আমরা যাচ্ছি কোথায়
Bengalis Cultural existence

সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সবেতেই বঙ্গের দৈন্যের কারণ: আত্মঘাত

সত্তরের দশকের শেষ বা আশির গোড়া থেকেই দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজোর মধ্যের সময়টায় পাড়ায়-পাড়ায় যে হৈমন্তিক জলসাগুলো হত সেখানে রাত্রি ন’টা থেকে দশটা বাঁধা ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত-নজরুলগীতির জন্য।

Advertisement

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২৩ ০৭:৩২
Share:

পারি না সইতে/ না পারি কইতে/ তুমি কি কুয়াশা/ ধোঁয়া, ধোঁয়া, ধোঁয়া”— কিশোরকুমারের গলায় কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ অবধি বাজত এই গান, আশির দশকের শেষাশেষি। পঁয়ত্রিশ বছর পেরিয়ে মনে হয়, ওই গানটাই যেন অতিজীবিত হয়ে আবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চার দিকেই তো কুয়াশা। শহুরে বাঙালি আজও যে সামান্য কয়েকটা বাংলা তারিখ মনে রাখেন, তার মধ্যে পয়লা বৈশাখ আর পঁচিশে বৈশাখ অন্যতম। কালবৈশাখীহীন প্রবল তাপপ্রবাহের মধ্যে, বৈশাখের এক থেকে পঁচিশের দিকে এগোতে এগোতে মনে হয় কোথায় ছিলাম আমরা, যাচ্ছি কোথায়? ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে অ্যাপার্টমেন্টে-অ্যাপার্টমেন্টে ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করার চল হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো তার বিরুদ্ধে লিখছেনও। কিন্তু কী লাভ? শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ, একটা করে পুরনো বাড়ি ভেঙে জি প্লাস ফোর, জি প্লাস ফাইভ উঠছে, আর দেখা যাচ্ছে পনেরোটা ফ্ল্যাটের মধ্যে বারোটা ফ্ল্যাটই কিনে নিচ্ছেন অবাঙালিরা। এ বার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটা অ্যাপার্টমেন্টের কুড়ি ঘর বাসিন্দার মধ্যে পনেরো ঘরই যদি হিন্দি-উর্দু-পঞ্জাবিতে কথা বলে, তবে সেই অ্যাপার্টমেন্টের কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই কেবলমাত্র বাংলায় হতে পারে না।

Advertisement

এমন নয় যে, আগে সবটাই ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’ ছিল; সত্তরের দশকের শেষ বা আশির গোড়া থেকেই দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজোর মধ্যের সময়টায় পাড়ায়-পাড়ায় যে হৈমন্তিক জলসাগুলো হত সেখানে রাত্রি ন’টা থেকে দশটা বাঁধা ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত-নজরুলগীতির জন্য। দশটা থেকে বারোটা, হেমন্ত-মান্না-শ্যামল, সন্ধ্যা এবং আরতি মুখোপাধ্যায়ের গান গাওয়া শিল্পীরা আসর মাতাতেন। বারোটা থেকে দেড়টা ধরা থাকত লতা/আশা-কণ্ঠীদের জন্য। রাত্রি দেড়টা থেকে স্টেজ চলে যেত রফি/মুকেশ-কণ্ঠীদের দখলে। আর রাত তিনটে নাগাদ স্টেজে উঠতেন প্রধান আকর্ষণ কিশোর-কণ্ঠী শিল্পী। ওই লতা-আশা-রফি-মুকেশ-কিশোরকণ্ঠীরা একটা বা খুব বেশি হলে দুটো গান বাংলায় গেয়ে হিন্দিতে চলে যেতেন। তবু, তাঁরা চরণামৃতে ডাবের জল মেশাবার কায়দায় নিজেদের একটা-আধটা মৌলিক বাংলা গান শুনিয়ে দিতেন দর্শক-শ্রোতাদের। এখন সেই রাস্তাটাও বন্ধ। টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা রেডিয়োর এফএম-এ মাথা কুটলেও নতুন বাংলা গান শোনা যায় না আর। যন্ত্রশিল্পীরা নতুন গানের খোঁজ রাখেন না, রেডিয়ো-জকি’রা বাজাতে চান না। কেন নতুন বাংলা গান সামান্য পৃষ্ঠপোষকতাও পায় না, এই প্রশ্ন তুলে এক ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী সম্প্রতি টিকিট কেটে নতুন বাংলা গান শুনতে আসার আহ্বান জানিয়েছেন শ্রোতাদের। তার সঙ্গে জানাতে ভোলেননি যে, টিকিটের দাম কয়েকটি ফুচকার চাইতে বেশি নয়। এই জায়গাটায় এসে অনেকেরই নিশ্চয়ই চোখে জল এসে গেছে। বাঙালি তো এত অনুদার নয়। তা হলে এই কথাটা কেন বলতে হল শিল্পীকে? পরক্ষণেই মনে হয়েছে, যে অর্থনৈতিক অপারগতা বাঙালিকে গড়িয়াহাট, নিউ আলিপুর কিংবা মানিকতলা, গিরিশ পার্কের ফ্ল্যাট কিনতে দেয় না, সেই একই অপারগতার কারণেই কি বাংলা গানের আসরের টিকিটের স্বল্পমূল্যের কথা ঘোষণা করতে হয়?

‘প্রত্যেকের হাতেই দামি মোবাইল দেখতে পাওয়া যায়’ কিংবা ‘শপিং মলে কী ভীষণ ভিড়’ জাতীয় আপ্তবাক্য দিয়ে গভীরতর অসুখকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এমন নয় যে, এই অসুখ কেবল পশ্চিমবঙ্গেই। সারা ভারতেই এই অসুখ বাড়ছে কিন্তু বাঙালির মতো চাকরি-নির্ভর তো ভারতের খুব বেশি জাতি নয়। এখানে বাবা-মায়েরা নিজেদের ফিক্সড ডিপোজ়িট ভেঙে ছেলে-মেয়েকে ছয় থেকে আট লাখ টাকা দিয়ে দেবেন ঘুষ দিয়ে সরকারি কিংবা আধা-সরকারি চাকরি পাওয়ার মরীচিকাকে মরূদ্যান ভেবে। সেই একই বাবা-মা স্বাধীন ব্যবসার জন্য চার লাখ টাকা দিতে রাজি হবেন না কিছুতেই। হবেন না বলেই চাকরি চুরির টাকা কেবল বিউটি পার্লার কিংবা সিনেমা নয়, শিক্ষাঙ্গনেও খাটছে।

Advertisement

বিএড পড়তে যাওয়া খুব সম্মানের ছিল একটা সময়। কারণ বিএড কলেজের দেওয়ালে লেখা থাকত, ‘এখানে মাস্টারমশাইরাও ছাত্র’। আর আজ? তাপস মণ্ডল কিংবা বিভাস অধিকারী কণ্টকিত পশ্চিমবঙ্গের বিএড কলেজগুলো দুর্নীতিতে দুর্নিবার। অধিকাংশ কলেজের অনুমোদন তথা পরিচালনকে কেন্দ্র করে কোটি-কোটি অবৈধ টাকা খাটছে। এখনও পশ্চিমবঙ্গ নামের জাদুতে আকৃষ্ট হয়ে, অসম, মণিপুর, মেঘালয় সমেত সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাজারও ছেলেমেয়ে পড়তে আসে এই প্রাইভেট কলেজগুলোয় এবং বুকে প্রতারণার জ্বালা নিয়ে ফিরে যায় ঘরে। ‘চিটিংবাজ’ হিসাবে বাঙালিকে বিখ্যাত করতে এই প্রাইভেট বিএড কলেজগুলির ভূমিকা, বিজ্ঞাপনের ভাষায়, সত্যিই অনস্বীকার্য। তার পরও এই কলেজগুলো বন্ধ হবে না তা-ই নয়, অনেক নতুন ছাত্রছাত্রী পাবে আসছে বছরও। কারণ খুঁজতে গিয়ে শম্ভু মিত্র’র সেই অবিস্মরণীয় নাটক চাঁদ বণিকের পালার মেয়েদের গান মনে পড়ে যায়, “...মানুষের উপায় কী বলো।/ যা কিছু সে শুনে শেখে/ যা কিছু সে চোখে দেখে/...তাই নিয়্যা/ পাড়ি দিয়্যা/— আরো এক ভয়ঙ্কর আন্ধারে পৌঁছালো।/ মানুষের উপায় কী বলো?”

উপায়হীন বাঙালি ওই একই পালায় চাঁদ সওদাগরের সংলাপও শুনেছে। চাঁদ যখন বলেন, “জীবনের থিক্যা অঙ্ক কষ্যা-কষ্যা শিবাইয়ে পৌঁছ্যাতে চাই, সেথা শিবাই মেলে না। আর শিবাইয়ের থিক্যা অঙ্ক কষ্যা-কষ্যা জীবনে পৌঁছ্যাতে চাই, দেখি জীবন মেলে না।” তখন তাঁর গলায় সন্তানের জীবনের জন্য আদর্শের সঙ্গে আপস করেও সর্বস্বান্ত পিতার গলাই শুনতে পাই না কি?

সর্বস্বান্ত কি কেবল মানুষই হয়? একটা গোটা শহর হয় না? সম্প্রতি, সাহিত্যিক বিপুল দাসের ‘পুনরুত্থান’ গল্পে দুই দুর্গাপুরের এক অনবদ্য বর্ণনা পাওয়া গেল। প্রথম দুর্গাপুর সম্পর্কে গল্পের নায়ক বলে, “লোহা এবং ইস্পাত শিল্পের জন্য দুর্গাপুর ছিল আদর্শ জায়গা… বিশ্বকর্মানগরে কী দুরন্ত কর্মকাণ্ড চলে দিনরাত। ওদিকে স্টিল প্ল্যান্টের কাজ, এদিকে মাইনিং-এর উপযোগী, সহায়ক যন্ত্রপাতি তৈরি। ...সে এক দুরন্ত সময়। সমস্ত ভারতবর্ষের নজর আমাদের এই শিল্পনগরীর দিকে।” গল্পের শেষ দিকে, একই চরিত্রের মুখে শুনি, “যা ছিল অমরাবতী, এখন যেন প্রেতলোক। ...কোথায় গেল প্রাণস্পন্দনে মুখর আমাদের সেই ক্যান্টিনের কোলাহল। কোথায় গেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, এস্ট্যাবলিশমেন্টের লোকজন, প্ল্যান্টের লোকজন। মৃতদের শহরে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি।”

বলা বাহুল্য, দুর্গাপুর আজও প্রাণচঞ্চল একটি শহর। কিন্তু শিল্পের বিচারে তাকে আর সতেজ বলা যায় কি? একই বেদনা বুকে বাজে যখন খবরের কাগজে পড়ি, কেরলের মিলমার সঙ্গে কর্নাটকের নন্দিনী এবং কর্নাটকের নন্দিনীর সঙ্গে গুজরাতের আমুল-এর ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলছে। তিনটিই দুধ-মাখন তথা পনির উৎপাদক সংস্থা। এ বার কেউ কাউকে নিজের বাজারের সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়বে না।কিন্তু এই তিনটে সংস্থাই যদি পশ্চিমবঙ্গে আসে, তবে খোলা ময়দান পেয়ে যাবে কারণ হরিণঘাটার অবস্থা যে দুর্গাপুরের চাইতেও খারাপ। মনে পড়ে, হরিণঘাটার সেই বোতলের দুধ, দুধের উপরের ঘন হলুদ সরের কথা? তারকেশ্বর, আরামবাগ, গোঘাট, খানাকুল অঞ্চলের দুধ থেকে যে ছানা তৈরি হয় সেই ছানা দিয়ে পনির বানানো গেলে, তার মান সারা ভারতে সর্বোত্তম হত কারণ অত নরম ছানা আর কোনও দুধেই হয় বলে জানা নেই। ওই ছানার পনির সারা উত্তর ভারতের বাজার ধরে নিতে পারত অক্লেশে। বিপুল কর্মসংস্থান হত, হুগলি, অবিভক্ত মেদিনীপুর এবং বর্ধমানের অংশবিশেষে। বলব কাকে, শুনবে কে? মদ থেকেই যখন এত রাজস্ব আসছে তখন ডেয়ারি শিল্পের পুনরুত্থান নিয়ে ভাবে কোন পাগল?

ইংরেজি গানের একটা লাইন মনে পড়ে যায়, “হাউ ইউ সাফার্ড ফর ইয়োর স্যানিটি।” কিন্তু এখন সইতে না পারলেও কইতে যাওয়া মানা। আগুন যেখানেই থাকুক, ধোঁয়া যে ঘিরে ফেলেছে।a

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement