সিএএ-র প্রতিবাদ করে নি:শর্ত নাগরিকত্বের দাবিতে বনগাঁ-বাগদা সড়ক অবরোধ করল মতুয়ারা - মঙ্গলবার দুপুরে হেলেঞ্চায়
মায়াবতী তখন উত্তরপ্রদেশের গদিতে। ২০১২ সালের কথা। কিছু দিনের মধ্যেই উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোট। কৃষকদের একটি সম্মেলন উপলক্ষে আলিগড়ে গিয়ে কথা হচ্ছিল এক দোকানদারের সঙ্গে। রাজ্যের হালহকিকত জানতে চাওয়ায় তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “অবস্থা খুব খারাপ। চামারও এখন বুক চিতিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে।”
পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও মানুষ এমন উত্তর শুনলে আঁতকে উঠবেন। দোকানদারের পদবি যাদব। অর্থাৎ তিনি ওবিসি বা অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ। চামার বা জাটভ সম্প্রদায় দলিত, অর্থাৎ তফসিলি জাতিভুক্ত। মায়াবতী নিজে এই জাটভ সম্প্রদায়ের মানুষ। উত্তরপ্রদেশে দলিতদের মধ্যে জাটভদের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। মায়াবতী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন স্বাভাবিক নিয়মেই জাটভদের দাপট বেড়েছিল। সেটাই গাত্রদাহের কারণ। এক জন অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ তাঁর থেকেও বেশি সামাজিক অনগ্রসর, দলিত জাটভদের বুক চিতিয়ে হাঁটা মেনে নিতে পারছিলেন না।
এই পর্যন্ত পড়েই যাঁরা জাটভদের ‘আহা, বেচারা!’ বলবেন, তাঁদের আর্টিকল ফিফটিন ছবি দেখা উচিত। সংবিধানের ১৫তম অনুচ্ছেদ ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ ও জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্যে বাধা দেয়। কিন্তু সিনেমায় তরুণ আইপিএস-এর প্রশ্নের উত্তরে পুলিশের সাব-ইনস্পেকটর কিসান জাটভ বলেছিলেন, তিনিও দলিত। পাসিরাও দলিত। তা বলে জাটভ ও পাসিরা এক নয়। সমাজে চামার বা জাটভদের স্থান পাসিদের অনেক উপরে। জাটভরা পাসিদের ছোঁয়া খাবার মুখেই তোলে না। অযোধ্যার রামমন্দির যে লোকসভা কেন্দ্রের আওতায়, সেই ফৈজাবাদে বিজেপিকে হারিয়ে হইচই ফেলে দেওয়া সমাজবাদী পার্টির নেতা অবধেশ প্রসাদ এই পাসি সম্প্রদায়েরই মানুষ। উত্তরপ্রদেশের দলিতদের মধ্যে পাসিরা জাটভদের থেকে সংখ্যার জোরে, দাপটে অনেক পিছিয়ে।
এক সপ্তাহ আগে সুপ্রিম কোর্টের সাত বিচারপতির বেঞ্চ সমাজের ঠিক অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাতেই আলো ফেলেছে। শীর্ষ আদালত বলেছে, তফসিলি জাতি বা এসসি এবং জনজাতি বা এসটি-দের মধ্যে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলিকে চিহ্নিত করে পিছিয়ে পড়া জাতিগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে। সংরক্ষণে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। অর্থাৎ, সংরক্ষণের মধ্যে সংরক্ষণ। কোটার মধ্যে কোটা। এসসি, এসটি-র তালিকায় থাকা দলিত, জনজাতিদের সব সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থান এক নয়। সুতরাং এসসি, এসটি-র মধ্যে শ্রেণিবিভাগ করে সংরক্ষণের মাপকাঠিও তেমনই হওয়া উচিত বলে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের চার বিচারপতি আরও একটি বৈপ্লবিক রায় দিয়েছেন। তা হল, এসসি, এসটি-দের মধ্যে যাঁরা ইতিমধ্যেই সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েছেন, যাঁরা বড় সরকারি পদে রয়েছেন, যাঁদের আয় যথেষ্ট, তাঁদের চিহ্নিত করে পরবর্তী প্রজন্মকে সংরক্ষণের সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া। এই ‘ক্রিমি লেয়ার’-এর নীতি এত দিন শুধুমাত্র ওবিসি-দের ক্ষেত্রে ছিল। সুপ্রিম কোর্ট এসসি, এসটি-দের ক্ষেত্রেও একই নীতি চাইছে। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পরে কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি-র মতো দলগুলি নতুন করে আর্থ-সামাজিক জাতগণনার দাবি তুলেছে। কারণ এই গণনা থেকেই বোঝা সম্ভব, কোন জাতের মানুষ আর্থ-সামাজিক দিক থেকে কী অবস্থানে রয়েছেন।
কেন্দ্রের ও রাজ্যের শাসক দল, দুই শিবিরই এ নিয়ে চুপ। রাজনৈতিক ভাবে বিজেপি কোনও দিনই জাতগণনা নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নিতে চায়নি। আর ইন্ডিয়া মঞ্চ জাতগণনার পক্ষে দাবি তুললেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার থেকে দূরত্ব রেখেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায় থেকে জাতগণনা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রাখলেও বিজেপি রাজনৈতিক ভাবে দলিত, ওবিসি-দের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ করে ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করেছে। যেমন, উত্তরপ্রদেশে এসসি-দের জন্য যাবতীয় সুবিধা জাটভরা নিয়ে যাচ্ছে বলে ক্ষোভ রয়েছে। সেই ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে বিজেপি জাটভ ছাড়া অন্যান্য দলিত সম্প্রদায়ের ভোট পকেটস্থ করেছে। একই ভাবে ওবিসি সংরক্ষণের সুবিধার বেশিটাই যাদবরা পকেটে পুরেছে বলে ক্ষোভকেও বিজেপি কাজে লাগিয়েছে। সেখানেও বিজেপি যাদব ছাড়া অন্য ওবিসি-দের নিজের ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে গড়ে তুলেছে।
পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গেও তফসিলি জাতিভুক্ত রাজবংশী, মতুয়া বা নমশূদ্রদের আলাদা ভাবে মন জয় করার চেষ্টা করেছে। ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৩.৫ শতাংশ। প্রায় ২ কোটি ১৪ লক্ষ। এর মধ্যে রাজবংশীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তফসিলি জাতিদের মধ্যে প্রায় ১৮.৪ শতাংশ। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার-সহ উত্তরবঙ্গের পাঁচটি জেলার ২০টি লোকসভা কেন্দ্রের ফলাফল নির্ধারণ করতে পারেন রাজবংশীরা। তাঁদের সমর্থন নিয়েই ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি উত্তরবঙ্গে দুর্দান্ত ফল করেছিল। এখন তৃণমূল সেই ভোটে কিছুটা হলেও ধাক্কা দিয়েছে। উত্তরবঙ্গের হারানো জমি ফিরে পেতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে গিয়ে বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ অনন্ত মহারাজের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন।
রাজবংশীদের পরেই পশ্চিমবঙ্গে তফসিলি জাতিভুক্তদের মধ্যে মতুয়া বা নমশূদ্রদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। রাজ্যের তফসিলি জাতিভুক্ত জনসংখ্যার প্রায় ১৭.৪ শতাংশ মানুষ এই মতুয়া জনগোষ্ঠীর। মূলত উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়ায় মতুয়াদের বাস। বিজেপির মজবুত ভোটব্যাঙ্ক। লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল এ বারও বিজেপির এই মতুয়া ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে পারেনি। মতুয়াদের ঠাকুর পরিবারের শান্তনু ঠাকুরকে এ বারও কেন্দ্রে মন্ত্রী করা হয়েছে। তৃণমূল বাগদা উপনির্বাচনে ঠাকুর পরিবারের মধুপর্ণা ঠাকুরকে প্রার্থী করে বিধানসভায় জিতিয়ে এনেছে ঠিকই, কিন্তু তিনি তৃণমূলের মতুয়া-মুখ হয়ে বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে ধাক্কা দিতে পারবেন কি না, তা ভবিষ্যৎ বলবে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রধান দলগুলি রাজনৈতিক ভাবে তফসিলি জাতির মধ্যে শ্রেণিবিভাগ করে তার রাজনৈতিক সুবিধা তোলার চেষ্টা করেছে। এ দিকে এখনও রাজ্যের বহু মানুষই গর্বের সঙ্গে বিশ্বাস করেন, উত্তরপ্রদেশ-বিহারের মতো পশ্চিমবঙ্গে জাতপাতের রাজনীতি চলে না। রাজ্যের শাসক ও প্রধান বিরোধী দল তাঁদের ভুল প্রমাণিত করেছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যখন বলছে, তফসিলি জাতির মধ্যে কোন শ্রেণি বেশি পিছিয়ে রয়েছে, তা চিহ্নিত করতে হবে, তখন শাসক, বিরোধী সব দলই চুপ।
বিজেপি রাজবংশী ভোটের কথা মাথায় রেখেই ২০২৩-এ অনন্ত মহারাজকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার আগে থেকেই রাজবংশীদের মন জিততে রাজবংশী উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি করেছেন। রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমি তৈরি হয়েছে। পঞ্চানন বর্মার জন্মদিনে ছুটি ঘোষণা হয়েছে। মতুয়াদের ভোট জিততে তৃণমূল ঠাকুর পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক ভাবে রাজবংশী, মতুয়ারা কোথায় রয়েছেন, তা জানতে হলে জাতগণনা প্রয়োজন। তাতে তৃণমূল রাজি নয়। রাজ্যে সরকারি চাকরিতে তফসিলি জাতি, জনজাতি, ওবিসিদের কতখানি প্রতিনিধিত্ব, তা জানতে সরকারি কর্মচারীদের জাতগণনা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৬ সালের পরে সেই সমীক্ষাও হয়নি।
জাতীয় স্তরে জাতগণনায় বিজেপিও রাজি নয়। কারণ জাতগণনা হলে দেখা যেতে পারে, দেশের জনসংখ্যায় ওবিসি-দের ভাগ প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। তখন ‘জিতনি আবাদি, উতনা হক’-এর দাবি মেনে জনসংখ্যার অনুপাতে ওবিসি সংরক্ষণের দাবি উঠবে। এখন ওবিসিদের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ রয়েছে। নরেন্দ্র মোদী নিজে ওবিসি। বিজেপির পক্ষে ওবিসি-দের বাড়তি সংরক্ষণের দাবি খারিজ করা সম্ভব নয়। আবার তা মানতে গেলে উচ্চবর্ণের ক্ষোভের মুখে পড়তে হবে। তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব বলছে, জাতগণনা হলেই বিজেপি মেরুকরণের চেষ্টা করবে। প্রশ্ন হল, আর্থ-সামাজিক জাতগণনা না হলে কী ভাবে জানা যাবে, রাজ্যের রাজবংশী, মতুয়া, পৌন্ড্র, বাগদি, বাড়ুইয়ের মতো তফসিলি জাতির মানুষ, চা, সাঁওতালদের মতো তফসিলি জনজাতির মানুষ কী অবস্থানে রয়েছেন? তাঁরা কি আদৌ সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে সরকারি চাকরি বা উচ্চশিক্ষায় জায়গা করে নিতে পারছেন?
বিজেপি ও তৃণমূল দুই দলই এ বিষয়ে নীরবতা পালনের সুবিধাবাদী অবস্থান নিয়ে ফেলেছে।