প্রতীকী ছবি।
ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা তার নাগরিকদের সঙ্গে এমন একটা ব্যবহার করে, যেন তারা কোনও কারাগারে বন্দি। এটা কার্যত ধরেই নেওয়া হয় যে, তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনরা যেমন খুশি আচরণ করতে পারেন। কেন্দ্রে বা রাজ্য যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের এই সহিংস মনোবৃত্তি একই ভাবে বলবৎ থাকে।
এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় খতিয়ে দেখতে পারেন। প্রথমত, দেশের কারাগারগুলিতে যাঁরা আটক রয়েছেন, তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কোনও অপরাধ করেননি। তাঁরা আদালতের দীর্ঘমেয়াদি বিচার প্রক্রিয়ার কারণে ফাটকের অন্তরালে। আর এই প্রক্রিয়া বছরের পর বছর, এমনকি, দশকের পর দশকেও শেষ হয়নি। বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে করতেই অনেকে মারা গিয়েছেন। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলেন স্ট্যান স্বামী। দ্বিতীয়ত, কর আদায়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত দফতরগুলি প্রতি বছর হাই কোর্টগুলিতে করসংক্রান্ত মামলার ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই হেরে যায়। শীর্ষ আদালতে মামলার ৭৪ শতাংশে তারা হেরে যায়। আদালতের মূল্যবান সময় এ ভাবে নষ্ট করার দায় কে নেবে? করদাতারা যে ভাবে দিনের পর দিন হয়রান হচ্ছেন, তার দায়ভার কে গ্রহণ করবেন? উত্তরে কেবল মৌনতাই পাওয়া যাবে। তৃতীয়ত, শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণকারীরা সামগ্রিক আর্থিক জরিমানার মাত্র ১ শতাংশ আদায়ে সমর্থ হন। সেই ১ শতাংশের জন্যই নোটিস জারি হয়। ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ৮১, ০৮৬ কোটি টাকা আদায়ের নোটিস জারি হয়েছিল। কিন্তু সেই বছর ‘দ্য সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া’ তার মধ্যে মাত্র ৮৮৭ কোটি টাকা আদায়ে সমর্থ হয়।
এই তিনটি উদাহরণই এক ধরনের ‘স্বেচ্ছাচার’। বা অন্য ভাষায় বলতে গেলে, রাষ্ট্রের তরফে পণ্ডশ্রম বলে মনে হতে পারে। অন্ততপক্ষে নাগরিকদের অবস্থান থেকে দেখলে তা-ই মনে হয়। নাগরিকদের কাছে পুরো প্রক্রিয়াটাই কার্যত একটা শাস্তি। যদি আপনি আপনার জীবনের ২০ বছর কারাগারে কাটান অথবা আইনি খরচ মেটাতে গিয়ে দেউলিয়া হয়ে যান, তা হলে সেই মামলায় আপনি হারলেন বা জিতলেন, তাতে কি আদৌ কিছু এসে গেল?
