সহ-যোগ: তালিবানের আফগানিস্তান দখলে উদ্বিগ্ন মিছিলে আফগান নারীদের প্রতি বার্তা, “তোমরা একা নও”, মালাগা, স্পেন, ২০ অগস্ট। রয়টার্স
একটা না একটা সময় যুদ্ধ থামে। আগুন নিবে আসে। শবদেহ ছাই হলে বা মাটির গভীরে আশ্রয় পাওয়ার পর শোকের আয়ু দীর্ঘায়িত হয় না। কারণ, জীবিতের দায় বড় বেশি। আফগানিস্তানে যাঁরা এই মুহূর্তে প্রাণ মুঠোয় করে বেঁচে আছেন, যাঁরা জানেন বা আন্দাজ করতে পারছেন তালিবান আফগানিস্তানে কী ভাবে দিনরাত্রি যাপন করছেন, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। যুদ্ধ কেন হয়— কিসের বিনিময়ে চলে পৃথিবীব্যাপী হত্যালীলা, তার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ঐতিহাসিক বিচারবিশ্লেষণের তালিকাও বৃহৎ, তবু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট পাখির মতো মানুষেরা যখন উড়োজাহাজ থেকে খসে পড়ে হাজার ফুট নীচে মাটিতে থেঁতলে এক তাল মাংসপিণ্ডে পরিণত হন, তখন সব ব্যাখ্যা, যুক্তি, বিশ্লেষণ পার হয়ে আমাদের মন-মাথা আচ্ছন্ন হয়ে ঝুলতে থাকে এক মহাশূন্যে।
বহুবিদ্যাজ্ঞ ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রেনে নোয়েল থিয়োফাইল জিরার্ড-এর তত্ত্ব ‘মিমেটিক ডিজ়ায়ার’ অর্থাৎ অনুকরণীয় বাসনা-র কথা আমাদের স্মরণে আসতেই পারে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে। জিরার্ডের ভাবনা অনুসারে, আমরা ভাবি যে, আমাদের প্রত্যেক চাহিদা, ইচ্ছা বা বাসনার মূলে বুঝি বা আছে আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীন ভাবনা— তা নয়, বরং আমরা আসলে যা যা কামনা করি— সমস্ত জিনিসের প্রতি আমাদের এই আকাঙ্ক্ষা আদতে অন্যের কামনা-বাসনার অনুকরণ। হয়তো কোনও দেশনেতা কিংবা রুপোলি পর্দার নায়ক-নায়িকা অথবা আমার প্রেমিক কিংবা শিক্ষিকা, হয়তো বা আমার কোনও নিকটজন— আসলে এঁদের ইচ্ছা, বাসনার দ্বারাই আমার আকাঙ্ক্ষা নির্ধারিত হয় এবং বলা বাহুল্য চক্রাকারে আমার দ্বারাও প্রভাবিত হন আরও বহু মানুষ, এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
সমস্যা হয় তখনই, জিরার্ড ব্যাখ্যা করছেন, আকাঙ্ক্ষার বা বাসনার এই সাযুজ্য অনেক সময় পরিণত হয় অমিল কিংবা শত্রুতায়, কারণ যখন আমাদের আকাঙ্ক্ষার লক্ষ্যবস্তু হয় একই, তখন সেই বস্তুকে ‘দখল’ করার জন্য আমরা পরস্পরের শত্রু হয়ে পড়ি। ‘অনুকরণীয় বাসনা’ পৌঁছয় তার দ্বিতীয় পর্যায়ে, অর্থাৎ ‘অনুকরণীয় শত্রুতা’য়। এই শত্রুতার কারণ হতে পারে কোনও বস্তু, কোনও মানুষ, কোনও জ্ঞান, কোনও প্রতিষ্ঠান। আমরা একে অপরের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে পড়ি বা যুক্ত হয়ে পড়ি হিংসার বন্ধনে। জিরার্ডের ব্যাখ্যায় তখন আমরা ‘ডাবল্স’।
