শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রবণতাটি পশ্চিমবঙ্গে নতুন নয়। দ্য কেরালা স্টোরি কাণ্ড দেখতে দেখতে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তসলিমা নাসরিনের দ্বিখণ্ডিত উপন্যাস নিষিদ্ধ করার কথা উঠল। মনে পড়ছে, লেনিনের নিতম্ব দেখানোয় আলেকজ়ান্ডার সকুরভ-এর টরাস ছবিটিকে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব থেকে তুলে নেওয়ার কথাও। ‘নন্দন’-এ প্রদর্শন বন্ধের মুখে পড়েছিল হারবার্ট বা আরেকটি প্রেমের গল্প। আর, পশুখামার বা উইঙ্কল টুইঙ্কল নাটকের শো বন্ধ করে দেওয়া— এ তো সে দিনের ঘটনা।
শাসক অতি-উদ্যোগী হয়ে নাটক বা সিনেমা বন্ধ করে দেন কেন? এর খুব সহজ একটা উত্তর হল, নিরাপত্তাহীনতা। এই নিরাপত্তাহীনতা আসলে শাসকের সহজাত। অবশ্য, পরিচিত কিছু যুক্তি শাসকের পক্ষে সব সময়ই প্রস্তুত থাকে। কখনও তা হয় ইতিহাসবিকৃতি, কখনও সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষার দায়, আবার কখনও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা।
সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষা কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা যদি শাসকের ঢাল হয়, তবে, সে দিন টরাস-এর বিরুদ্ধে বাম সমর্থকদের রাস্তায় নামা এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে সমবেত প্রতিবাদ জানিয়ে আসার পরে চলচ্চিত্রটির প্রদর্শন বন্ধ করা যথাযথ বলে গণ্য করতে হবে। এবং একই ভাবে সমস্ত বই, নাটক বা চলচ্চিত্রের মতো শিল্পকে নিষিদ্ধ করার সহজ ফর্মুলা হিসাবে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। কেননা প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই কিছু নিজস্ব সমর্থক আছে, আর সুযোগ-সুবিধামতো তাদের রাস্তায় নামানো যেতেই পারে।
দ্য কেরালা স্টোরি-সহ অন্যান্য নিষিদ্ধ বই, চলচ্চিত্র বা নাটকের ক্ষেত্রে আর যে অভিযোগগুলি পড়ে থাকে তা হল ইতিহাসবিকৃতি অথবা প্রোপাগান্ডার অভিযোগ। চলচ্চিত্র কি প্রোপাগান্ডা হতে পারে? শুধু চলচ্চিত্র কেন, যে কোনও শিল্পই তো প্রোপাগান্ডার মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে, পক্ষ নিতে পারে। চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটক, নাটকে উৎপল দত্ত, সাহিত্যে নবারুণ ভট্টাচার্য, ছবিতে চিত্তপ্রসাদ— অনেকেই সফল ভাবে পক্ষ নিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
ঋত্বিক ঘটক ঘোষিত ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, চলচ্চিত্রকে তিনি তাঁর প্রচারের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করবেন। এর থেকে ব্যাপকতর কোনও মাধ্যম পেলে, তিনি যে ভাবে নাটক ছেড়ে চলচ্চিত্রকে ধরেছেন, সে ভাবেই চলচ্চিত্রকে ছেড়ে সেই মাধ্যমের কাছে চলে যাবেন। উৎপল দত্ত ঘোষণা করেছিলেন তিনি প্রোটাগোনিস্ট হয়ে তাঁর কথাগুলি বলার জন্যই নাটকে এসেছেন। চিত্তপ্রসাদ মনে করতেন, ছবির সামাজিক দায়বোধ থাকা উচিত। ব্যক্তিজীবনের চর্চার সঙ্গে শিল্পকে মিলিয়ে তিনি স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন।