প্রতীকী ছবি।
দেশের ভিতরে যখন এমন সব কাণ্ডকে আমরা আমাদের ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কুফল বলে আমরা মেনেও নিয়ে থাকি, তখন খেয়াল রাখা দরকার দেশের বাইরেও কিন্তু এই একই খেলা রাষ্ট্র খেলে চলে। সেই খেলায় সে ঊল্টো চাপও খায়। যা সাধারণত অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ঘটে না। এমন ক্ষেত্রের তিনটি উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। ‘কেয়ার্ন’, ‘ভোডাফোন’ এবং ‘ডেভাস মাল্টিমিডিয়া’। প্রথম দু’টি ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায়ে ভারত আন্তর্জাতিক স্তরে স্বেচ্ছাচার করতে গিয়ে মুখ পোড়ায়। সর্বজনসম্মত সিদ্ধান্তে আসতে ব্যর্থ হয়। এ নিয়ে আবেদনের পালা অবশ্য চলছে। কিন্তু ‘কেয়ার্ন’ কিছু ভারতীয় সম্পদ, যেমন— রিয়েল এস্টেট, পাবলিক সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ব্যাঙ্কের অর্থ এবং এয়ার ইন্ডিয়ার মতো বিমান পরিবহণ সংস্থাকে অন্য দেশে কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছে। ‘ডেভাস মাল্টিমিডিয়া’ অ্যান্ট্রিক্স কর্পোরেশন ( ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সহযোগী প্রতিষ্ঠান)-এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে। এক চুক্তিভঙ্গের বিষয়ে ওই মামলা হয়। সেই বিষয়টিই সম্ভবত কেয়ার্ন মনে রাখে এবং আন্তর্জাতিক মহলে ভারতকে আরও বেশিমাত্রায় অপদস্থ হতে হয়।
লক্ষ করার বিষয়, এই তিনটি ঘটনাই ঘটে মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে। এর মধ্যে দু’টি ঘটনা ঘটে ২০১২ সালের বাজেটে আগের করব্যবস্থায় সংযোজন ঘটাতে গিয়ে। এমন কর আরোপ কেবল যে ভারতেই হয়েছে, তা নয়। অন্যান্য অনেক দেশেই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এমন কর চালু হয়েছে যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে যেটা দেখা গেল—সার্বভৌম করের বিষয়টিকে বিনিয়োগের তুল্য হিসেবে দেখা হল এবং দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ নিশ্চয়তার চুক্তি অমান্য করার প্রশ্ন উঠে এল (মোদী সরকার তড়িঘড়ি এমন ৫০টি চুক্তি বাতিল করেছিল)। ডেভাস-অ্যান্ট্রিক্স চুক্তি মনমোহন সিংহ সরকার লঙ্ঘন করে বিবিধ কারণে। ইসরো-র এক প্রাক্তন চেয়ারম্যানকে সরকারি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আমেরিকান আদালতে পরবর্তী সময়ে ডেভাস এই যুক্তি দেখায় যে, ন’জন মধ্যস্থতাকারী এবং তিনটি আন্তর্জাতিক বিচারালয় এই চুক্তিভঙ্গকে বেআইনি বলে চিহ্নিত করেছে। এই তিনটি মামলাতেই কিন্তু বেশ কয়েক লক্ষ ডলার খরচ হয়ে যায়।
প্রতীকী ছবি।
২০১৪-র নির্বাচনে বিজেপি ‘কর সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে জিগির তোলে। এবং ক্ষমতায় এসে তারা ইসরোর-র সেই চেয়ারম্যানকে তার সদস্য হিসেবে পুনর্বহাল করে। কিন্তু শাসনের সাত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও দেখা যায়, সেই ‘কর সন্ত্রাস’ তার সরকারের মুখেও চুনকালি দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ কর সংক্রান্ত মামলাগুলিতে সরকার পক্ষের পরাজয় জারি থেকেছে। কিন্তু আগের থেকে একটা পার্থক্য দেখা গিয়েছে। তা হল—বিচারপ্রক্রিয়াকে ‘শাস্তি’-র স্তরে নিয়ে যেতে গিয়ে রাষ্ট্রকে কোনও অর্থদণ্ড দিতে হয়নি। আর এটাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক স্তরে একটি রায় যদি কারও বিপক্ষে যায়, তবে রাষ্ট্রকেও তার ফল ভোগ করতে প্রস্তুত থাকতে হয়।
যদি এই বিপর্যয়গুলি রাষ্ট্রকে ভিন্নতর আচরণের শিক্ষা দিয়ে থাকে, তবে তার মধ্যে এটাও অন্তর্ভুক্ত যে, নতুন ডিজিটাল গণমাধ্যম সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে মূলগত আইনি ব্যবস্থার সীমানা বাড়ানোর ও যথেচ্ছ কাজের সুযোগে লাগাম পরানোর বিষয়টিও রয়েছে। নাগরিকদের বা নেটাগরিকদের তা-ও মনে রাখতে হবে।