নিষেধাজ্ঞার ভবিষ্যৎ কী
US dollar

আন্তর্জাতিক লেনদেন ডলারে হয়, তাই আমেরিকার ক্ষমতা বিপুল

বিশ্বব্যাপী এই সঙ্কট সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি (সিবিডিসি) নিয়ে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

Advertisement

সব্যসাচী কর

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২২ ০৬:০৬
Share:

ইউক্রেনে সামরিক হামলার কারণে আমেরিকার নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি দেশ রাশিয়ার উপরে এক গুচ্ছ আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু, এই বিশ্বায়িত অর্থব্যবস্থায় রাশিয়া বিচ্ছিন্ন কোনও অস্তিত্ব নয়— জ্বালানি ও পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে সে দেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সরবরাহকারী। তাই এই আর্থিক নিষেধাজ্ঞার আঁচ লাগছে তার সঙ্গে বাণিজ্যসূত্রে যুক্ত দেশগুলির গায়েও। সেই সব দেশ ক্ষতির মাত্রা বিচার করে বিকল্প ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে; যেমন ভারতও রাশিয়া থেকে আমদানি অব্যাহত রাখার পথ খুঁজছে।

Advertisement

বিশ্বব্যাপী এই সঙ্কট সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি (সিবিডিসি) নিয়ে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাহত হওয়া বাণিজ্যিক লেনদেনের বিকল্প ব্যবস্থা সিবিডিসি হয়ে উঠতে পারে কি না, বিতর্কটা মূলত তা নিয়েই। সমস্যা এবং তার সম্ভাব্য সমাধানের প্রকৃত রূপটি কী, তা বোঝার জন্য প্রথমে বর্তমান লেনদেনের ব্যবস্থাটিকে বুঝতে হবে, সেই ব্যবস্থায় আর্থিক নিষেধাজ্ঞা কী ভাবে কাজ করে, তা দেখতে হবে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের বাজারটি মূলত ডলার-নির্ভর। অধিকাংশ দেশেই ডলার হল রিজ়ার্ভ কারেন্সি, অর্থাৎ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক নিজেদের সঞ্চয়ের ভান্ডারটি ডলারে রাখে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, লেনদেন ও বিনিয়োগও হয় ডলারের মাধ্যমেই। ডলারের মাধ্যমে হওয়া আর্থিক লেনদেন করতে হয় আমেরিকার অর্থব্যবস্থার মধ্যস্থতায়, ফলে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের ব্যবস্থার মধ্যমণি হল আমেরিকা। সেই লেনদেন আমেরিকার আইন অনুসারেই চলে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। নিউ ইয়র্কে অবস্থিত দ্য ক্লিয়ারিং হাউস ইন্টারব্যাঙ্ক পেমেন্টস সিস্টেম বা চিপস-এর মাধ্যমে প্রতি দিন অন্তর্দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ১.৮ লক্ষ কোটি ডলার। চিপস-এর সদস্যসংখ্যা মাত্র ৪৩। কোনও ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এই ব্যবস্থার সদস্য হতে গেলে আমেরিকায় আর্থিক নিয়ন্ত্রকের অধীনে তার উপস্থিতি আবশ্যিক। চিপস-এর সদস্য নয়, এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে লেনদেন করতে হলে এই সদস্য ব্যাঙ্ক বা সংস্থাগুলির মাধ্যমে করতে হয়। চিপসের সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারী সংস্থা বা সংস্থাগুলি তখন কাজ করে ওই প্রক্রিয়ার প্রতিনিধি বা এজেন্ট হিসেবে। এই কার্যক্রমকে বলা হয় ‘করেসপন্ডেন্ট ব্যাঙ্কিং সিস্টেম’।

Advertisement

আন্তর্জাতিক লেনদেন কার্যপ্রক্রিয়ার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল দ্য সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাঙ্ক ফিনানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশনস বা সুইফ্‌ট। এটি এক ধরনের নিরাপদ বার্তা প্রেরণ পরিষেবা, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দু’শোটি দেশের এগারো হাজারেরও বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর সদর দফতর বেলজিয়ামে। গত বছর দৈনিক গড়ে ৪ কোটি ২০ লক্ষ মেসেজ আদানপ্রদান হয়েছে সুইফ্‌ট-এর মাধ্যমে।

সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা না করে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে বেয়াড়া দেশকে শায়েস্তা করার, বা তার অবাঞ্ছিত আচরণ বন্ধ করতে চাপ দেওয়ার পদ্ধতিটি বহু পুরনো। উত্তর কোরিয়া বা ইরানের উপর যেমন বহু আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চেপেছে, তেমনই ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়ার উপরে সামরিক হামলা করার জন্য রাশিয়ার উপরেও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে পোখরান পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর ভারতের উপরেও নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছিল। আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনে ডলারের প্রবল আধিপত্যের কারণে এই ধরনের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার ক্ষেত্রে আমেরিকার ক্ষমতা বিপুল। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার ক্ষেত্রে আমেরিকার হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল ‘করেসপন্ডেন্ট ব্যাঙ্কিং সিস্টেম’। বর্তমানে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তাতে আমেরিকার ব্যাঙ্কগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার নিষিদ্ধ ব্যাঙ্কগুলির করেসপন্ডেন্ট অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে, তার লেনদেন স্থগিত রাখতে। ফলে সংশ্লিষ্ট রুশ ব্যাঙ্কগুলির কোটি কোটি ডলারের লেনদেন গিয়েছে আটকে। ‘সুইফ্‌ট’-এও রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় নিষিদ্ধ রুশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি বিশ্বের অন্যান্য আর্থিক সংস্থার সঙ্গে লেনদেন করতে পারছে না। তাতে যেমন রফতানিবাবদ টাকা পাওয়ার পথ বন্ধ হয়েছে, তেমনই সাধারণ মানুষের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারেও কোপ পড়েছে। প্রসঙ্গত, সুইফ্‌ট ব্যবস্থা আমেরিকার অধীন না হলেও আমেরিকা প্রতিষ্ঠানটির অবস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে— এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অমতেও— কারণ সুইফ্‌ট-এর গভর্নিং বডিতে আমেরিকার প্রতিনিধিত্ব আছে।