যে কোনও শিল্প যদি সমাজদেহে আলোড়ন তুলতে পারে, তবে তা সফল ও সার্থক বলেই তো ধরা হয়। এখন বলা যেতে পারে— সেই আলোড়নের ফল যদি ঋণাত্মক হয়? তাকেও কি স্বীকার করে নিতে হবে? একটি চলচ্চিত্র এত সহজেই যদি কোনও সমাজের সুস্থিতি নষ্ট করতে পারে, তা হলে বুঝতে হবে সেই সমাজের স্থিতি বলে আমরা যা বুঝে আসছি, আসলে তা ফাঁপা ও অন্তঃসারশূন্য।
হাতে হাতে স্মার্টফোন এবং সহজলভ্য ইন্টারনেটের যুগে কোনও সাংবাদিককে কথা বলতে না দিয়ে, কেবল পুঁজির জোরে সেই মিডিয়া সংস্থা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করলেও তাঁর মতামত জনসমক্ষে আসা থেকে আটকে দেওয়া যায় না। একটি তথ্যচিত্র কোনও একটি নির্দিষ্ট মাধ্যম থেকে মুছে ফেললেই সমগ্র ইন্টারনেট জগৎ থেকে তা মুছে ফেলা যায় না। তেমনই, প্রেক্ষাগৃহে কোনও চলচ্চিত্র চলতে না দিলে তাকে ‘পাবলিক ডোমেন’ থেকে সরানো যায় না। বরং তার প্রতি নিষিদ্ধ আগ্রহ আরও বাড়ে। নিছক প্রোপাগান্ডা মনে করে যাঁরা হয়তো কখনওই আর দেখতেন না, তাঁরাও এর পর এক বার এ ছবিতে চোখ বোলানোর চেষ্টা করবেন।
সুপ্রিম কোর্ট দ্য কেরালা স্টোরি চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনে এ রাজ্যের নিষেধাজ্ঞার উপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শাসক দলের মুখপাত্র যা জানান তার মর্ম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আদালত যখন বলেছে, তখন রাজ্যের আর কোনও দায়িত্ব থাকল না। আসলে কিন্তু দায়িত্বটা রইলই। দু’দিক থেকে দায়িত্ব। এক, চলচ্চিত্রটি যাতে সুষ্ঠু ভাবে প্রেক্ষাগৃহে চলতে পারে তার ব্যবস্থা করা। দুই, প্রেক্ষাগৃহে ও বাইরে সামগ্রিক পরিস্থিতির মধ্যে সব ধরনের অশান্তি প্রতিরোধ করা।
কোনও সরকার যদি মনে করে যে একটি চলচ্চিত্র, একটি নাটক, একটি ছবি, বই বা যে কোনও শিল্পকর্ম সমাজের স্থিতাবস্থা নষ্ট করে দিতে পারে, তা হলে তার বোঝা দরকার— সমন্বয় ও স্বাভাবিক সহাবস্থানের ক্ষয় ধরা গাঁথনিতে বিভেদ ও বিদ্বেষ শিকড় গেঁথে বসে আছে। এই অবস্থায় সেই সমস্ত শিল্পকর্মের প্রতি বিদ্বেষ না দেখিয়ে, বিকল্প ভাবনা আর সমন্বয়ী চিন্তনের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করা দরকার। এর জন্য সমান্তরাল ও বিপরীতমুখী তথ্যচিত্র নির্মাণ করা যেতে পারে। তৈরি করা যেতে পারে বিজ্ঞাপন, পোস্টার। কে করবে? সরকারের একটি গোটা দফতর রয়েছে তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক। কিন্তু তারও আগে, শাসকের নীতির মধ্যে থাকতে হবে সামঞ্জস্যের বার্তা। রাজনৈতিক আচরণ হতে হবে যথাসম্ভব পক্ষপাতমুক্ত।
ঝড় আটকে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করার চেয়ে আগাম সতর্কতা নিলে কাজ হয় বেশি— জানা কথা।