গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আধখোলা দরজাটার ও পাশেই আছেন তিনি। কিন্তু হোটেলের পুচ্ছপাকা গেস্ট রিলেশনশিপ ম্যানেজার কিছুতেই ঢুকতে দেবেন না! আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে বলা সত্ত্বেও তিনি যাবতীয় কর্পোরেট উপস্থিতি নিয়ে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে। ঘটনাচক্রে, তিনি আবার এক সুপারস্টারের প্রাক্তন স্ত্রী। হয়তো সেই কারণেই আম্বা খানিক বেশি।
করিডরে ছোটখাটো একটা ঝামেলা হচ্ছে শুনে অতিথি নিজেই এসে ঘরের দরজাটা হাট করে খুললেন। এবং খুব ঠান্ডা এবং নিরুত্তাপ গলায় কর্পোরেটিনীটিকে বললেন, ‘‘ওঁকে ঢুকতে দিন। আমি ওঁকে সময় দিয়েছি।’’
সাক্ষাৎকার নিতে বসে দেখলাম, সেন্টার টেবিলের ও পাশটায় বসা আল্লারাখা রহমানের গলা আসলে আরও মিহি। আরও খাদে। আরও দূরবর্তী। এতটাই যে, কথাবার্তা এক বার থামিয়ে রেকর্ডার আগুপিছু করে দেখে নিতে হল ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছে কি না!
২০০৯ সালের সেই নভেম্বর দুপুরে তাঁর সামনে বসে কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল, একান্ত আলাপে প্রায় মিনমিনে এই কণ্ঠস্বরের অধিকারী অত চড়ায় (সেটা কি সি-শার্প? কে জানে! সুরের স্কেল সম্পর্কে তো কোনও জ্ঞানও নেই) সুর ধরেন কী করে! মনে পড়ছিল, ‘রোজা’র গান প্রথম বার শুনে নিজেকে কেমন ভূতগ্রস্ত মনে হয়েছিল। এতটাই তাড়িত হয়েছিলাম, যে সেই অ্যালবামের আদত তামিল সংস্করণ শুনব বলে বরাত দিয়ে ক্যাসেট আনিয়েছিলাম চেন্নাই থেকে! তার পরে এল ‘বম্বে’। মোহাবিষ্ট হয়ে গেলাম। সেই মুগ্ধতা নিয়েই যাওয়া তাঁর কাছে। সাক্ষাৎকারে রহমান কী বলেছিলেন, এত দিন পরে আর সত্যিই মনে নেই। তাঁর কাজকর্ম নিয়েই বলেছিলেন নির্ঘাত। তিনি এমনিতেই মৃদু এবং স্বল্পভাষী। নিজের কাজ নিয়ে সম্ভবত খানিকটা মিতবাকও ছিলেন তখন। কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর বিশ্বব্যাপী ‘ইউনিটি অফ লাইট’ প্রোগ্রামের শুরুর শো-টা করতে। সল্টলেক স্টেডিয়ামে। ঘটনাচক্রে, সেই অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কলকাতার এক পরিচিত এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক। ঠিক ছিল, ওই অনুষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহৃত হবে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসাকল্পে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। প্রথম প্রথম খুব যে সাড়া পড়েছিল, তা নয়। কারণ, তেমন কোনও প্রচারের পরিকল্পনা ছিল না। তখন ফেসবুক-হোয়াট্সঅ্যাপের যুগ আসেনি। ফলে হাতে-হাতে সেই প্রচারও হয়নি।
সেই সূত্রেই আনন্দবাজার পত্রিকা সংস্থার রহমানের অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে-পড়া। কেন যে আমাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছিল, জানি না। কিন্তু ঠিক ছিল, অনুষ্ঠানের আগে পর পর তিন দিন তিনটি লেখা বেরোবে। বিনিময় প্রথায় আনন্দবাজার পত্রিকা রহমানের একান্ত সাক্ষাৎকার পাবে (সেই সূত্রেই আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া এবং কর্পোরেটিনীকে ডিঙিয়ে তাঁর দিকে একটি করুণাসূচক কটাক্ষ হেনে সল্টলেক স্টেডিয়ামের লাগোয়া হোটেলে রহমানের ঘরে ঢুকে পড়া)।
প্রথম এবং দ্বিতীয় দিনের কপি বেরোনোর পর তৃতীয় দিনও (তার পর দিন অনুষ্ঠান) গুটগুট করে গিয়ে স্টেডিয়ামের মাঠে নেমে ভ্যাবলার মতো কলম-নোটবই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি, কী লিখব! সামনে মুম্বইয়ের বিখ্যাত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার লোক মঞ্চ বাঁধছেন আর চারপাশ থেকে বাঘা বাঘা সাউন্ড বক্স আর সাউন্ড সিস্টেম প্লাস্টিকের চাদর মুড়ি দিয়ে তাকিয়ে আছে। পর দিন সন্ধ্যায় ঈষৎ খর্বকায় এবং স্নেহপদার্থের কিঞ্চিৎ আধিক্য-সহ চেহারার ‘ভারতীয় মোৎজ়ার্ট’-এর অঙ্গুলিহেলনে তাদের ভিতর থেকে বিচ্ছুরিত হবে অপার্থিব সব সুর।
