উৎসবের মরসুম এখন প্রকৃতির রোষে স্তব্ধ আমেরিকা। ছবি: রয়টার্স।
এক দিকে বন্যা আর অন্য দিকে তুষার ঝড়। উৎসবের মরসুম এখন প্রকৃতির রোষে স্তব্ধ আমেরিকা। অবস্থা এতটাই খারাপ যে বহু এলাকাতেই আপতকালীন ব্যবস্থা নেওয়ারও উপায় নেই প্রবল তুষারপাতের কারণে। প্রথমে মনে করা হয়েছিল এটা উষ্ণায়নের ছোবল। কিন্তু ‘ক্লাইমেট শিফ্ট ইনডেক্স’ বলছে এ বারের শীতে প্রকৃতির রোষের পিছনে উষ্ণায়নকে পুরোটা দায়ী করা যায় না। তুষারঝড়ের বড় অংশটাই যেমন প্রকৃতির স্বাভাবিক খামখেয়ালিপনা, ঠিক তেমনই আবার নেভাডার মতো অঞ্চল মানুষের তৈরি উষ্ণায়নের শিকার।
দুই হাজার কিলোমিটার ব্যাপী এই তীব্র তুষারঝড় বা ‘বম্ব সাইক্লোন'-এর অভিঘাতের বড় অংশই প্রাকৃতিক এই যুক্তিতে মানব সভ্যতাকে মুছে দিতে উদ্যত। উষ্ণায়নকে হেলায় উড়িয়ে দেওয়ার ‘ট্রাম্পীয়' নির্লিপ্তি যে আত্মহত্যার সামিল তা কিন্তু আমরা নিজেদের জীবন দিয়ে টের পাচ্ছি। সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষও আমাদের টলাতে পারছে না। উষ্ণায়নের কারণে বিশ্ব জুড়ে ধ্বংসাত্মক সাইক্লোনের বাড় বাড়ন্ততেও আমরা টলব না বলে স্থির প্রতিজ্ঞ। ঘরের বা বিশ্বের অভিজ্ঞতা তো অন্তত সেটাই বলছে।
ভারতের পূর্ব উপকূল জুড়ে ঝড়ের তীব্রতা এবং সংখ্যা বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে খাল সংস্কার থেকে শুরু করে রাস্তা করার নামে নির্বিচারে কাটা পড়ছে গাছ। অন্য রাজ্যগুলিতেও পরিস্থিতি একই। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, ভারতে উষ্ণায়নের কারণে প্রাণহানির অঙ্ক না কষা হলেও বাড়তে থাকা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বলি হচ্ছে ১০ হাজার কোটি কর্মঘণ্টা বা ৪১৬ কোটি কর্মদিবস। অথচ আমরা কিন্তু ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম আর্থিক ভাবে শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি।
অনেকেই বলছেন এটা হয়ত আরও তাড়াতাড়ি হওয়া সম্ভব হত যদি না আমরা প্রকৃতিকে এই ভাবে হেলাফেলা করতাম। কতটা তার হিসাব হল ৮২ টাকায় এক ডলার এই অঙ্কে ২০৫০ সালে খাদ্যশষ্য উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ পৌঁছতে পারে ১৭ লক্ষ কোটি টাকায়! আজকের উৎপাদনের সঙ্গে তুলনা করলে কী দাঁড়ায়? অর্ধেক! অর্ধাৎ উষ্ণায়নের কারণে আমরা যখন ২০৫০ সালে পা দেব তখন আজকে নির্লিপ্ত ভাবে গাছ না কেটে ফেললে আমাদের দেশের উৎপাদনে আরও ১৭ লক্ষ কোটি টাকা হত।
এটা তো একটা হিসাব। ক্ষতির হিসাব আরও বিস্তৃত। উষ্ণায়নের কারণে বাড়বে গরম আর তার জন্য বাড়াতে হবে বিদ্যুতের উৎপাদন। আর নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন হবে ২ লক্ষ কোটি টাকার উপর বিনিয়োগের।
চাপ বাড়বে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে। আয় বাড়বে। তুলনামূলক মাথাপিছু গড় আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়ারিয়ার মতো রোগের প্রকোপ কমলেও বাড়বে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার সংস্থার সমীক্ষা আরও বলছে যে উষ্ণায়নের কারণে রোগভোগ বাড়ার অঙ্ক মানুষের জীবন দিয়ে করা উচিত। আর সেই অঙ্ক সংস্থাটি করেছে নাগরিকের গোটা জীবনের গড় আয়ের ভিত্তিতে। শুধু দূষণের কারণে অসুস্থতা এবং সেই কারণে হারানো আয়ের অঙ্ক দাঁড়াবে ৪১ হাজার কোটি টাকায়!