এই নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে বহু দেশ— ডলারে লেনদেন হবে না, এমন চুক্তির মাধ্যমে। তার মধ্যে রয়েছে ২০১২ সালে ভারতের চালু করা ‘রুপি-রিয়াল’ প্রক্রিয়া; রাশিয়া-চিনের ২০১৪ সালের কারেন্সি সোয়াপ চুক্তি; ক্রেডিট কার্ডে অন্তর্দেশীয় লেনদেনের জন্য ‘ন্যাশনাল পেমেন্ট কার্ড সিস্টেম’; সুইফ্‌ট-এর বিকল্প হিসাবে তৈরি করা রাশিয়ার মেসেজিং ব্যবস্থা সিস্টেম ফর ট্রান্সফার অব ফিনানশিয়াল মেসেজেস (এসটিএফএম) কিংবা চিনের ক্রস বর্ডার ইন্টারব্যাঙ্ক পেমেন্ট সিস্টেম (সিআইপিএস)। কিন্তু এই ব্যবস্থাগুলির সবই হয় সাময়িক, নয়তো সীমিত ক্ষমতার। তার ফলেই ডলার, আমেরিকার আর্থিক পরিকাঠামো এবং সুইফ্‌ট— কোনও দেশের উপর এই ত্রিমুখী নিষেধাজ্ঞা জারি হলে তা প্রভূত কার্যকর। এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা, যেগুলি সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থিক পরিকাঠামোকে পঙ্গু করে দেয়, তাকে বলে প্রাইমারি স্যাংশন বা মুখ্য নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়া দেশের সঙ্গে কোনও দেশ যদি আর্থিক সম্পর্ক বজায় রাখে, তা হলে সেই দেশগুলির উপরও এক গোত্রের নিষেধাজ্ঞা জারি করার সম্ভাবনা থাকে। একে সেকেন্ডারি স্যাংশন বা গৌণ নিষেধাজ্ঞা বলে।

বর্তমান আন্তর্জাতিক লেনদেন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সিবিডিসি প্রক্রিয়ার মৌলিক পার্থক্য হল, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী কোনও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা থাকে না— বিশেষত করেসপন্ডেন্ট ব্যাঙ্কের। যখন একাধিক দেশ পরস্পরের মধ্যে সিবিডিসি প্রক্রিয়ায় লেনদেন করে, তখন এই ভূমিকা নেয় সে দেশগুলির কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। বৈশ্বিক সিবিডিসি-র ক্ষেত্রে যে বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান অভিন্ন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তৈরি করবে, মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাটিও তারই। সিবিডিসি-নির্ভর আন্তর্জাতিক লেনদেন চালু হলে সুইফ্‌ট-এর মতো ব্যবস্থার গুরুত্বও হ্রাস পায়।

আগেই বলেছি যে, অতীতে যখন মুখ্য আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তখন ব্যক্তিবিশেষ বা দেশকে সঙ্গে সঙ্গে সুইফ্‌ট বা করেসপন্ডেন্ট ব্যাঙ্কগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সিবিডিসি-নির্ভর লেনদেন প্রক্রিয়ায় এই নিষেধাজ্ঞা অর্থহীন, কারণ সেই লেনদেন হয় এই চিপস বা সুইফ্‌ট-এর পরিকাঠামোর বাইরে। অন্তর্দেশীয় সিবিডিসি-র ক্ষেত্রে দেশগুলির কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায় বটে, কিন্তু সেই কাজটি কত দূর অবধি সম্ভব? মনে রাখা প্রয়োজন যে, বর্তমান ক্ষেত্রেই রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ, কাজটি যে করা যায় না, তা নয়। কিন্তু, বার বার এমন পদক্ষেপ করা মুশকিলের। কারণ আন্তর্জাতিক আর্থিক কার্যকলাপ অনেকখানি নির্ভরশীল বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের উপরে। বৈশ্বিক সিবিডিসি-র ক্ষেত্রে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির উপরে। তা কূটনৈতিক ভাবে আরও কঠিন, কারণ এটা সেই ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী সব দেশের বিরুদ্ধে এক সঙ্গে অর্থনৈতিক যুদ্ধঘোষণার শামিল হবে।

অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের বর্তমান ব্যবস্থাটি থেকে দুনিয়া যদি সিবিডিসি-নির্ভর লেনদেন ব্যবস্থায় চলে যায়, তখন কোনও দেশের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা অসম্ভব না হলেও এখনকার থেকে অনেক কঠিন হবে।

ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক গ্রোথ, নয়াদিল্লি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement