লড়াই: জুনিয়র চিকিৎসকদের ডাকে নবমীর সন্ধ্যায় ধর্মতলায় ধর্না মঞ্চের কাছে জমায়েত। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন চলছিল যত দিন, আমার মতো অনেকেই খুব দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন। এক দিকে চাইছিলাম যুব চিকিৎসকদের জয় হোক; অন্য দিকে আবার ‘অরাজনীতি’র মোড়কটি রাজনৈতিক ভাবে খুব যৌক্তিক ছিল না। সকালে বাড়ির বাজার কী হবে, তা নিয়ে বাঙালির তিন জনের অণু-সংসারে যে পরিমাণ রাজনীতি হয়, তাতে চিকিৎসকদের এত বড় আন্দোলনটি যে কোনও অর্থেই ‘অরাজনৈতিক’ হতে পারে না, তা নিয়ে কোনও সংশয়ই থাকতে পারে না। বড় জোর একে আপাতত দলহীন বলা যেতে পারে। এখন অনশন মিটেছে, ফলে সেই মঞ্চকে ঘিরে চলা রাজনীতির বিষয়ে দু’চার কথা বলা যেতে পারে।
একুশে অক্টোবর সন্ধেয় দু’-ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মিটিং চলল, সরাসরি সম্প্রচার। দুর্দান্ত গণতন্ত্র! টেলিভিশনের পর্দায় আমরা দেখলাম, কী ভাবে ‘ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো’ মুখ্যমন্ত্রীর মুখে মুখে কথা বললেন। এক জন মন্তব্য করলেন, উনি বলতে দিলে তবে তো বলব! অন্য জন বলে দিলেন, যাঁর নামে অভিযোগ, তাঁকে অভিযুক্তই বলে! মুখ্যমন্ত্রীর মুখের উপরে কথা শোনালেন আন্দোলনরত ‘সাধারণ মানুষ’— আর কী চাই! আমরা মনে করিয়ে দিলাম, এই দেখো, এ তো চিন নয়, উত্তরপ্রদেশও নয়— এখানে প্রতিবাদ করা যায়, আমরা খবরের কাগজে উত্তর-সম্পাদকীয় লিখতে পারি, ফেসবুকেও পোস্ট করতে পারি। সে কথা ঠিক— এই গণতন্ত্রটুকু আছে বলেই এখনও বিজেপি চারশো আসন পাবে বলে শেষ অবধি দুশো চল্লিশে আটকে যায়। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও, যেখানে এখনও বিজেপির জন্য দরজা খোলেনি পুরোপুরি, সেখানেও বাহাত্তর থেকে সাতাত্তরের কংগ্রেসি শাসন ছিল, চৌত্রিশ বছরের বামফ্রন্টের আধিপত্য ছিল, তেরো বছরের তৃণমূল কংগ্রেসের দাপটও আছে।
অনেকেই খেয়াল করলেন যে, গোটা বৈঠকে সরকারের তরফে কোনও মন্ত্রী নেই— বা, থাকলেও তাঁদের দেখা গেল না। বরং চোখে পড়ল আমলাদের উপস্থিতি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তুলনায় আমলাতন্ত্রের উপরে মুখ্যমন্ত্রীর দৃশ্যমান নির্ভরশীলতা যে একটা বিবৃতিও বটে, খেয়াল করলাম কি? যে ভাবে কিছু অধ্যক্ষকে জিজ্ঞাসা করা হল ‘ঠিক কি না’, তাতে হীরক রাজার কথা মনে পড়লেও পড়তে পারে। ‘ইংরেজি বুঝি না, বাংলায় বলো’-টাও একেবারে বাঙালি মা-পিসিমাদের আদুরে ধমকের মতো। কিন্তু, কোনওটার মধ্যেই যে গণতন্ত্রের গন্ধ নেই, বরং বিভিন্ন রকম আধিপত্যের সুর আছে, সেটা মনে রাখা ভাল। গত দু’আড়াই মাসে তৃণমূলের অন্য নেতাদের গলা যতটুকু শোনা গিয়েছে, তাতেও মূলত সেই আধিপত্যেরই সুর।
অগস্টের শেষে একটা নবান্ন অভিযান করার পর এই আন্দোলনে বিজেপিকে আর তেমন ভাবে দেখা যায়নি। দু’রকম তত্ত্ব হাওয়ায় ভাসছে— এক, বিজেপি সুযোগের সন্ধানে আছে, আন্দোলনের সুফল নেবে মওকা বুঝে; এবং দুই, রাজ্যে বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি এতই কম যে, তারা জানে এই আন্দোলনকে ব্যবহার করার উপায় তাদের নেই, ফলে বিশেষ গা ঘামাচ্ছে না। পাশাপাশি একটা তৃতীয় সম্ভাবনা মাথায় রাখা প্রয়োজন। সাংগঠনিক দুর্বলতা, রাজ্য স্তরে যথেষ্ট দক্ষ নেতার অভাব, এ সব সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এখন বৃহত্তম বিরোধী দল। বামপন্থী দল বা কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সমর্থকের সংখ্যার ফারাক এতটাই যে, কোনও তুলনাই চলে না। এই আন্দোলন সফল হলে বাম-কংগ্রেসের দিকে কিছু ভোট ঘুরতে পারে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে বিজেপির ভোটে— কারণ, শহরাঞ্চলের বাইরে কোথাও তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্ক ভাঙবে, এমন সম্ভাবনা এখনও তৈরি হয়নি। বিজেপি স্বভাবতই সেই সুযোগ করে দিতে নারাজ। এবং, গভীরতর কারণ হল, তৃণমূলের রাজনীতির ধরনটাই এমন যে, এক বার তাদের সরিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এলে পাঁচ বছর পরে তৃণমূলের সাইনবোর্ডও সম্ভবত টিকে থাকবে না। বাম দলগুলি তখনও থাকবে। ফলে, তাদের শক্তিবৃদ্ধি করতে বিজেপির আপত্তি থাকাই স্বাভাবিক। কাজেই, কেউ বলতেই পারেন যে, প্রতীকী তৃণমূল বিরোধিতা ছাড়া এই মুহূর্তে বিজেপি বা আরএসএসের সামনে খুব বেশি পথ খোলা নেই। আজকের বিজেপি-তৃণমূলের সম্পর্ক অনেকটা আশির দশকে কেন্দ্রের কংগ্রেস আর রাজ্যের সিপিএমের মতো।
এ কথা অবশ্য রাজ্যের বাম-সমর্থকদের মর্মপীড়ার কারণ হতে পারে। ‘বামের ভোট রামে’ তত্ত্বটি তাঁরা বিভিন্ন ভাবে স্বীকার করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ে। বলেছেন, ওটা রণকৌশল— প্রথমে বিজেপির জোর বাড়িয়ে তৃণমূল বিদায়, তার পর সরাসরি বিজেপির সঙ্গে সংঘাত ও বাম-রাজনীতির জয়। পাঁচ শতাংশ ভোট নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে, অস্বীকার করা যাবে না। তবে ঘটনা হল, ২০০৮ থেকে টানা ষোলো বছর ভোট কমার ধারা অব্যাহত রাখার পরেও (দু’এক বার অবশ্য ভোট সামান্য বেড়েছে, তবে সেটা বড় গলায় বলার মতো কিছু নয়) বামপন্থীরা বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায় চূড়ান্ত প্রাসঙ্গিক। ডাক্তারদের অনশনের প্রসঙ্গে তাঁরা বারে বারেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাব্বিশ দিন অনশন নিয়ে নানা রকম সন্দেহ প্রকাশ করছেন। প্রশ্ন হল, তখনও তো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ক্ষমতায়— কলকাতা পুলিশ কি তাঁর কথা শুনত না? অনশন মঞ্চে খাওয়াদাওয়ার যে অভিযোগ, সে কথাটা পুলিশ প্রমাণ করতে পারল না কেন? সেই অপ্রমাণিত অভিযোগকে অস্ত্র করে রাজনীতি খুব পরিণতমনস্কতার পরিচায়ক হচ্ছে না, বাম-সমর্থকরা এ কথাটা বোঝেন না কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, মমতা যখন মঞ্চ বেঁধে নিজে অনশন করেছিলেন, অতিবামরাও তাঁর সঙ্গে জুটে গিয়েছিলেন। এ দফায় সিপিএমের কোনও নেতাকে কি দেখা গেল এই ধরনের বা সমান্তরাল কোনও তীব্র আন্দোলনের পথে? এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাম-রাজনৈতিক দল সিপিএম শুধুমাত্র অরাজনৈতিক আন্দোলনের পিছনে কেন? সামনে থেকে আলাদা করে প্রতিবাদ করার লোকবলের অভাব? না কি শাসক তৃণমূলের আধিপত্যবাদকে নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া?
এ কথা অনস্বীকার্য যে, সিপিএম প্রত্যক্ষ ভাবে চিকিৎসকদের এই আন্দোলনে সহায়তা করেছে, এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে তা অবশ্যই বাম রাজনীতির একটি যৌক্তিক পথ। সিপিএমের সমর্থক ডাক্তারবাবুরা গোটা আন্দোলনে জুনিয়রদের পাশে থেকেছেন, ঐকান্তিক ভাবে সাহায্য করেছেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক লাভ কিছু জুটল কি সিপিএমের? সামনের ছ’টি উপনির্বাচনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর সঙ্গে জোট হল, ভাঙল কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক। এই অতিবাম দলগুলি দিনের পর দিন দু’টি বিষয়ে স্থির থেকেছে— এক, বিজেপির বিরোধিতা; এবং দুই, সুযোগমতো তৃণমূলের সঙ্গে গিয়ে সিপিএমকে অপদস্থ করা। অতিবামদের এই রাজনৈতিক চরিত্র বার বার জানা সত্ত্বেও এবং বামফ্রন্টের বাকি দলগুলোরও ভোটবাজারে কোনও গুরুত্ব নেই জেনেও, সিপিএমের বৃহত্তর বাম ঐক্যের স্বপ্ন কতটা যুক্তিযুক্ত, সেই প্রশ্ন থাকবে। পশ্চিমবঙ্গে আজও আনুমানিক ত্রিশ লক্ষ মানুষ সরাসরি সিপিএমের সমর্থক— বাকি অতিবাম এবং বামফ্রন্টের অন্যান্য দলের মিলিত সমর্থকের সংখ্যা তার চেয়ে ঢের কম। সেই জায়গায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা যে ভাবে তাঁদের সমর্থকদের ডাক্তার-বিদ্রোহে লোক জোগান দিতে কিংবা সহযোগী দলগুলোকে ভোট দিতে আহ্বান জানাচ্ছেন, তাতে সিপিএমকে স্বার্থহীন ভাবে ভালবাসা ভোটারদের গা জ্বলাটাই স্বাভাবিক। আরও একটি প্রশ্নও থাকছে— এই উপনির্বাচনে সিপিএমের প্রার্থী কি আন্দোলনরত চিকিৎসকদের সমর্থনটুকুও পাবেন?
আপাত-অরাজনৈতিক মোড়কে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী মেধাবী যুব চিকিৎসকেরা যে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন দু’মাসের বেশি সময় ধরে চালিয়ে গেলেন, তা গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। আপাতত আধিপত্যবাদ জিতল, কিন্তু গণতান্ত্রিক ভাবনার ঝলকও চোখ এড়ায়নি। জুনিয়র ডাক্তারদের অভিনন্দন, আধিপত্যবাদী রাজত্বে মধ্যবিত্তকে একটু হলেও আলো দেখিয়েছেন।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা।
(মতামত ব্যক্তিগত)