ভারত কি ২০৪৭-এর মধ্যে উন্নত দেশ হয়ে উঠতে পারে? বিশ্ব ব্যাঙ্কের সংজ্ঞা অনুযায়ী, উন্নত দেশ হতে গেলে মাথাপিছু গড় আয় অন্তত ১৪০০১ ডলার হতে হবে। মাথাপিছু আয় ১০০১-৪০০০ ডলার হলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশ, এবং ৪০০১-১৪০০০ ডলার হলে উচ্চ-মধ্যবিত্ত। এ বছর ভারতের জিডিপি প্রায় চার লক্ষ কোটি ডলার; জনসংখ্যা ১৪২ কোটি। অতএব, মাথাপিছু গড় আয় ২৭০০ ডলারের কাছাকাছি। অর্থাৎ, ভারত এখনও নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশ। অপ্রত্যাশিত কোনও ঘটনা না-ঘটলে আগামী চার-পাঁচ বছর বছরে ৬.৫-৭% হারে আয়বৃদ্ধি ঘটবে বলেই অনুমান।
কিন্তু, আয় যত বাড়বে, চড়া বৃদ্ধির হার ধরে রাখা ততই কঠিন হবে— ২৭০০ ডলারের উপরে আয় ২৭০ ডলার বাড়লে ১০% বৃদ্ধি হয়, কিন্তু ১০০০০ ডলারের উপরে ১০% বৃদ্ধির জন্য আয় বাড়াতে হবে ১০০০ ডলার। স্বভাবতই সেটার জন্য অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে। তাই ধরা যাক যে, পরবর্তী ১০ বছর জিডিপি বাড়বে ৭% হারে, তার পরের ১২ বছর ৬% হারে, এবং তারও পরের ১৫ বছর ৫% হারে। হিসাবে বলছে, ২০২৭ সাল নাগাদ মাথাপিছু জিডিপি হবে ১০,০০০ ডলারের সামান্য বেশি— অর্থাৎ তখনও উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখাতে পারবে না ভারত। ১৪০০০ ডলার, অর্থাৎ উন্নত দেশের বন্ধনীতে ভারত পৌঁছবে ২০৫৫ সাল নাগাদ। এবং, ২০৬০ সালে ভারতের জিডিপি হবে ৩২ লক্ষ কোটি ডলার; জনসংখ্যা মোটামুটি ১৭০ কোটি। মাথাপিছু আয় হবে ২০,০০০ ডলারের কাছাকাছি।
এই মুহূর্তে দুনিয়ার ১৯২টি দেশের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারত রয়েছে ১৪১তম স্থানে। আয় বাড়তে থাকলে কোন সালে ভারত কোন দেশের বর্তমান সমৃদ্ধির স্তরে পৌঁছবে, সেটা জানলে আয়বৃদ্ধির স্বরূপ বুঝতে সুবিধা হতে পারে। ২০৩৪ সালে ভারতে মাথাপিছু গড় আয় হবে প্রায় ৫০০০ ডলার— এখন ইরান ও ইন্দোনেশিয়ায় মাথাপিছু গড় আয় ৫০০০ ডলার, বিশ্বে সে দেশ দু’টি রয়েছে ১১৭ ও ১১৮তম স্থানে। ২০৪৭ সালে ভারতে মাথাপিছু আয় ১০,০০০ ডলার হতে পারে— এখন ব্রাজ়িলের গড় আয় এটাই, সে দেশ রয়েছে বিশ্বের ৮০তম স্থানে। ২০৫৫ সালে ১৪,০০০ ডলারে পৌঁছলে ভারত আজকের মেক্সিকোর সমান হবে— বিশ্বতালিকায় সে দেশ এখন ৬৮তম স্থানে রয়েছে। ২০৬০ সাল নাগাদ ভারতের মাথাপিছু গড় আয় ২০,০০০ ডলার হলে তা আজকের রোমানিয়া এবং ওমান-এর পর্যায়ভুক্ত হবে। এই দেশ দু’টি এখন বিশ্ব ক্রমতালিকায় ৫৬ ও ৫৫তম স্থানে আছে।
কিন্তু, গড় আয় বাড়লেই উন্নত দেশ হয়ে ওঠা যায় না। আরও তিনটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে— এক, সেই আয় কী ভাবে বণ্টিত হচ্ছে, এবং দারিদ্রের ব্যাপ্তি কতখানি; দুই, মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক, অর্থাৎ শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতির মান, ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে মাথাপিছু গড় আয়, প্রত্যাশিত আয়ু, ও শিক্ষার দৈর্ঘ্য; এবং তিন, লিঙ্গবৈষম্য— কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার, প্রজনন হার, প্রসবকালীন মৃত্যুর হার, নারীশিক্ষা, ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর প্রতিনিধিত্ব প্রভৃতি।
বিশ্বের ১৯২টি দেশের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, গড় আয়বৃদ্ধি এবং লিঙ্গবৈষম্যের হ্রাস পরস্পরের সঙ্গে সরাসরি ইতিবাচক সম্পর্ক রেখে চলে। অর্থাৎ, দেশের গড় আয় যত বেশি, সে দেশের নারী-পুরুষের সাম্যও তত বেশি। মানব উন্নয়ন সূচকের সঙ্গে গড় আয়ের সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত দুর্বল। অর্থাৎ, গড় আয় বেশি কিন্তু আয়ু বা শিক্ষার দিকে পিছিয়ে থাকা দেশ প্রায়শই খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও মানব উন্নয়ন সূচক ও গড় আয়ের ইতিবাচক পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভাবে শক্তিশালী। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হল যে, এই ১৯২টি দেশের পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু গড় আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়বৈষম্যও বাড়ছে।
সোজা কথায়, বিশ-পঁচিশ বছর পরে ভারত মাথাপিছু গড় আয়ের দিক দিয়ে যদি উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে ওঠে, নারীপুরুষের বৈষম্য যে কিছুটা কমবে তার সম্ভাবনা প্রবল, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দিক দিয়েও খানিকটা উন্নতি আশা করা যায়, কিন্তু ধনী-দরিদ্রের আয় ও সম্পত্তির মধ্যে যে ব্যবধান তা আরও বেড়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। ভারতের পক্ষে, যেখানে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান, ধর্ম, জাতি ও আঞ্চলিক বিভাজন সমাপতিত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক টানাপড়েন প্রত্যহ তৈরি করে চলে, সেখানে কিন্তু ধনী-দরিদ্রের দূরত্বের ক্রমবর্ধমানতা উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
ভারতের ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান ব্যবধান অবশ্যই এক রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা তৈরির ক্ষমতা রাখে। অর্থনৈতিক প্রগতি ও উত্তরপুরুষের সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্নের উপর আস্থাই এই অস্থিরতার মোকাবিলা করতে পারে। দুর্নীতি এবং বিচারবিভাগীয় অক্ষমতা এই আস্থার ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়ে এক চরম সঙ্কট তৈরিরও ক্ষমতা রাখে। অতএব, আয়বৃদ্ধিই একমাত্র দুশ্চিন্তা নয়।