opinion

Opinion Piece: প্রমোদ সবন্ত কি গোয়ার দিনের মুখ্যমন্ত্রী, রাতের মুখ্যমন্ত্রী কে

সমুদ্র, বিচ পার্টি, বিদেশি ট্যুরিস্টের ভিড় আর গানবাজনার মিশেলে উন্মুক্ত জীবনের যে ছবি গোয়া আমাদের সামনে তুলে ধরে, আসল ছবি তার চেয়ে আলাদা।

Advertisement

রত্নাবলী রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২১ ১১:০৭
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীর অমৃতভাষণ পড়তে পড়তে অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। গোয়া এমনিতে আমার খুব পরিচিত জায়গা। প্রতিবছরই একবার করে গোয়া যেতে হয়। কারণ, ওখানকার একটা আন্তর্জাতিক কোর্সে আমি পড়াই। কাজেই গোয়ার অনেক কিছুই আমি খুব ভাল করে চিনি-জানি।

Advertisement

বছর তিনেক আগের কথা বলছি। সে বছর আমার তরুণ সহকর্মীরা আমার সঙ্গে গিয়েছিলেন একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে। তা, আমরা গাড়ি করে যাচ্ছিলাম। আমার এক তরুণ মহিলা সহকর্মী গাড়িতে বসে ধূমপান করছিলেন। গাড়িটা একটা ট্র্যাফিক লাইটে দাঁড়িয়েছে। ওমা! ট্র্যাফিক পুলিশ আমার সহকর্মীটিকে রীতিমত আক্রমণ করল! তার বক্তব্য, ‘‘লজ্জা করে না? গাড়িতে বসে সিগারেট খাচ্ছো! মেয়েরা কি সিগারেট খায়?’’ আমরা প্রত্যেকে এত হতভম্ব আর বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম যে কী বলব-কী করব, বুঝে উঠতে পারিনি!

ঘটনাটার কথা বললাম একটা উদাহরণ হিসেবে। আসলে সমুদ্র, বিচ পার্টি, বিদেশি ট্যুরিস্টের ভিড়, প্রচুর আলো আর গানবাজনার মিশেলে উন্মুক্ত জীবনের যে ছবিটা গোয়া সচরাচর আমাদের সামনে তুলে ধরে, আসল গোয়ার ছবি তার চেয়ে অনেকটা আলাদা। আমার এক মনস্তত্ত্ববিদ বন্ধু তখনই জানিয়েছিলেন, আপাত চাকচিক্য আর উদার প্রোগ্রেসিভ জীবনের আড়ালে আসল গোয়া খুবই রক্ষণশীল। তাঁর ওই কথাটা বলার পিছনে একটা কারণও ছিল। সেবার আমি সেক্সুয়ালিটি অর্থাৎ যৌনতার ওপরে একটা সেশন করছিলাম। তিনি সাবধান করে দিয়েছিলেন, যাতে খুব ‘র‍্যাডিকাল’ কথা না বলি। কারণ, তার ফল কী হবে সে ব্যাপারে ওঁরা কেউ খুব নিশ্চিত ছিলেন না। এখন গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য জেনে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, কতটা সত্যি কথা সেদিন সেই সহকর্মী বলেছিলেন!

Advertisement

তবে গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে নেহাত একটা বিচ্ছিন্ন মন্তব্য হিসেবে দেখলে ভুল হবে। দেশের নেতামন্ত্রীরা বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন— যে কোনও শ্লীলতাহানি, যে কোনও ধর্ষণের ঘটনায় আসল দায় কিন্তু মেয়েটির! আর তার সঙ্গেই প্রচ্ছন্ন ভাবে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ধর্ষণ হওয়াটা যেন নেহাতই একটা স্বাভাবিক ঘটনা। যেন ধর্ষণ রুখতে প্রশাসনের কোনও দায়ই নেই! অথচ এই ঘটনা সম্পূর্ণভাবেই প্রশাসনিক তথা পুলিশি ব্যর্থতার নজির। বাবা-মাকে উপদেশ না দিয়ে গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী যদি নিজের প্রশাসনিক দায়ভারটা নিতেন, তা হলে হয়তো একটা ইতিবাচক দিক আমরা দেখতে পেতাম। হয়তো সকলে জানেন। তবু একবার জেনে নেওয়া যাক, ঠিক কী বলেছেন গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী প্রমোদ সবন্ত। একটি ১৪ বছরের মেয়ে বেশি রাতে বাইরে কী করছিল, সে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। আর তার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন তার বাবা-মায়ের ওপর। পরে নানা মহল থেকে চাপের মুখে পড়ে নিজের বক্তব্যের একটা ব্যাখ্যা তিনি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে চিঁড়ে আর ভিজছে না।

