন্দেহে এ বার উত্তরপ্রদেশে ঐতিহাসিক এই জয়ের কারণ এবং ভবিষ্যৎ তাৎপর্য নিয়ে বিশদ আলোচনা প্রয়োজন, জমিতে নেমে রায়শুমারি এবং পরিসংখ্যান বিশদে দেখা দরকার। ইতিমধ্যে কিন্তু দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেগুলি যে কোনও রাজনীতি-সজাগ নাগরিকের পক্ষে একটু তলিয়ে ভাবা জরুরি।

Advertisement

প্রথমত, রাজনৈতিক ডিসকোর্সের ক্ষেত্রে হিন্দুত্বের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রশ্নাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত। গ্রামশি একেই হেজিমনি বলেছেন। এর প্রচণ্ড প্রভাব— ভয়াবহ আর্থিক অধোগতি, প্রশাসনের চূড়ান্ত ব্যর্থতা, মানুষের দুর্দশাকে ভোটের ময়দানে চাইলেই পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে।

আধিপত্যের আর এক মোক্ষম বৈশিষ্ট্য হল যে ভাবে বিরোধী পক্ষের পাল্টা চাল, জনসংযোগ বা রাজনৈতিক সঙ্কেতগুলিও হিন্দুত্বের বয়ান-নির্ভর হয়ে পড়েছে। রাহুল গান্ধীর মন্দির দর্শন বা কেজরীওয়ালের হনুমান চালিশা পাঠ, বা মুসলিম তোষণের অভিযোগ এড়াতে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের থেকে অখিলেশের সতর্ক দূরত্ব— প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিরোধীরা ঠিক সেই ব্যাকরণটি মেনে চলেছেন, যেটা হিন্দুত্বের হাতে গড়া। এ বারের বিধানসভায় বোঝা গিয়েছে যে, এ নির্মাণের শিকড় আরও কত গভীরে প্রসারিত। এখনও অবধি প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে পরিষ্কার যে, নির্বাচনে বিজেপির প্রথম সারির ভোটারদের মধ্যে ছিলেন রাজপুত-ব্রাহ্মণ ছাড়াও জাতপাত ছাপিয়ে সাধারণ মহিলাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, এবং অ-জাটভ/ চামার বা নিচু থাকের দলিত এবং ওবিসিদের তলার সারিগুলি। অথচ, গত কয়েক বছরে অতিমারির কোপ, বেকারত্ব, উপেক্ষিত সংরক্ষণ, উচ্চবর্ণের অত্যাচার, সরকারি উদাসীনতার খতিয়ানে দেখা যায় যে, এই মানুষগুলিই সবচেয়ে বেশি পীড়িত। কিন্তু ভোটের বেলায় জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি তাঁদের কাছে গৌণ হয়ে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, অনেক বেশি জরুরি ভূমিকা নিয়েছে এক আশ্চর্য আত্মপ্রবঞ্চনা: আমরা নাহয় একটু কষ্টে আছি, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী অমুক সম্প্রদায়কে কেমন আচ্ছা টাইট দিয়ে রেখেছেন! সমাজবাদী সরকার হলে ওরাই আবার সমাজের মাথায় চড়ে বসবে। ওরা জব্দ আছে বলেই না আমরা সুরক্ষিত। বহুজন সমাজ পার্টির বাইশ শতাংশ ভোটের অনেকটাই চলে গেছে তাই পদ্মফুলের বোতামে। বাজারে গুজব, এ বিষয়ে বিজেপির সঙ্গে বহেনজির বোঝাপড়া ভোটের আগেই সারা হয়ে গিয়েছিল, তাই কিছু নেতা জোট ছেড়ে চলে গেলেও বিজেপি বিচলিত হয়নি।

কিন্তু ভারতের অন্যান্য প্রান্ত থেকে এটা পরিষ্কার যে, নিচু জাত বা আদিবাসী, তফসিলি জনজাতির সঙ্গে হিন্দুত্বের এই মেলবন্ধন শুধুমাত্র উপরতলার লেনদেনে সীমাবদ্ধ নয়। স্থানীয় এবং লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে হিন্দুত্বকে কী ভাবে বিভিন্ন জমিতে বুনে দেওয়া যায়, তার পিছনে সঙ্ঘের দীর্ঘ যোজনা রয়েছে। এই হিসাবেই সিধু কানহো, বিবেকানন্দ আর আম্বেডকর আজ গেরুয়া পরম্পরায় গডসে এবং পটেলের সঙ্গে একই আসনে পূজিত হন।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল ভোটের ময়দানে নতুন এক রাজনৈতিক চরিত্রের আবির্ভাব— এই নির্বাচনে যার নাম ‘লাভার্থী’। অনেকেই বলবেন যে, এর মধ্যে নতুন কিছু নেই— রাষ্ট্র বরাবরই কিছু গরিব মানুষকে ছোট ছোট ভর্তুকি দিয়ে, রেশনের বন্দোবস্ত করে, একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করে রেখেছে। ফলে এঁরা কাজকারবার করতে তেমন আগ্রহী নন। বরং যখন যে দলের প্রয়োজন তাদের হয়ে রাস্তাঘাটে টুকটাক কাজ করে দেন, নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে থাকেন, মিটিং-মিছিল হলে ভিড় বাড়ান। সমাজতাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, এঁরা পলিটিক্যাল সোসাইটির কুশীলব। আজকের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি আর পপুলিস্ট রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এ রকম চরিত্র অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, লাভার্থী বিষয়টি ঠিক এ রকম নয়। সুবিধাভোগী শ্রেণির মধ্যে এক ধরনের সংবিধান-বহির্ভূত অধিকারবোধ আছে— তারা হিসাব চায় সরকারের থেকে; দলগুলির থেকে সময় সময় তারা সমর্থনের বিনিময়ে সুযোগ সুবিধা নিয়ে থাকে। মোহভঙ্গ হলে তারা পাল্টা দল সমর্থন করে। কিন্তু লাভার্থীর মধ্যে কোনও অধিকারবোধ নেই, সরকারের জবাবদিহি শোনার চাহিদা নেই, শাসনের হিসাব মেলানোর সাহস নেই— রাগ, দুঃখ, অভিমান, অভিযোগ কিছুই নেই, কোনও রকম ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ নেই। শুধু আছে কোনও মতে বেঁচে থাকতে পারার বাসনা, এক বেলা এক মুঠো খেতে পাওয়ার জন্য অসীম কৃতজ্ঞতা। হিন্দি সাংবাদিক অজিত অঞ্জুমের একটি প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে এ রকম এক হতদরিদ্র বৃদ্ধ দম্পতিকে। একটি বেতো ঘোড়ায় টানা ঠেলা চড়ে বহু কষ্টে ওষুধ কিনে ফিরছেন শহর থেকে শহরতলিতে। সাংবাদিককে তাঁরা জানালেন, যতই কষ্ট হোক না কেন, ভোট দেওয়ার সময় নিমকহারামি করবেন না। যে সরকার এই দুর্দিনে মাগনা একটু আটা আর নুন খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাকেই ভোট দেবেন। যে খাওয়াচ্ছে, তাকে ভোট দেব না?

এ বারের নির্বাচনে অন্য সব প্রশ্ন ছাপিয়ে এটাই সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। এটাই লাভার্থীর পরিচয়— লাভ বলতে যাঁদের একবেলা খাওয়াটুকু জুটেছে। এই শ্রেণি নিশ্চয়ই এক দিনে তৈরি হয়নি: নোটবন্দি, জিএসটি, অতিমারি, লকডাউন— ধাপে ধাপে এমন একটা জনসংখ্যা আজকে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দিন কাটাচ্ছে। বিকাশ মানে তাঁদের কাছে বড় জোর সামনের ক’টা দিন বেঁচেবর্তে থাকা। ভোট দেবেন কাকে, সেই সিদ্ধান্ত তাঁরা এতটাই অসহায়, নিঃসম্বল, বিপন্ন অবস্থান থেকে নিয়েছেন। এঁরাই হিন্দুত্বের আধিপত্যের গোপন রহস্য— আগামী দিনের গণতন্ত্রে এঁদের জায়গা কোথায় দাঁড়াবে, সেটা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

সেন্টার ফর পলিটিক্যাল স্টাডিজ়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement