প্রতিবাদ: ফাদার স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামীর মৃত্যুতে বিক্ষোভ। ৬ জুলাই, কলকাতা। পিটিআই।
জেসুইট পাদরি ফাদার স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামীর মৃত্যুর খবর জেনে স্তম্ভিত ও মর্মাহত হলাম। এই মৃত্যুকে কিছুতেই সাধারণ মৃত্যু বলা যায় না। এ হল স্পষ্টত হত্যা। তিলে তিলে, দিনের পর দিন কষ্ট দিয়ে দিয়ে হত্যা। এবং সেই হত্যা সংঘটিত হল রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পরোক্ষ ভাবে এই হত্যার মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার দিকে মন দিয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ করি না। সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের নেত্রী কবিতা কৃষ্ণন বিজেপির ওই দুই প্রধান পরিচালকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন, স্ট্যান স্বামীর এই ভাবে মৃত্যুর পর আমি সেই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভাবে সমর্থন করছি। তাতে যদি আজ থেকে আমার গায়ে ‘মাওবাদী’ বা ‘শহুরে নকশাল’ তকমা আটকে যায় তো যাক।
৮৪ বছরের এক বৃদ্ধ যাজক, যিনি চশমা ছাড়া কার্যত অন্ধ, সেই বৃদ্ধকে গ্রেফতার করার সময় তাঁর বিশেষ প্রয়োজনীয় সঙ্গী চশমাটিকেও সঙ্গে নিতে দেননি গ্রেফতারকারী আফিসারেরা। কেন? চশমা কি কোনও বিস্ফোরক? আসলে বিস্ফোরক হলেন গ্রেফতার হওয়া মানুষটি, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় অশক্ত শরীর নিয়েও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন যিনি। পারকিনসন্স ব্যাধি তাঁকে আক্রমণ করেছিল। এই বৃদ্ধ তরল খাবার ছাড়া কিছু খেতে পারতেন না। খাবার চটকে দিলে স্ট্র ও সিপার ব্যবহার করে তবে সেই খাবার তিনি গলা দিয়ে নামাতে পারতেন। গ্রেফতারকারী আধিকারিকরা তো বটেই, এমনকি তদন্তকারী আধিকারিকরাও ফাদার স্ট্যান স্বামীকে তাঁর খাদ্য গ্রহণের পক্ষে অত্যাবশ্যক সেই স্ট্র ও সিপার সঙ্গে নিতে দেননি। পরে বার বার আদালতে আবেদন করে তবে তাঁকে স্ট্র ও সিপার ব্যবহার করার অনুমতিটুকু দেওয়া হয়। এই স্ট্র ও সিপার, যে দু’টির সাহায্য ছাড়া রোগাক্রান্ত অশীতিপর বৃদ্ধের খাদ্য গ্রহণ করা অসম্ভব ছিল, চশমার মতো সেগুলোও কি ছিল কোনও প্রাণঘাতী অস্ত্র?
সংবাদপত্র থেকে জানতে পারলাম, এই স্ট্র ও সিপার যখন বৃদ্ধ পাদরিকে খাওয়ার সময় ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হল, তত দিনে তিনি প্রায় না খেতে পেয়ে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বিচারকদের বিষয়ে কিছু বলা যায় না, তাতে নাকি আদালতের অবমাননা হয়। অন্যদের বিষয়ে দু’একটা প্রশ্ন করি। সুস্থ-সবল তদন্তকারী অফিসারেরা, যাঁরা সব খাদ্য খুব সহজেই খেতে পারেন; স্ট্যান স্বামীর জামিনের বিরোধিতা করা উকিলেরা, যাঁরা সুস্থ ও স্বাভাবিক, এবং সকল প্রকার খাদ্য অনায়াসে খেতে পারেন— তাঁরা কী করে ৮৪ বছরের এক বৃদ্ধের অতি সাধারণ তরল খাদ্য গ্রহণের অধিকারটুকুও কেড়ে নিতে পেরেছিলেন? যিনি চশমা ছাড়া কার্যত অন্ধ, কী ভাবে তেমন এক ব্যক্তিকে চশমাহীন ভাবে বন্দি করে রাখতে পেরেছিলেন? আমাদের এই গণতান্ত্রিক দেশে, তদন্তকারী অফিসারেরা, স্ট্যান স্বামীর জামিনের বিরোধিতা করা উকিলেরা, স্ট্যান স্বামীকে গ্রেফতার করা অফিসারেরাও তো সকলে ভরপেট খেয়ে তবেই গ্রেফতার করতে গিয়েছিলেন। সুস্থ ও সবল মানুষ হিসেবে সুখাদ্য গ্রহণ করেই কিন্তু তাঁরা ফাদারকে গ্রেফতার করতে যান; উকিলেরা স্ট্যান স্বামীর জামিনের বিরুদ্ধে আদালতে সওয়াল করতে আসেন বাড়ি থেকে খাওয়াদাওয়া করেই।
এজলাসে বসে যাঁরা বারে বারে স্ট্যান স্বামীর জামিনের আবেদন খারিজ করেেছন, তাঁরা কী ভাবছিলেন, জানতে ইচ্ছে করে। বিচারকদের সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে, এমন কোনও সংশয় প্রকাশ করার প্রশ্নই নেই। অনুমান করছি, তাঁরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা আইনের অক্ষর মেনেই নিয়েছেন— ভারতীয় সংবিধানের গণ্ডির বাইরে তাঁরা যাননি। তবু জানতে ইচ্ছে করে, এই জামিন নাকচ করার সিদ্ধান্ত যে এক ৮৪ বছর বয়সি বৃদ্ধকে প্রতি দিন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এই কথাটি কি তাঁরা ভাবেননি? আইনের অক্ষরের সঙ্গে মানবিক বোধের কোনও বিরোধ কি তাঁদের চেতনায় তৈরি হয়নি?
বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয়রা যে সংশয় প্রকাশ করেছেন, আমি তার সঙ্গে একমত— স্ট্যান স্বামীকে যে ভাবে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা বিজেপির প্রধান দুই কর্তার অগোচরে, বা অমতে হয়নি। আমরা ধরে নিতে পারি, আসলে মানুষটি অশক্ত বা রোগাক্রান্ত হতে পারেন, কিন্তু তাঁর— প্রয়াত ফাদার স্ট্যান স্বামীর— চিন্তাশক্তি ছিল এমন স্বাধীন, যা সম্ভবত নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের মতো দুই মহাশক্তিধর নেতাকেও ভয় পাইয়ে দিতে পেরেছিল। বলা বাহুল্য, নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহও ওই তদন্তকারী অফিসার ও গ্রেফতারকারী অফিসারদের মতোই, ওই জামিনের বিরোধিতা করা উকিলদের মতোই সব খাবার সহজে খেতে পারেন।
আমার মনে পড়ছে, ত্রিশের দশকে রাশিয়ার একচ্ছত্র শাসক জোসেফ স্তালিন কবি ওসিপ মান্দেলস্তাম-কে কেবল সন্দেহবশত গ্রেফতার করিয়ে সাইবেরিয়ায় পাঠান। সেখানে প্রবল শীত পড়ে। মান্দেলস্তামকে কোনও শীতবস্ত্র সঙ্গে নিতে দেওয়া হয়নি। মান্দেলস্তাম বার বার সকাতর আবেদন করতে থাকেন শীতবস্ত্রের জন্য। মান্দেলস্তামের স্ত্রী উপযুক্ত পরিমাণে শীতবস্ত্র সঙ্গে সঙ্গে প্রেরণ করেন। কিন্তু শীতবস্ত্রগুলি সাইবেরিয়ায় পৌঁছে ভারপ্রাপ্ত অফিসারদের হাতে পড়ে। সেই অফিসারেরা বিভিন্ন নিয়মকানুন দেখিয়ে ওই শীতবস্ত্র কবির কাছে পাঠাতে কেবলই দেরি করিয়ে দিতে থাকেন। নিশ্চয়ই স্তালিনের এ রকমই নির্দেশ ছিল। এও নিশ্চয়ই কোনও গোপন সূত্রে পাঠানো নির্দেশ। অবশেষে কবি ওসিপ মান্দেলস্তাম প্রবল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন, এবং ওই বন্দি শিবিরেই মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
ভারতের জেলে ফাদার স্ট্যান স্বামীর ক্ষেত্রে যা ঘটল, তার সঙ্গে মান্দেলস্তামের পরিণতির সাদৃশ্য কি পাওয়া যায় না? আবারও বলি, আমার বিশ্বাস, স্ট্যান স্বামীকে যে ভাবে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হল, এর পিছনে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান ক্ষমতাধারীদের নিঃশব্দ নির্দেশ ছিল, যে নির্দেশ লিখিত ভাবে জারি করা হয়নি। যে নির্দেশ লিখিত ভাবে জারি করা যায়ও না। হয়তো গোপন কোনও নম্বরের ফোনে এই নির্দেশ চলে গিয়েছিল গ্রেফতারকারী অফিসারদের বস বা অধিকর্তার কাছে, তদন্তকারী অফিসারদের উপরওয়ালার কাছে, এমনকি জামিনের বিরোধিতা করা উকিলদের কাছেও। স্তালিনদের কার্যক্রম কখনওই দুনিয়া থেকে চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব হয় না। সেই সব কার্যপ্রণালী ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন শাসকের হাত ধরে বার বার আবির্ভূত হয়।
স্ট্যান স্বামীর এই পরিকল্পিত ও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় শাসকদের প্রতি সুগভীর ধিক্কার জানাই।