যৌনতাকে রাতের অন্ধকারের সঙ্গে এক করে দেখার একটা প্রবণতা আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে রয়েছে। আমরা মনে করি, যে কোনও ধরনের যৌন ক্রিয়াকলাপ মানেই রাত! তারই প্রতিফলন দেখতে পাই গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে। মেয়েটি রাতে বেরিয়েছিল কেন! অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী বলতে চাইছেন, দিনের বেলায় বেরোলে এমন কোনও ঘটনা ঘটত না। তা হলে কি উনি নিজেকে শুধু দিনের বেলার মুখ্যমন্ত্রী বলতে চাইছেন? রাতের ঘটনাক্রমের ব্যাপারে ওঁর কি কোনও প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা নেই? তা হলে রাতের কার্যকলাপ, রাতের অপরাধের দায়ভার কার?

একটি ১৪ বছর বয়সের মেয়ে মানে নাবালিকা আর তাই তার ব্যাপারে বাবা-মায়ের দায় থেকেই যায়— এই যে সরলীকরণটা সবন্ত করার চেষ্টা করেছেন, তার থেকেই উঠে আসে আরও নানা প্রশ্ন। শুধু সবন্ত কেন, সমীক্ষা করলে হয়তো আরও অসংখ্য মানুষের মনের কথা হিসেবে এই বক্তব্যই পাব আমরা। একজন মনোবিদ-সমাজকর্মী হিসেবে আমার বক্তব্য হল, নাবালক-সাবালকত্বের বিষয়টা আমরা ঠিক করি বয়স দিয়ে। এই ধারণাটাও কিন্তু পাশ্চাত্যের একটা চাপিয়ে দেওয়া ধারণা। বাচ্চা কোন বয়সে কেমন আচরণ করবে, তা আমাদের শিখিয়েছে ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজি। দিনের পর দিন চলে আসা এই ধারণাটাকেও এখন চ্যালেঞ্জ করার সময় এসেছে বলে আমি মনে করি। দিল্লির সেই নৃশংস ‘নির্ভয়া-কাণ্ডে’ সবচেয়ে কমবয়সী অভিযুক্তের বয়স ছিল আঠারোর কম। কিন্তু তার কম বয়স তাকে অপরাধ করা থেকে আটকাতে পারেনি। তখনও বলেছিলাম, এখনও বলছি— কেউ কোনও অপরাধ করলে তা হলে বয়সের খাতিরে সে কেন ছাড় পাবে?

আসলে ‘অ্যাডোলেসেন্স’ বা কৈশোরের ধারণাটা গত কয়েক দশকে আমূল পালটে গেছে। আমার সময়ে একজন ১৪ বছরের মন-মস্তিষ্ক যেমন ছিল, এখন কিন্তু তা একেবারেই নয়! আজকের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি সচেতন। দিনকাল-দেশদুনিয়া, নিজের ভালমন্দ সম্পর্কে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। কাজেই রাতে বাড়ির বাইরে বেরোনোর ব্যাপারে একটি ১৪ বছরের মেয়ে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ, এ কথাটা কেন আমরা ধরে নিচ্ছি? কাকে নাবালক বা ‘চাইল্ড’ বলব আমরা? এই বিচার কি বয়স দিয়ে হবে? নাকি হবে মনন, বিচারবুদ্ধি, বিবেক দিয়ে? বিশেষত যখন বিভিন্ন ঘটনাক্রম বারবার প্রমাণ করেছে যে, ধর্ষণ এমন একটি বিষয় যেখানে ভিক্টিমের বয়স, পোশাক, এগুলো কোনও মাপকাঠিই নয়?

আরও একটা কথা বলতে বলতে আমরা ক্লান্ত! যে কোনও শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের ঘটনায় কেন বারবার ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ বা ‘ভিক্টিম শেমিং’-এর মুখোমুখি হতে হবে আমাদের? কেন সেই নিরাপত্তার জায়গাটা তৈরি করা যাচ্ছে না, তার উত্তর তো দিতে হবে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানকেই! সেটা না করে বারবার আহত মেয়েটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়ে ধর্ষকদের হাতই পুষ্ট করছেন দেশের নেতা-মন্ত্রীরা। আর একই সঙ্গে দেখিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের কুৎসিত পিতৃতান্ত্রিক মুখ। যেখানে মেয়েদের থাকার কথা পুরুষের পায়ের নীচে। সেই অতল খাদ থেকে নারীকে মুক্ত করতে আরও সংলাপ, আন্দোলন জরুরি।

(লেখক মনোবিদ এবং সমাজকর্মী। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement