পরিবেশ সুরক্ষা বা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলি আর কেবল বিজ্ঞানীদের আলোচনায় কিংবা পরিবেশ আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই। পরিবেশ সঙ্কটের প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকায়— আমপান বা ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ে, বৃষ্টির খামখেয়ালিপনায় নষ্ট হচ্ছে ফসল, শহরের দমবন্ধ হয়ে আসছে দূষণে। পরিবেশের অবক্ষয় রুখতে সরকার কিছু করবে, এই প্রত্যাশা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। পশ্চিমের দেশগুলিতে, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী, সেখানে জনমতের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে সরকার বেশ কিছু নীতি নিয়েছে, যা দূষণকারীদের সংযত করেছে, ক্ষতিকর রীতি-অভ্যাসকে সংশোধন করতে বাধ্য করেছে। ভারতে দেখা যাচ্ছে, নাগরিকদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়লেও, সরকারকে এই বিষয়ে উদ্যোগী করতে পারেনি নাগরিক সমাজ।
হয়তো মানুষ ভাবছে, সরকার নিশ্চয়ই নিজের ভূমিকার কথা মনে রেখে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা করছে। সত্যিই কি তাই? গত ছয়-সাত বছরের ইতিহাস দেখাচ্ছে, দেশের আইন পরিবেশ বাঁচাতে যে সব রক্ষাকবচ তৈরি করেছিল, সেগুলো ক্রমশ আলগা, দুর্বল হচ্ছে। যেমন, ২০১৪ থেকে ২০১৯, এই পাঁচ বছরে পরিবেশের উপর শিল্পের প্রভাব মূল্যায়ন করার বিধিতে (এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রুলস, সংক্ষেপে ইআইএ) একের পর এক সংশোধন করেছে কেন্দ্র। মোট সংশোধনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটান্ন। যদিও এর অধিকাংশই জনসাধারণের কাছে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানোর কথা ছিল, কাজের বেলায় তা করা হয়নি— এই তাড়াহুড়োর কারণ নাকি ‘জনস্বার্থ’!
অথচ, যে কোনও প্রকল্প কী প্রভাব ফেলবে পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতিতে, তা নির্ণয় করার জন্য ইআইএ অত্যন্ত জরুরি এক উপায়। পরিকল্পনার স্তরেই তা আগাম জানিয়ে দিতে পারে যে, ওই প্রকল্পের জন্য পরিবেশের কী কী ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। ফলে বোঝা যায় যে, কী করে কুপ্রভাব এড়ানো যেতে পারে, স্থানীয় প্রকৃতি-পরিবেশের উপযোগী করে প্রকল্পের নকশা তৈরি করা যেতে পারে। যে সব প্রকল্প পরিবেশের উপর বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে, যেমন বৃহৎ নদীবাঁধ, খনি কিংবা বড় সড়ক নির্মাণ, সেগুলোর জন্য জনমত নেওয়া আবশ্যক করেছিল ইআইএ, যথেষ্ট নজরদারির ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু গত জুলাই মাসে যে কার্যবিধি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়র) প্রকাশ করেছে কেন্দ্র, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, সে সব বিধি অনেক তরল হয়ে গিয়েছে— জনমত না নিয়েই এখন বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো শুরু করতে পারবে এমন সব বড় প্রকল্প, যা পরিবেশের উপর ছাপ ফেলতে পারে। যে সব সংস্থা অনুমোদন না নিয়েই কাজ শুরু করে ফেলেছে, তাদের প্রকল্প চালিয়ে যেতেও বাধা নেই। বরং, এই সব বিধি লঙ্ঘনকারী প্রকল্পগুলিকে বৈধতা দিতে চায় নতুন সরকারি নিয়ম। বিশেষজ্ঞেরা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে পরিবেশ সুরক্ষার বিধিকে নস্যাৎ করার প্রবণতা বাড়বে। যে কারণে ইআইএ তৈরি হয়েছিল ২০০৬ সালে, সেই উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হতে বসেছে।
সরকারের প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলির আর একটা সমস্যা হল, তা সরকারি কর্তাদের অনেক বেশি ক্ষমতা দিতে চায় প্রকল্প অনুমোদনের ব্যাপারে। সরকারি আধিকারিকদের একটা অংশ যে সহজেই ক্ষমতাশালী, প্রভাবশালী ব্যক্তি আর রাজনৈতিক চাপের কাছে করে, এ কথা কারও অজানা নেই। ফলে এই আশঙ্কা থেকেই যায়, প্রলোভন কিংবা ভয়ের মুখে আধিকারিকরা এমন প্রকল্পকেও অনুমোদন দিয়ে দেবেন, যা পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে।
আপাতত আশা এই যে, আইনের ধোপে সরকারের প্রস্তাবগুলি টিকবে না, তার সুযোগ যথেষ্ট। প্রস্তাবিত সংশোধনগুলি সরকারি বিজ্ঞপ্তির আকারে বার হলে তা কাজে প্রয়োগ হওয়ার আগেই আদালতে চ্যালেঞ্জ করবেন কেউ না কেউ, তা প্রায় নিশ্চিত। পরিবেশ আইনের ক্ষেত্রে ভারতের আদালত সাধারণত সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট তো সম্প্রতি, বিশেষত প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণার অধীনে, কেন্দ্রের কড়া সমালোচনা করেছে বেশ কয়েকটি বিষয়ে। গত জুন মাসে একটি মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, সরকারের প্রতি তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছিলেন যে, পরিবেশ মন্ত্রক ক্রমাগত পরিবেশ বিধি কমজোরি করছে। কী ছিল সেই মামলা? নদী, পুকুরের দূষণ কমাতে অবিলম্বে বর্জ্য পরিশোধন কারখানাগুলিকে উন্নত করার জন্য জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ দিয়েছিল। সেই নির্দেশের বিরোধিতা করে শীর্ষ আদালতে আবেদন করেছিল কেন্দ্র! বেশ কয়েকটি রাজ্যের হাই কোর্টও সাম্প্রতিক কিছু পরিবেশ সংক্রান্ত মামলাতে সরকারের সমালোচনা করেছে।
গত বছর এপ্রিলে শীর্ষ আদালত বলেছিল যে, কোনও প্রকল্প শুরু হয়ে যাওয়ার পরে তার পরিবেশ সুরক্ষা সংক্রান্ত অনুমোদন মেলার ধারণাটিই পরিবেশ-সংক্রান্ত আইনতত্ত্বের বিরোধী। পরিবেশ সুরক্ষার প্রাক্-অনুমোদন না নিয়েই শিল্পের প্রকল্প কাজ শুরু করলে তা অপূরণীয় ক্ষতির সূচনা করবে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই মন্তব্য আদালত করেছিল এমন সময়ে, যখন সরকার ‘ইআইএ ২০২০’ বিধি তৈরি করে ছাড়পত্র দিতে চাইছিল সেই সব শিল্প প্রকল্পকে, যেগুলি পরিবেশের অনুমোদন ছাড়াই শুরু হয়েছিল।
আপাতত পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রথম এবং শেষ ভরসা আদালত। এটা কখনওই কাম্য হতে পারে না। নাগরিক সমাজ যদি সক্রিয় না হয়, কেবল আদালত কতটুকু করতে পারে? পরিবেশের স্বাস্থ্য বজায় রাখার মূল্য চোকাতে হবে নাগরিককেই— সতত সতর্ক থেকে।