যে ভাবে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যালট বাক্সের উপর আছড়ে পড়ল অবিশ্রান্ত গণরোষ, তা সাম্প্রতিক কালে বিরল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ওই মধ্যবয়সিনীকে বহু দিন মনে থাকবে। আটপৌরে শাড়িটা দু’হাতে সামান্য তুলে বাঁ পা দিয়ে সপাটে একটা ‘শট’ (লাথি নয়। শট। ফুটবলাররা যেমন মারেন। মেসি বা রোনাল্ডো) মারলেন জলপাই রঙের বাক্সটায়। টিনের বাক্স লাট খেতে খেতে গিয়ে পড়ল কাঁচা, খোলামুখ নর্দমায়।
ওই কিশোরকেও অনেক দিন মনে থাকবে। পরনে সস্তার টি-শার্ট আর হাফ প্যান্ট। বাক্স কোলে নিয়ে পোঁ-পোঁ দৌড়! কে জানে কোন তেপান্তরে।
মনে থাকবে সেই প্রার্থীর কথা, যিনি বুথের মধ্যে সর্বসমক্ষে একটা বোতল থেকে অতি যত্নে একের পর এক ব্যালট বাক্সে জল ঢেলে দিচ্ছিলেন। বিনা বাধায়। ক্যামেরার সামনে।
মনে থাকবে মাথার চুল পাতলা হয়ে-আসা, খোঁচা গোঁফ, সামান্য বক্রদৃষ্টি, চশমা-চোখকেও। বাঁশপেটা করে যিনি আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিলেন লেবেল-আঁটা বাক্সটায়। এক ঝলক দেখে বোঝা যায় না, তাঁর ভিতর থেকে এত ঘৃণা, দ্বেষ এবং বিক্ষোভের লাভাস্রোতের উদ্গীরণ হতে পারে!
ওই মধ্যবয়সিনী গৃহবধূ, ওই কিশোর, ওই প্রার্থী, ওই খোঁচা গোঁফ কি রোজ রোজ এমনই প্রতাপ দেখান তাঁদের পরিপার্শ্বে? না কি নেহাতই মিনমিনে, জবুথবু, নিরীহ, কখনও গলা না-তুলে কথা-বলা, কখনও সংসারের ভারে ভারাক্রান্ত, কখনও কর্মস্থলে তেলবাগীশ হয়ে জীবন কাটান? সুযোগ বুঝে যাঁদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে কলহপ্রিয় বাঙালি? তাঁদের মধ্যে কি ঘাপটি মেরে বসে থাকে অন্য একটা মানুষ? যে অপেক্ষা করে থাকে সঠিক মুহূর্তের জন্য? সেই মুহূর্তটা চলে গেলে যে আবার শান্ত, নিরীহ, বিনয়ী?
দেখতে দেখতে প্রায় ৩০ বছর আগের একটা ঘটনা মনে প়ড়ল। এসপ্ল্যানেড ইস্টে একটা বিক্ষোভ হচ্ছিল কোনও এক রাজনৈতিক দলের। জুনিয়র রিপোর্টারকে ‘কভার’ করতে পাঠানো হয়েছে। ইট-পাটকেল চলছে। বাসে আগুন লাগানোর চেষ্টা। পুলিশের লাঠিচার্জ। চারদিকে আতঙ্কিত মানুষের ছোটাছুটি। ‘কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ়’-এর সামনে দাঁড়িয়ে দেখছি আর নোট নিচ্ছি। একটা সময়ে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করল পুলিশ। শিক্ষানবিশ থাকাকালীন শিখেছিলাম, কাঁদানে গ্যাস ছুড়লেই রুমাল ভিজিয়ে চোখে দিতে হবে। তা হলে জ্বলুনিটা হবে না। কাছের রেস্তরাঁ থেকে সেই কাজটা সেরে আবার এসে দাঁড়ালাম। তত ক্ষণে পরিস্থিতি খানিকটা থিতিয়ে এসেছে। আচমকাই নজর গেল একটি দোহারা চেহারার ছেলের দিকে। পরনে সাধারণ টি-শার্ট আর ট্রাউজার্স। হাতে কিছু বই-খাতা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। হরলিক্সের বোতলের তলদেশের মতো মোটা কাচে নির্ঘাত ব্যাপক পাওয়ার।
ছেলেটি ফুটপাথ ধরে এগোতে এগোতে চারদিকটা এক বার মেপে নিল। তার পর রাস্তা থেকে পর পর আধলা কুড়িয়ে পিছন ফিরে-থাকা পুলিশকে ‘টিপ’ করে ছুড়ল। নির্ভুল নিশানা। দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিশকর্মীর পিঠে গিয়ে পড়ল ইট। আহত না-হলেও তিনি চমকে ঘুরলেন। পিছু ফিরে দেখলেন আপাত-নিস্তরঙ্গ ধর্মতলার রাস্তা। ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে এক যুবক। পরনে টি-শার্ট আর ট্রাউজ়ার্স। হাতে কিছু বই-খাতা। চোখে মোটা ফ্রেমের পাওয়ার-ওয়ালা চশমা। নিরীহ। নির্বাক। উদাসীন।
পঞ্চায়েত ভোট চলাকালীন আশপাশের আপাত-নিরীহ মানুষজনকে নিয়ে দিনভর এবম্বিধ দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল— ব্যালট বাক্স, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ!
গুগলীকৃত অনুসন্ধান বলছে, ব্যালট বাক্স হল সাময়িক ভাবে বন্ধ একটি বাক্স। সাধারণত চতুষ্কোণ। যদিও মাঝেমধ্যে মুখবন্ধ থলিও হতে পারে। কিন্তু সেটা খুবই বিরল। সারা পৃথিবীর মধ্যে ইংল্যান্ডে প্রথম ব্যালট পেপার এবং ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা হয়েছিল। কাকতালীয় ভাবে সেই তারিখটা ছিল ১৫ অগস্ট। তবে সাল ১৮৭২। উইকিপিডিয়া বলছে, ব্যালট বাক্স সাধারণত ভোটকেন্দ্রে থাকে। তবে আয়ার্ল্যান্ড, ইটালি এবং রাশিয়ায় অশক্ত ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ব্যালট বাক্স নিয়ে যাওয়া হয়, যাতে তাঁরা ভোট দিতে পারেন। পড়ে মনে হল, এই-ই হল আসল ‘দুয়ারে ভোট’! বাংলার পঞ্চায়েত ভোটেও কি আর দু’চার পিস ব্যালট বাক্স কেউ কেউ বাড়ি নিয়ে যাননি? যাতে ভোট দিতে সুবিধে হয়!
সত্যি কথা বলতে কি, এই পঞ্চায়েত ভোটে এত প্রাণহানির পাশাপাশি যদি কারও সম্মানহানি হয়ে থাকে, তা হলে সে ওই জলপাইরঙা বাক্স। যে ভাবে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যালট বাক্সের উপর আছড়ে পড়ল অবিশ্রান্ত গণরোষ, তা সাম্প্রতিক কালে বিরল। বিপণনের পরিভাষায় যে কোনও পণ্যকে মনুষ্য অবয়ব দিয়ে কল্পনা করে নেওয়া হয়। অতটা না-হলেও ব্যালট বাক্সের একটা শরীরী অবয়ব রয়েছে বইকি! যদিও সেটা ‘প্রতীকী’। আবহমান কাল ধরে ব্যালট বাক্স গণতন্ত্রের প্রতীক। যেখানে সযত্নে রক্ষিত থাকে আমজনতার নিজস্ব এবং গোপন মতামত। এই পঞ্চায়েত ভোটে সেই প্রাণীটিকে বড় অসহায় মনে হল! যা আসলে গোটা ভোটপ্রক্রিয়াটার মধ্যেই একটা প্রহসনের ছোঁয়া লাগিয়ে দিয়ে গেল।
তবে এর সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, ভারতে এখন প্রায় কোথাওই আর ব্যালটে ভোট হয় না। ভোট নেওয়া হয় বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রে। ফলে ব্যালট বাক্স তার সুপ্রাচীন ‘ঐতিহ্য’ এবং ‘কৌলীন্য’ হারিয়েছে। একই সঙ্গে হারিয়েছে ‘গুরুত্ব’ও। ব্যালট বাক্স এখন পুরাণের চরিত্রের মতো। দুই, হাতে হাতে স্মার্টফোনের উদ্ভবের ফলে ব্যালট বাক্সের যে ‘বস্ত্রহরণ’ আগে হত লেন্সচক্ষুর অন্তরালে, তা এখন হচ্ছে ভার্চুয়াল রাজদরবারে।
ভারতের বহু রাজ্যেই পঞ্চায়েত বা পুরসভা (রাজ্যান্তরে ‘নগরপালিকা’) ভোট হয়। কিন্তু সেটা আপাতদৃষ্টিতে অতটা ‘রাজনীতি-মুখর’ নয়। যেখানে দলের তুলনায় প্রার্থীর গুরুত্ব বেশি থাকে। নীতি-আদর্শ ইত্যাদির চেয়ে স্থানীয় এলাকায় উন্নয়নের গুরুত্ব বেশি থাকে। এমনকি, অনেক জায়গায় সেই ভোট কোনও রাজনৈতিক দলের ব্যানারেও হয় না। কিন্তু এই রাজ্যে যে কোনও ভোটই বরাবর ‘রাজনৈতিক’। ফলে ব্যালটে ভোট হলে ব্যালট বাক্সের এমন পরিণতি প্রতি বারই হয়। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, এ বার একটু বেশিই হয়েছে। কারণ, এ বার বেশির ভাগ আসনে নির্বাচন হয়েছে। ফলে যেখানে যেখানে বিরোধীরা শক্তিশালী, সেখানে সেখানে ‘প্রতিরোধ’ হয়েছে। ফলিত স্তরে সেই ‘প্রতিরোধ’ হল ব্যালট বাক্স নিয়ে গেন্ডুয়া খেলা। নইলে কি আর বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অনির্বচনীয় শ্লাঘার সঙ্গে প্রকাশ্যে বলেন, ‘‘আমি তো বলে দিয়েছিলাম, যেখানে যেখানে ছাপ্পা ভোট হবে, সেখানে ব্যালট বাক্স নিয়ে পুকুরে ফেলে দেবে!’’ বাস্তবেও সেটাই হয়েছে। কারণ, বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি এখন খানিকটা পেশিশক্তি দেখাতে পারছে। সিপিএম একটু জলবাতাস পেয়েছে। তাই বিষয়টা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কিন্তু খেলাটা পুরনো। ফলে ধরাও পড়ে যাচ্ছে।
ভোটের বুথ থেকে ইচ্ছে মতো ব্যালট বাক্স নিয়ে কেটে পড়া বা পুকুরের জলে ফেলে-দেওয়া দেখে ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল। যখন পাড়ার বড়লোকের ছেলের ব্যাট-বল-উইকেট নিয়ে বন্ধুরা ক্রিকেট খেলতাম (সে-ই ওপেন ব্যাট এবং ওপেন বল করবে— এই শর্তে)। কিন্তু সে ছেলে নিজের ইচ্ছায় (বিশেষত, প্রথম বলে আউট হয়ে গেলে) খেলা ভন্ডুল করে দিয়ে ব্যাট-বল-উইকেট বগলে বাড়ি চলে যেত। অর্থাৎ, সরঞ্জামই নেই! খেলবি কী দিয়ে? তার মধ্যে প্রক্রিয়া ভন্ডুল করার প্রয়াস আছে। স্কিল আয়ত্ত করে বিপক্ষ বোলারের মোকাবিলা করার মানসিকতা নেই। এখানেও তা-ই। ব্যালট বাক্সই নেই! ভোট দিয়ে ব্যালট পেপার রাখবি কোথায়? প্রক্রিয়াটা ভন্ডুল করে দেওয়া আছে। কিন্তু বুথে বুথে সংগঠন বাড়িয়ে প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করার পন্থা নেওয়া নেই! সেই কারণেই ব্যালট বাক্সের ‘কৌলীন্য’ রক্ষারও কোনও দায় নেই।
তবে একই সঙ্গে একটা আশ্বস্তিও হল। আগামী বছর লোকসভা ভোট এবং ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে অন্তত ব্যালট বাক্সের এই ‘অপহরণ এবং শ্লীলতাহানি’ দেখতে হবে না। কোনও পক্ষেই। কারণ, সেখানে ভোট হবে বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রে। প্রশ্ন করতে হবে না, ব্যালট বাক্স, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ!
তবে কিনা, প্রশ্ন থাকলে তখন উত্তরও থাকবে— গণতন্ত্রের জটা হইতে!