চারদিকে খাঁ খাঁ করছে দানবীয় গ্যালারি। খরখরে একটা হাওয়া দিচ্ছে। সেই বাতাসে ভেসে আসছে হাতুড়ির ঠুকঠাক শব্দ আর মনুষ্যকণ্ঠের বিক্ষিপ্ত নির্দেশ। রাজার মঞ্চ তৈরি হওয়ার আঙ্গিকটা দেখতে দেখতে রহমানের জীবনটা মনের চোখে সরে সরে যাচ্ছিল। জন্মগত নাম দিলীপ কুমার। বাবা সঙ্গীতের সঙ্গে পেশার সূত্রে জড়িত ছিলেন। তামিল এবং মালয়ালাম ছবিতে মিউজ়িক অ্যারেঞ্জারের কাজ করতেন। আশ্চর্য নয় যে, মাত্র চার বছর বয়স থেকে রহমান পিয়ানো শিখতে শুরু করেন। কি-বোর্ড বাজানোর জন্য বাবার সঙ্গে স্টুডিয়োয় যেতেন। যেমন যায় অনেক খুদে। তাঁর যখন ন’বছর বয়স, আচমকা বাবার মৃত্যু। যে ঘটনার পরে রহমানের গোটা পরিবার প্রায় পথে বসেছিল! বাবার বাদ্যযন্ত্র ভাড়া দিয়ে সংসার চালাতে হত তাঁদের। স্কুলে ক্লাস করতে পারতেন না নিয়মিত রুজির ধান্দায় বেরোতে হত বলে। কিছু দিন পরে তাঁর মাকে ডেকে স্কুল কর্তৃপক্ষ বলেছিলেন, ওকে কোদামবক্কমের রাস্তায় বাটি-হাতে ভিক্ষে করতে বসিয়ে দিন! স্কুলে পাঠানোর দরকার নেই।
তার পরেও রহমান দু’একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন বটে। কিন্তু সচিন তেন্ডুলকর বা আল্লারাখা রহমানের প্রতিভা আর কবে স্কুলের পুঁথিপত্র মাপতে পারল! না কি তার কোনও প্রয়োজন হয়েছে?
১১ বছর বয়স থেকে দক্ষিণী ছবির বিভিন্ন সুরকারের সঙ্গে বাজাতে শুরু করেন রহমান। তত দিনে তিনি মাকে বলে দিয়েছেন, গোল্লায় যাক বাকি সব! গানবাজনাতেই কেরিয়ার তৈরি করবেন। কারণ, তাঁর মনে হয়েছে, হলে ওটাতেই কিছু হবে। সেই সূত্রেই তাঁর ওয়ার্ল্ড ট্যুর করা এবং ট্রিনিটি কলেজ অফ লন্ডন থেকে ট্রিনিটি কলেজ অফ মিউজ়িকে পঠনপাঠনের জন্য বৃত্তি পাওয়া। তখন তিনি বাজান সিন্থেসাইজ়ার এবং কি-বোর্ড। বাদ্যযন্ত্রই তাঁর ধর্ম ছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে ব্যক্তিজীবনেও ধর্মাচরণ বদলান রহমান। ২৩ বছর বয়সে সপরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। কারণ, এক পিরবাবা তাঁর মরণাপন্ন ভগিনীকে সারিয়ে দিয়েছিলেন। ইসলামে বিশ্বাস জন্মেছিল রহমানের। এ নেহাতই কাকতালীয় যে, যাঁর পূর্বনাম দিলীপ কুমার, পরবর্তী কালে তাঁর স্ত্রীর নাম হবে সায়রা বানু (কিংবদন্তি দিলীপ কুমার-সায়রা বানু জুড়ির সঙ্গে ঘটনাচক্রে মিল)।
১৯৯২ সালে পরিচালক মণিরত্নম তাঁর তামিল ছবি ‘রোজা’-র সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন রহমানকে। সেই ছবি হিন্দিতেও মুক্তি পেল। গোটা দেশ তোলপাড়! তার কাছাকাছি সময়েই শুরু চেন্নাইয়ে রহমানের স্টুডিয়ো ‘পঞ্চথন রেকর্ডিং ইন’-এর। যা দিনেকালে ভারত তো বটেই, এশিয়া মহাদেশেরও অন্যতম অত্যাধুনিক এবং হাই-টেক স্টুডিয়ো হয়ে দাঁড়াবে। মনে পড়ছিল, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি একেবারেই ব্যক্তিগত এক সফরে চেন্নাইয়ে গিয়ে সেই স্টুডিয়োর আশপাশে ঘুরঘুর করেছিলাম। যদি পাকেচক্রে দেখা হয়ে যায়! হয়নি। অরবিন্দ স্বামীর সাক্ষাৎকার নেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু রহমান তখনও অসম্ভব লাজুক, কুনো এবং এবং অপ্রগল্ভ। সাক্ষাৎকার-টাক্ষাৎকারে প্রবল অনীহা তাঁর।
বিভোর হয়ে সেই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই পিছন থেকে কাঁধে একটা চাপড় পড়ল। সঙ্গে অননুকরণীয় ভঙ্গিতে ভেসে এল, ‘‘কী সব লিখছস! সক্কলে টিকিট সায় (চায়)! তুই তো লোক খ্যাপায়ে দিছস!’’