অনেকেই বলবেন, এবং বলছেনও যে, তাতে কী? সমৃদ্ধি তো বাড়ছে! হ্যাঁ, তা বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে তুলনামূলক অসাম্যও। কোভিডের কারণে লকডাউনের কথা ভাবুন। সবাই কি সমান ভাবে চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছেন? পেয়েছেন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ। বা পেরেছেন চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে? দেশ যত বড়লোক হয়, সাধারণ মানুষের আয়ও তার সঙ্গে বাড়ে। আর তাই দারিদ্র সীমাকেও সেই তালে তাল মিলিয়ে আরও বেশি আয়ের মাপকাঠিতে বাঁধতে হয়।
আমেরিকায় যে আয়ের অঙ্কে দারিদ্রসীমা নির্দিষ্ট করা হবে সেই সীমা ভারতের ক্ষেত্রে অনেক নীচে হবে তুলনামূলক ভাবে। আর তার কারণ হল জীবনযাত্রার মানের ফারাক। আর ঠিক সেই কারণেই অসাম্যের অঙ্কও মাপা হয় সাধারণ নাগিরকের পণ্যের উপর অধিকার এবং সেই অধিকার ফলানোর রেস্তর উপর নির্ভর করে।
এটা বুঝতে ফেরা যাক কোভিডের সময়কার লকডাউনের উদাহরণেই। মনে আছে বাইপাপের মতো শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ানোর যন্ত্রের জন্য হাহাকার? অনেক উচ্চ মধ্যবিত্তেরই হাতের বাইরে ছিল সেই যন্ত্রের সুযোগ পাওয়ার অধিকার। এক দিকে চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ায় হাতের বাইরে চলে যাওয়া দাম, আর অন্য দিকে সাধারণ হাসপাতালে তার অপ্রতুল সরবরাহ। অথবা একই ভাবে বেড়ে যাওয়া ভেন্টিলেটর বা অন্যান্য ওষুধের দামও। কিন্তু একই সঙ্গে যাঁদের ক্ষমতা ও আর্থিক বল ছিল তাঁরা কিন্তু সহজেই এই চিকিৎসার সুযোগ নিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন। যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন এ সবের অভাবে, তাঁরা কিন্তু আমাদের অঙ্কে দরিদ্র না হয়েও, গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েও এই পরিস্থিতিতে তুলনামূলক অসাম্য বা বৈষম্যের শিকার। এক কথায়, জীবনযাপনের দাবি নির্ধারণ করে অসাম্যের অঙ্ক তার প্রমাণ তো এটাই।
এই উদাহরণ টানার প্রধান কারণ এটা বোঝানো যে, শুধু বৈষয়িক সমৃদ্ধি দিয়েই আর্থিক সাম্যের অঙ্ক কষা যায় না। দেশের সমৃদ্ধি মানেই যে দশের সমৃদ্ধি তাও নয়। দেশের সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দশেরও পণ্যের অধিকারের প্রসার প্রয়োজন। আর আজকের দুনিয়ায়, শুধু সরকারি নীতিই নয়, পরিবেশও হয়ে উঠছে অসাম্য বাড়ার কারণ।
আমরা গাছ কাটছি। আর প্রকৃতি হারাচ্ছে তার কার্বন শোধনের ফিল্টার। যা বাড়াচ্ছে সমুদ্রের তাপ, গরম হচ্ছে পৃথিবী, গলছে হিমবাহ, বাড়ছে বন্যা এবং ধ্বংস হচ্ছে সাধারণের সম্পদ।
আজ ভারতের যে কটি রাজ্য উষ্ণায়নের প্রাথমিক বলি তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম। কৃষির উপর নির্ভরশীল এই রাজ্যে স্বাভাবিক মরসুমের চরিত্র বদলের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আহত হচ্ছে নাগরিক জীবনও। সুন্দরবনে অকাতরে ম্যানগ্রোভ কাটায় সন্নিহিত অঞ্চলের প্রাকৃতিক বাঁধও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অঞ্চলের মানুষ প্রথাগত জীবিকা ছেড়ে পালাচ্ছে অন্য রাজ্যে জীবিকার খোঁজে। কারণ কৃষি বা মৎস্যপালনের মতো জীবিকা প্রকৃতির রোশে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ মানুষ তার ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে উষ্ণায়নের কারণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া তার বাপ-মায়ের ভিটের প্রতিবেশে তাঁর আয়ের সুযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়ায়।
ভাবুন আমপানের কথা। সুন্দরবন-সহ উপকূলীয় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের দুর্দশার কথা। কলকাতাও রেহাই পায়নি এর রোষ থেকে। কিন্তু শহর কলকাতা যত তাড়াতাড়ি ছন্দে ফিরতে পেরেছে, সুন্দরবনের মানুষ কিন্তু তা পারেননি। তার কারণ আমপানের বিধ্বংসী ছোবলের বড় অংশটাই নিয়েছিল সুন্দরবন। একেও অর্থনীতিতে অসাম্যই বলে থাকে। কারণ মানুষের পণ্যের উপর অধিকার কমেছে। আর তার মূল কারণ হিসাবে এখন উষ্ণায়নও তার দাবি পেশ করে বসে আছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গ্লাসগোর পরিবেশ রক্ষা নিয়ে আন্তর্জাতিক বৈঠক কপ-২৬-এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন যে ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে ‘নিট জ়িরো’ হয়ে উঠবে। এর মোদ্দা কথা হল আমরা যা কার্বন নিঃসরণ করব তা সবুজের আচ্ছাদন ফিল্টার করে উঠতে পারবে। এটা করতে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে, বাড়াতে হবে সবুজের আচ্ছাদন। কিন্তু যে হারে গাছ কাটা এখনও চলছে তাতে এই লক্ষ্যমাত্রা আমরা ছুঁতে পারব কি না সন্দেহ আছে। যা নিয়ে সন্দেহ নেই তা হলে ভারতে বৈষম্য বাড়াতে নীতি পঙ্গুত্বের দোসর হয়ে উঠছে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সবুজ।