আফগানিস্তানের মাটির উপর জবরদখলের যে ইতিহাস, তা আমাদের রেনে জিরার্ডের মহামূল্যবান তত্ত্বের মুখোমুখি দাঁড় করায়। আফগানিস্তানের উপর সোভিয়েট ইউনিয়নের দখলদারি, তাদের হটাতে আমেরিকা ও সৌদি আরবের সক্রিয়তা, আইএসআই-কে ব্যবহার করা, কোনও কিছুই বাদ পড়েনি। এই চলতি বছরে উঠে এল সেই চেনা ছবি। কুশীলবেরা পাল্টে গিয়েছে। আমেরিকার নিষ্ক্রিয়তার পাশাপাশি পাকিস্তান ও চিনের অতিসক্রিয় হয়ে ওঠার গল্প। এখানেও একটা বিষাদময় মোচড় আছে। ‘অনুকরণীয় বাসনা’ বা ‘অনুকরণীয় শত্রুতা’-র চক্র যখন ক্রমান্বয়ে চলতে থাকে, তখন একে ব্যাহত করতে প্রয়োজন হয় এক বলির পাঁঠার, যে নির্বিরোধী, দুর্বল— হয়তো এক জন ব্যক্তি, পশু, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, ধর্ম, জাতি, বিশেষ কোনও ভাবনা বা মতাদর্শ, কোনও শিল্পকর্ম অথবা একটি ‘দেশ’ও হতে পারে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যখন ঘোষণা করেন যে, উনি অনুতপ্ত নন এবং আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ সামলানো তাঁর সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নয়, তখন কূটনৈতিক তর্কে বিশ্ববরেণ্য নেতারা জিতে গেলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, স্বার্থ ফুরোনোর পরে যে কোনও পরাক্রমশালী দেশ ‘শান্তি ও সমৃদ্ধি’ ফেরানোর অছিলায় কী ভাবে একটা বলির পাঁঠা খোঁজে। প্রাণ হাতে করে বেঁচে থাকা আফগানিস্তানের পুরুষ-নারী-শিশু-বৃদ্ধরা সেই ‘বলির পাঁঠা’র দল। চিন-পাকিস্তানও তাদের মধ্যে এক ‘শান্তিপূর্ণ’ বোঝাপড়া তৈরি করেছে। ‘শান্তিপূর্ণ’ দূরত্ব রাখছে রাশিয়া। আর আফগানিস্তান জুড়ে ছড়াচ্ছে বারুদের গন্ধ।
গোটা পৃথিবীর চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষের কাছে এসে পৌঁছেছে সারা করিমি-র মর্মান্তিক আবেদন। ইনি আফগানিস্তানের এক জন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্দেশক। এই ভদ্রমহিলার বয়ান বলছে, তালিবানি অত্যাচার ও আগ্রাসনে কী ভাবে ধ্বংস হতে চলেছে তাঁর দেশ, তাঁর দেশের নারীদের সম্মান ও স্বাধীনতা, স্তব্ধ হতে চলেছে সভ্যতা ও নানান সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ। ওঁর কাতর আবেদন: চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক শিল্পী-কর্মী-রসিকজনেরা যাতে সরব হয়ে ওঠেন এই হিংস্রতার বিরুদ্ধে।
কোনও সন্দেহ নেই, এমন নানান বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পী, লেখক, বুদ্ধিজীবীরা নানান সময়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, আবারও তা-ই করবেন। তবু, এক-এক সময় সভ্যতার এমন মর্মান্তিক অপমান দেখতে দেখতে মনে সংশয় তৈরি হয়। মনে হয়, চলচ্চিত্র, নাটক, সঙ্গীত, চিত্রকলা, কাব্য শেষ পর্যন্ত কোন কাজে লাগল? এমন দ্বিধা বা সংশয় কি তা হলে দুর্বলতার লক্ষণ?
কর্তব্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিংস্রতার এই বর্বর রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে পড়া কি ভীরুতা বা অনিশ্চয়তার পরিচয় নয়?
পৃথিবী জুড়ে এমন সংশয়ী এক রাজপুত্রের গল্প আমরা পাঠ করেছি বারংবার। উইলিয়াম শেক্সপিয়র রচিত সেই চরিত্রের নাম ‘হ্যামলেট’। ফ্রিড্রিশ নিট্শে তাঁর লেখা ‘দ্য বার্থ অব ট্র্যাজেডি’-তে ব্যাখ্যা করছেন প্রয়াত পিতার হত্যার ইতিবৃত্ত জানবার পরেও পিতৃহন্তারক কাকা ‘ক্লডিয়াস’কে শাস্তি দিতে গিয়ে ‘হ্যামলেট’ যে বারংবার হোঁচট খায়, গভীর সংশয়ে ডুবে যায়, ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়ে, তা মোটেই ‘ভীরুতা’ বা ‘দুর্বলতা’র লক্ষণ নয়। বরং সত্যটাকে বুঝতে পারার জ্ঞান তাকে স্তব্ধ করে।
হিংস্রতার চিরাচরিত চক্রে অংশগ্রহণ করে ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার যে নির্দেশ হ্যামলেটের পিতার বিদেহী আত্মা দেয়, সেই নির্দেশ পালন করলে তাকেও যে ঢুকে পড়তে হবে সেই একই পচাগলা যুক্তিহীন হত্যালীলার বৃত্তে— এটা ভেবে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হ্যামলেট। নিট্শের এই ব্যাখ্যার থেকে আমাদের আরও একটু এগিয়ে দেন রেনে জিরার্ড। হ্যামলেটকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জিরার্ড এক ‘অপৃথককৃত’, ‘বেওয়ারিশ পরিসর’-এর কথা বলেন, যার দুই পারে দু’রকমের হাতছানি। আমরা এমনই এক সময়ে বাঁচছি, যখন ‘হয় প্রতিশোধ’ নয়তো ‘চূড়ান্ত নিষ্ক্রিয়তা’— এই দুইয়ের মাঝে আটকে পড়ে আমাদের বর্তমান পৃথিবী বারংবার নানান প্রশ্ন ও সংশয়ের জালে কিছুটা যেন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, হ্যামলেটের মতোই। তবু তার জড়তা ভাঙে এক সময়। একটি নাটক অভিনয় করে হ্যামলেট চেষ্টা করে তার পিতৃহন্তারক কাকার মনে অনুশোচনা ও পরিতাপের জন্ম দিতে। অচিরেই সে বুঝতে পারে যে, একটা শিল্পকর্ম পৃথিবীব্যাপী এই হিংস্রতাকে রুখতে পারে না। পারে না জাগাতে নৈতিক বোধ। শেক্সপিয়র শেষ পর্যন্ত হ্যামলেটকে নিয়োজিত করেন এক ট্র্যাজিক অন্তিমে। তবু হ্যাঁ, প্রতিশোধ আর না-প্রতিশোধের মাঝে যে পরিসরটুকু, তা আপাতদৃষ্টিতে যতই নিষ্ক্রিয় মনে হোক— শেষ পর্যন্ত তার গুরুত্ব অসীম।
বিদগ্ধ আলোচকরা বলেছেন, ‘হ্যামলেট’ এক অসম্পূর্ণ সৃষ্টি। তবু বারংবার প্রায় সমস্ত চিন্তাশীল মানুষ ফিরে ফিরে পাঠ করেছেন এই নাটক। মঞ্চস্থ ও চলচ্চিত্রায়িত করেছেন, লিখেছেন কবিতা, ছবি এঁকেছেন— হয়তো অসম্পূর্ণ বলেই। এই অসম্পূর্ণ, অসুন্দর পৃথিবীতে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভাষায়— “হ্যামলেট চিরসুন্দর— ভঙ্গুর, স্পর্শকাতর/ হ্যামলেট আমাদের গ্রহের সবখানে/ ঘর বাঁধতে চেয়েছিলো, পারেনি.../তাই সে এত অনির্বচন, অসহায় সুন্দর...”
হ্যামলেট আজ মনে করিয়ে দেয়, বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত মুক্তমনা মানুষের অসহায়তা। এই অসহায়তায় গ্লানি নেই। সত্যকে খুঁজে পাওয়ার আকুলতা আছে।