লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে এসেছে, বিজেপির বড়-মাঝারি-ছোট সব মাপের নেতারাই বারে বারে শুনিয়ে চলেছেন একটি সম্ভাবনার কথা— এই দশক ফুরোনোর আগেই হয়তো ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা হয়ে উঠবে। তাঁরা আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন— ‘অমৃত কাল’, অর্থাৎ স্বাধীনতা অর্জনের শতবর্ষ, শেষ হওয়ার আগেই ভারত উন্নত অর্থব্যবস্থা হয়ে উঠবে। এই উচ্চৈঃস্বর আত্মপ্রচার যতখানি না কৃতিত্বের কথা বলার জন্য, সন্দেহ হয় যে, তার চেয়ে অনেক বেশি ভারতীয় অর্থব্যবস্থার ভয়ঙ্কর বাস্তব চিত্রটিকে আড়ালকরার জন্য।
ঘটনা হল, ‘অচ্ছে দিন’-এর খোয়াব দেখিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি নেতৃত্ব সেই সব প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছেন। বিদেশের ব্যাঙ্কে থাকা সব কালো টাকা ফিরিয়ে এনে প্রত্যেক ভারতীয়ের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা করার কথা নাহয় বাদই দিলাম, অন্য প্রতিশ্রুতিগুলোও অপূর্ণই থেকে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি জানিয়েছিলেন, ২৫ বছরের আগে ‘অচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সম্ভব হবে না! কার্যক্ষেত্রে গত দশ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক অগ্রাধিকারের ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে, ২৫ বছরের ঢের বেশি অপেক্ষা করতে হবে ‘অচ্ছে দিন’-এর জন্য। তবে হ্যাঁ, অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা ঢোকার প্রতিশ্রুতি কিছু ক্ষেত্রে অনেক গুণ বেশি পূরণ করা হয়েছে— বিবিধ প্রণোদনা ও কর ছাড়ের রূপ ধরে বড় ব্যবসায়ীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
এক দশক আগে, নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার সময়, ভারত বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা ছিল। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের অনুমান অনুসারে ২০২৭ সালে ভারত যদি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠে, তার একটি কারণ এটাও যে, ২০২০ সালে যে দেশগুলির অর্থব্যবস্থার আয়তন ভারতের চেয়ে বেশি ছিল, তার মধ্যে জাপান, জার্মানি এবং ব্রিটেনে গত কয়েক বছর ধরে সুতীব্র আর্থিক সঙ্কট চলছে। কিন্তু, তার চেয়েও বড় কথা হল, দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা হয়ে উঠলেও ভারত বিশ্ব ব্যাঙ্কের শ্রেণিবিভাজন অনুসারে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশই থাকবে। মধ্য আয়ের দেশ হয়ে উঠতে আমাদের এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। মনে রাখা ভাল যে, ভারত বাদে ব্রিকস-এর বাকি সদস্য দেশগুলি কিন্তু মধ্য আয়ের। ২০২৭ সালে ভারতের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৬০০ ডলার। সেই নিরিখে ভুটান ও বাংলাদেশ আমাদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। অর্থাৎ, ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা হয়ে উঠলেও সাধারণ মানুষের প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্যই থাকবে।
প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য উন্নয়নের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। তার জন্য প্রথমেই নজর দেওয়া প্রয়োজন কৃষির দিকে। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বলেছিল যে, তাদের কৃষি নীতির দৌলতে ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ হবে। ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে সরকার সংসদে জানিয়েছিল, তারা ‘কৃষিক্ষেত্রে ব্যয় কমাতে, উৎপাদন বাড়াতে এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন উন্নয়নমুখী প্রকল্প, যোজনা ও নীতি গ্রহণ করেছে, এবং সংস্কারের ব্যবস্থা করেছে’। সরকারপক্ষ জানিয়েছিল, প্রধান কৃতিত্বগুলির মধ্যে রয়েছে ২০১৩-১৪ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের মধ্যে কৃষি, মৎস্যচাষ, পশুপালন ও ডেয়ারির ক্ষেত্রে বাজেটবরাদ্দ সাড়ে চার গুণ বৃদ্ধি করা, পিএম কিসান যোজনার মাধ্যমে কৃষকদের জন্য আয় সহায়তার ব্যবস্থা করা, এবং প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা চালু করা। সরকারের অন্য দাবিগুলির মধ্যে রয়েছে উৎপাদন ব্যয়ের দেড় গুণ হিসাবে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য স্থির করা, কৃষিক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং কৃষক উৎপাদক সংগঠনগুলিকে সহায়তা দেওয়া।
কৃষকদের কাছে সেই সুবিধাগুলি কতখানি পৌঁছচ্ছে, সে বিষয়ে সরকার কোনও প্রমাণ পেশ করেনি। তবে, ২০১৭-১৮ এবং ২০২১-২২’এর পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে-র (পিএলএফএস) পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এই সময়কালে গ্রামীণ কর্মশক্তির আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। যে সময়কালের মধ্যে সরকার কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার কথা বলেছিল, পিএলএফএস পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, তখন গ্রামাঞ্চলের মোট কর্মশক্তির প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছে ৬.৪%। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই আয়হ্রাসের হার আরও বেশি। যদিও ঠিকা শ্রমিকের ক্ষেত্রে অবস্থা তুলনায় খানিক ভাল, কিন্তু তার থেকে কোনও মতেই বলা যায় না যে, অদূর ভবিষ্যতে কৃষিক্ষেত্রে আয় দ্বিগুণ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে— অন্তত যত দিন না সঙ্কটাপন্ন কৃষিক্ষেত্রের জন্য সরকার যথেষ্ট নীতি রূপায়ণ করতে পারে।
গত এক বছরে শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে খারাপ হয়েছে। এনডিএ সরকারের অন্তত দু’দফা সিদ্ধান্ত শ্রম বাজারকে দারুণ ভাবে বিঘ্নিত করেছে। প্রথমটি ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে হওয়া নোট বাতিল; দ্বিতীয়টি অতিমারিজনিত আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা করতে সরকারের ব্যর্থতা। শ্রমের বাজারে তৃতীয় বিপত্তিটিও ভারতীয় অর্থব্যবস্থার দিগন্তে উঁকি দিচ্ছে— নতুন শ্রমবিধি চালু করে সরকার শ্রমের বাজারকে আরও নমনীয় করতে চাইছে, যার অর্থ, শ্রমিকের অধিকার আরও খর্ব করা হবে।
নোট বাতিলের ফলে শ্রমের বাজারে কতখানি ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়েছিল, তার সাক্ষ্য পিএলএফএস পরিসংখ্যানে রয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবর্ষে ভারতে বেকারত্বের হার ছিল দুই শতাংশের সামান্য বেশি; ২০১৭-১৮’তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় শতাংশের উপরে। লক্ষণীয়, এর পরবর্তী বছরগুলিতে বেকারত্বের হার ক্রমশ কমেছে, এবং ২০২২-২৩’এ তা দাঁড়িয়েছে তিন শতাংশের সামান্য উপরে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হল, বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি কমেছে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে, যখন কোভিড অতিমারির কারণে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সবচেয়ে বড় শ্রমসঙ্কটটি চলছিল।
পরিসংখ্যানটি যে ভুল, তার চেয়েও বড় কথা, এটা আরও বড় একটা কাঠামোগত সমস্যার অংশ— ভারতের একদা অতি মজবুত পরিসংখ্যান ব্যবস্থার সর্বনাশের একটি ফল। গত এক দশকে ভারতের সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে বারে বারেই দু’ধরনের প্রশ্ন উঠেছে— এক, অর্থনীতির বাস্তব ছবিটি বোঝার জন্য অতি প্রয়োজনীয় বহু পরিসংখ্যান সরকার সময়ে প্রকাশ করেনি; এবং দুই, যে ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে, তার গুণগত মান নিয়ে বিপুল সংশয় রয়েছে। অর্থনৈতিক সুশাসনের প্রথম শর্তই হল তথ্যনির্ভর নীতিনির্ধারণ— এই জমানায় তা কোনও গুরুত্বই পায়নি।
এই জমানায় ভারতের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন-ঘাটতিটি হল অপুষ্টির বৃদ্ধি। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজ়েশন-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩-১৫ সালে ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৪.৪% অপুষ্টিতে ভুগছিলেন (তিন বছরের গড়); ২০২০-২২’এ অনুপাতটি দাঁড়িয়েছে ১৬.৬%। অর্থাৎ, এই সময়কালে অপুষ্টিতে ভোগা জনসংখ্যা ১৮.৮ কোটি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩.৪ কোটিতে। যে দেশের অর্থনীতির আয়তন গোটা দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে এমন উন্নয়ন-ঘাটতি কোনও মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই সমস্যার মোকাবিলায় সরকারের অস্ত্র হল ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, এই প্রকল্পটি আরও পাঁচ বছর চলবে।
২০২১ সালে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৭৪.৪ শতাংশের পক্ষে দু’বেলা পুষ্টিকর খাদ্যের সংস্থান করা সম্ভব ছিল না। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজ়েশনের হিসাবে, এখনও একশো কোটির বেশি ভারতীয় দু’বেলা পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করতে পারেন না। এই অপুষ্টি আর বঞ্চনা সত্ত্বেও সরকারের দাবি, দারিদ্রসীমার নীচে অাছেন পাঁচ শতাংশেরও কম মানুষ। বাস্তবের সঙ্গে সরকারের কোনও দাবিই মেলে না, এটাই সম্ভবত এই জমানার অর্থনৈতিক ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।