সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণ কম ঘটে। সেই প্রেক্ষাপটে, আর জি কর কাণ্ডকে সরকার একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দাবি করলে অসঙ্গত দেখায় না। অথচ, এই ঘটনায় রাজপথ উত্তাল। স্পষ্টত, সরকারি মত ও জনমত মেলে না।
ধর্ষণ বিষয়ে গবেষণা বলে এই অপরাধের গতিপ্রকৃতির সাধারণীকরণ চলে না। ২০২০ সালে ভারতে ধর্ষণের অনুপাত ছিল প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় দুই-এর কাছাকাছি। ভারতের তুলনায় বিশ গুণ মাথাপিছু আয় সুইডেনের জনতার, সেখানে এই অনুপাত চৌষট্টি। তা হলে কি গরিব দেশ ভারত ধনী দেশ সুইডেনের তুলনায় কম ধর্ষণপ্রবণ! ভারতে আইনি ভাষ্যে ধর্ষণ বলতে পুরুষ দ্বারা নারীর ধর্ষণই বোঝায়। সুইডেনে ধর্ষণের সংজ্ঞা বিস্তৃততর। আরও একটি ব্যাপার সারা বিশ্বেই সত্য, ধর্ষণের সমস্ত ঘটনা নজরে আসে না, ধর্ষিতরা অনেকেই পুলিশে অভিযোগ জানান না। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রগতি, নারীর স্বনির্ভরতা এবং শিক্ষার সম্পর্কও স্বীকৃত, শিক্ষিত রোজগেরে নারীর পক্ষে বিচার চেয়ে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সুইডেনের তুলনায় ভারতে সেই সংখ্যা কম হওয়ার আশঙ্কা।
আইনি সংজ্ঞার অভিন্নতা সত্ত্বেও, ভারতে প্রদেশবিভেদে এ-বিষয়ে বৈচিত্র চোখে পড়ে। সাক্ষরতার হারে কেরল সবার আগে, উচ্চশিক্ষার হারেও উপরের দিকে। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান দুই ক্ষেত্রেই মাঝামাঝি। ২০১৯ সালের হিসাবে কেরলে প্রতি লক্ষ নারীর মধ্যে ধর্ষিত এগারো জন, পশ্চিমবঙ্গে দু’জনের কিছু বেশি। বাঙালি পুরুষপুঙ্গবদের তুলনায় মালয়ালি পুরুষেরা বেশি ধর্ষণপ্রবণ? না কি, শিক্ষিততর মালয়ালি নারীরা বিচারপ্রার্থনায় বঙ্গীয় ললনাদের তুলনায় বেশি সচেতন? দ্বিতীয়টি অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
সর্বত্রই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ধর্ষণের অভিযোগ নিতে চায় না। মিটমাটের পরামর্শ দেয়। ধর্ষণের সঙ্গে খুন হলে তাকে অন্য কোনও ঘটনাক্রমের পরিণতি বা আত্মহত্যা বলে চালাতে চায়। সরকারের ব্যর্থতা, অদক্ষতা, অপ্রস্তুত দশা এবং দীর্ঘকালীন লক্ষ্যে সদিচ্ছার অভাব প্রকট হয়। অনেকের মতে, ভূত সর্ষের মধ্যেই। এই মুহূর্তে ভারতীয় সাংসদ ও বিধায়কদের অন্তত ১৫১ জনের বিরুদ্ধে নারীনির্যাতনের মামলা আছে। এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের ২৫ জন আছেন।
প্রশ্ন হল, অর্থনীতিতে কী বলে, বেকারত্ব ও ধর্ষণের মধ্যে সম্পর্কটা কী? অনেকেই ধর্ষণের পিছনে বেকারত্বকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ দাবি করে থাকেন। যুক্তির গতিপ্রকৃতি খানিকটা— বেকার যুবক, বিয়ে করে সংসার প্রতিপালনের ক্ষমতা নেই, অথচ শরীরের চাহিদা আছে, তাই ধর্ষণ... কিংবা কাজ নেই, মাথায় হাবিজাবি চিন্তা, সমাজের প্রতি ক্রোধ, তারই প্রতিফলন ধর্ষণ।
গবেষক মহলে বেকারত্ব ও ধর্ষণের সম্পর্ক নিয়ে চর্চা আছে। তত্ত্বগত ধারা মোটামুটি দু’টি। একটি ধারায় ধরা হয় ধর্ষণ নির্ভর করে ধর্ষণের সুযোগের উপরে। দ্বিতীয় মতে, ধর্ষণ ঘটে ধর্ষণে প্রোৎসাহনের কারণে। প্রথম ধারার যুক্তিতে বেকারত্ব ও ধর্ষণের সম্পর্ক ঋণাত্মক। কর্মসূত্রে মানুষ সমাজের অন্যদের সংস্পর্শে আসে। বেকার যুবকের গতিবিধি স্বভাবতই সীমিত। তার পক্ষে ধর্ষণের সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। পাশাপাশি, নারীদের বেকারত্ব বাড়লে তাদের গতিবিধি ঘরেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এই কারণেও ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। সুতরাং, বেকারত্ব বাড়লে ধর্ষণ কমার কথা। অন্য দিকে, দ্বিতীয় মতে, কর্মহীন মানুষের পক্ষে ধর্ষণে প্রোৎসাহিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। চাকরিই নেই তাই শাস্তি হিসাবে চাকরি হারানোর ভয় নেই, সংসার নেই তাই সঙ্কটের ভয়ও নেই। অর্থাৎ খুব কিছু হারানোর নেই। এই ধারার ভাবনায় বেকারত্ব ও ধর্ষণের সম্পর্ক ধনাত্মক: বেকারত্ব বাড়লে ধর্ষণ বাড়তে পারে।
ভারত-কেন্দ্রিক গবেষণাগুলিতে এই ভাবনার সমর্থন নেই। বেশির ভাগেরই ফলাফলে বরং প্রথম ধারার তত্ত্বটির সমর্থন মেলে— বেকারত্ব কমলে ধর্ষণ বাড়ে, বেকারত্ব বাড়লে ধর্ষণ কমে। পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্বের হার সর্বভারতীয় হারের তুলনায় কম। ২০২২-২৩ সালে বেকারত্বের সর্বভারতীয় গড় ৩.২ শতাংশ, কেরলে ৭ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে ২.২ শতাংশ। পাশাপাশি, দেখা গিয়েছে এ-রাজ্যে ধর্ষণের হারও কম। অর্থাৎ, ধর্ষণ-বেকারত্ব সম্পর্কে বিশ্বের গবেষক মহলে যে-মতের পাল্লা ভারী এবং ভারতে বিভিন্ন গবেষণার যা ফলাফল পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা তার ঠিক উল্টো। কেন? এক, হতে পারে এ-রাজ্যে ধর্ষণের পরিসংখ্যান নির্ভুল নয়। দুই, বেকারত্বের হার মাপা হয় কর্মে নিযুক্ত জনসংখ্যাকে কর্মপ্রার্থীদের জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে। এমন কি হতে পারে, কর্মরত এবং কর্মপ্রার্থীদের তথ্যে ভুল আছে?
ভারতে মূলস্রোতের নিরূপিত অর্থনীতির সমান্তরাল আরও এক অর্থনীতি আছে। কালোবাজারি এবং অনিবন্ধিত কারবার, দুই-ই এর অন্তর্গত। চরিত্রগত কারণেই এই অর্থনীতির নির্দ্বিধ নিরূপণ সম্ভব নয়। মূলস্রোতের কর্মপ্রার্থীর হিসাবে এদের বড় অংশের অন্তর্ভুক্তি না-ঘটায় বেকারত্বের হার কম প্রতিভাত হবে। এখানে কাজের প্রকৃতি অত্যন্ত ঝুঁকিবহুল, কর্মক্ষেত্রের নানা সুবিধাবিহীন।
পশ্চিমবঙ্গে সমান্তরাল অর্থনীতির অস্তিত্ব প্রশ্নাতীত। নিয়োগ দুর্নীতি, রেশন দুর্নীতি, সারদা প্রভৃতি চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, বালি পাচার, কয়লা পাচার, গরু পাচার, পাথরকুচি পাচার, মাটি পাচার, বনের গাছ, পশু, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ধ্বংস, বেআইনি মাছের ভেড়ি ইত্যাদি কালো তথা সমান্তরাল অর্থনীতির অংশ। বাহুবল, বোমা, বন্দুকের ব্যবহার, মাদকাসক্তি এখানে স্বাভাবিক। বিচার চেয়ে, প্রাণের সুরক্ষা চেয়ে আইনের দ্বারস্থ হওয়া চলে না। যে-তরুণ অবৈধ বালিখাদান থেকে ওভারলোড ডাম্পার চালিয়ে রাতের রাস্তায় চলেছে তার জীবনের দাম কতখানি? মানুষ হিসাবে নিজের কাছে যার মূল্য নেই, অন্যের অধিকার, সম্মান, সম্ভ্রম এবং জীবনের দাম তার কাছে কী হতে পারে তা বোঝার চেষ্টা জরুরি। এ ক্ষেত্রে ধর্ষণের সুযোগ কিংবা প্রোৎসাহন কোনওটাই অন্ধকার চিত্রপটে আলো ফেলে না। আবছায়ায় রয়ে যায় মানুষ হিসাবে মানুষের মূল্যায়ন কিংবা, তার অভাব। পুরুষ যদি নিজেকে মানুষ না ভাবে, নারীর মনুষ্যত্বের প্রতি সে কী ভাবে শ্রদ্ধাবান হবে! চেতনার এই জানলাগুলি খুলে তাকানোর সময় বোধ হয় এসেছে।