হিন্দু শাস্ত্রমতে দুর্গার হাতে অসুরের নিধন অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির জয়ের প্রতীক। তাই সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত বাঙালি সমাজ দুর্গোৎসবের নামে আনন্দে বিভোর। অন্য দিকে, শোকের প্রতীক হিসাবে সাঁওতাল জনজাতির খেরওয়াল বা অসুর সম্প্রদায়ের লোকেরা সপ্তমী থেকে বিষাদের দিন হিসাবে পালন করেন।
এই মানুষেরা মহিষাসুরকে হুদুড় দুর্গা বলেন। যে অসুরের বিনাশ চায় আমাদের উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ। কিন্তু গ্রামীণ কৃষিপ্রধান সভ্যতার বাহক অনার্যদের কাছে অসুর পূজ্য দেবতা। প্রাগৈতিহাসিক যুগে হুদুড় দুর্গা ছিলেন সাঁওতাল সমাজের রাজা। বীর যোদ্ধা ও ন্যায়পরায়ণ। চাইচাম্পা নামক স্থানে রাজত্ব করতেন। তাঁদের বসবাসের জায়গা ও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি চাষের জমি আর্যরা দখল করতে এসেছিল। জনজাতির সমাজে মহিলাদের স্থান অনেক উপরে, তাঁরা পূজিতা। সাঁওতালদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে কূটকৌশলী আর্যরা সুন্দরী নারীর মাধ্যমে হুদুড় দুর্গাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। হুদুড় দুর্গা প্রস্তাবকে সম্মান জানান এবং ফাঁদে পা দেন। ওই রমণী বহিরাগতদের জনজাতি সমাজের গোপন তথ্য পাচার করেন। রাজাকে বিয়ে করেন এবং সুযোগ বুঝে তাঁকে হত্যা করেন। রীতি অনুসারে সাঁওতাল প্রজারা রাজার হত্যাকারীকে প্রত্যাঘাত করতে পারেননি। আত্মরক্ষার্থে পুরুষরা স্ত্রীলোকের পোশাক পরে সেই স্থান থেকে পালান। তাঁদের বিশ্বাস দুর্গা অনৈতিক উপায়ে, ছলনার আশ্রয়ে সাঁওতাল রাজাকে হত্যা করেছেন।
সাঁওতালি লোকগাথায় আয়নম এবং কাজল নামে দুই সাঁওতাল যুবতী জঙ্গলে কাঠ-পাতা সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। আর্যসমাজের কয়েক জন তাঁদের অপহরণ করেন। মহিলাদের রক্ষা করতে একাই ছুটে যান হুদুড় দুর্গা। বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে জোট বাঁধতে সাঁওতাল সমাজের এক দিন সময় লাগে। তাঁরা মহিলাদের পোশাক পরেন। লাউয়ের খোলায় তিরের ফলা, অস্ত্র ইত্যাদি লুকিয়ে হুদুড় দুর্গা, আয়নম এবং কাজলের সন্ধান করতে থাকেন। অতিবৃষ্টি তাঁদের সন্ধানকে প্রলম্বিত করে। সাঁওতালি ভাষায় দাঁসায় শব্দের ‘দাঁ’-এর অর্থ জল আর ‘সায়’ প্রশমন। জল কমার অপেক্ষায় দেরি হয় এবং প্রিয় মানুষজনকে তৎক্ষণাৎ খুঁজে না পেয়ে ‘হায়’ ‘হায়’ শব্দ করে গান করেন। এমন বহু গানই প্রচলিত।
দুর্গাপূজার ১৫ দিন পরেই আদিবাসীদের ‘বাঁদনা’ পরবে গৃহপালিত পশু মহিষের পূজা হয়। কেবল পশ্চিমবঙ্গে প্রায় তিনশোটি জায়গায় জনজাতির মানুষেরা মহিষাসুর স্মরণে বাঙালির উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদের সমান্তরাল উৎসব হিসাবে দাঁসায় পরব পালন করেন। শুকনো লাউয়ের খোলে তৈরি ‘ভুয়াং’ নাচের বাদ্যযন্ত্র। পুরুষরা শাড়ি পরেন, মাথায় ময়ূরের পালক। স্ত্রীলোকের গয়না পরেও পুরুষরা দাঁসায় নাচেন।
পুরুলিয়ার অখ্যাত গ্রামে আত্মপরিচয়কে তুলে ধরতে দিশম খেরওয়াল বীর কালচার কমিটির পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় হুদুড় দুর্গা বা মহিষাসুর স্মরণ দিবস। ২০১১-য় সোনাইঝুড়ি গ্রামে অজিত প্রসাদ হেমব্রম এবং সহকারী চারিয়ান মাহাতোর উদ্যোগে ঘটে এই পুজো। বাস্তবেই, ঝাড়খণ্ডের এবং পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা অসুর জনজাতি। ১৯১১-র জনগণনা অনুযায়ী তাঁদের সদস্যসংখ্যা ৪০০০-এর কিছু বেশি। আলিপুরদুয়ারে আস্ত একটি গ্রামের নামই অসুর। মণ্ডল কমিশন রিপোর্টে তফসিলি জনজাতিদের তালিকার প্রথম জনজাতি অসুর। হুদুড় দুর্গা ‘শহিদ দিবস’ হলেও ব্রাহ্মণ্যবাদী শিক্ষিতের কাছে গুরুত্বহীন। অজিত প্রসাদ হেমব্রম বলেছেন, “আমরা সান্তাল, খেরওয়াল জনজাতির শাখা। এই সম্প্রদায়ের মানুষ অসুর উপাধি ব্যবহার করেন। আমাদের পুর্বপুরুষ হুদুড় দুর্গাকে দুর্গার পায়ে দেখতে কষ্ট হয়।”
বোগাজকোই লিপি থেকে জানা যায় যে অনার্য অসুর জাতি ছিল খুবই উন্নত। ‘ঋগ্বেদ’-এর ১.১০৮.৮ শ্লোক থেকে জানতে পারি আর্য-অনার্যদের যুদ্ধের কাহিনি, আর্যদের শোষণের ইতিহাস ও চাতুর্য।
একটি উৎসব ভিন্ন ভিন্ন জাতির কাছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উদ্যাপিত হয়। যেমন হিন্দুদের দুর্গাপূজা ও সাঁওতালদের হুদুড় দুর্গার দাঁসায় পরব। হিন্দুদের কাছে তা শুভস্বরূপ ও আনন্দের আর সাঁওতালদের কাছে তা শোকের পরব। এই ভিন্নতাই ভারতের সংস্কৃতিকে আরও স্বতন্ত্র ও ঐতিহ্যবাহী করে তোলে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়