সাদা শার্ট-ট্রাউজার্স এবং পানামা হ্যাটকে কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, লোক খেপানোর এলেম আমার নেই। আমি অ্যাসাইনমেন্টের দাস মাত্র। তিনি প্রাণখোলা হাসলেন। তার পরে স্বগতোক্তির ঢঙে বললেন, ‘‘বড় শিল্পী। খুব বড় শিল্পী।’’
২০০৯ সালের মধ্যে নভেম্বরের সন্ধ্যায় কলকাতা চেটেপুটে রহমান খেয়েছিল। আর এক তরুণ ‘রহমানিয়া’য় আক্রান্ত হয়েছিল। যা সম্ভবত আজীবন চলত। চলতেই থাকত। সম্ভবত।
সম্ভবত। কারণ, ১৪ বছর পরে আবার এক নভেম্বরেই তাঁর সৃষ্ট একটি গান নজরে এল। মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায়। ইতিমধ্যে রহমানের কাজের প্রতি ভালবাসা আরও খানিক বেড়েছে। তিনি ‘জয় হো’র জন্য অস্কার পেয়েছেন। ফলে আমাদের চোখে আরও, যাকে বলে, জাতে উঠেছেন। রহমান এখন সচিন বা বিরাট কোহলির মতো। মাঠে নামলেই লোকে সেঞ্চুরি চায়। ধরে নেয় ব্যাট হাতে নিলেই হান্ড্রেড!
কিন্তু দেখলাম, এ বার লোকজন ক্রুদ্ধ। কারণ, রহমান নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’ গানটিকে ভেঙেচুরে কী যেন একটা বানিয়েছেন। ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, নিরীক্ষার বিকল্প হয় না। স্কোরবোর্ডে যখন রানের পাহাড়, তখনই তো ঝুঁকি নিয়ে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে মারতে হয়। অ্যাডভেঞ্চারকে প্রশ্রয় না-দিলে আর নতুন কিছু তৈরি হবে কোথা থেকে? রহমান সুর নিয়ে নানা পরীক্ষা করেন বলেই তো একটার পর একটা ম্যাজিক তৈরি হয়। অথবা হয় না। লোকে বড়জোর ঠোঁট উল্টে বলে, ধুস! এটা কিস্যু হয়নি। এটাও নিশ্চয়ই তেমনই কিছু একটা করে থাকবেন। কিন্তু এত গেল-গেল রব, এত আর্তনাদ উঠেছে কেন! কেনই বা এই সমবেত ছিছিক্কার!
গানটা শুনলাম। একবার। দু’বার। তিনবার।
ঝপ ঝপ করে ফ্ল্যাশব্যাক হতে শুরু করল চোখের সামনে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের অডিটোরিয়াম। বিশাল, প্রশস্ত মঞ্চে সবিতাব্রত দত্ত দেহের সমান্তরালে দু’হাত ছড়িয়ে গাইছেন, ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট, ভেঙে ফেল্, কর্ রে লোপাট, রক্ত-জমাট শিকল-পূজোর পাষাণ-বেদী!’
সঙ্গে চৌদুনে বাজছে ঢোল, কাড়া-নাকাড়া। গানের গমকে কাঁপছে গায়কের সারা শরীর। সঙ্গে কাঁপছে গোটা প্রেক্ষাগৃহ। মনে হচ্ছে রণদুন্দুভি বাজছে চরাচরে।
নেশাগ্রস্তের মতো চোখ গোল গোল করে সেই ভেরীর নির্ঘোষ শুনছে এক কিশোর। চারদিক উথালপাথাল। মনে মনে প্রোথিত হয়ে যাচ্ছে, ‘‘ওরে ও তরুণ ঈশান, বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ!’’ সেই তখন থেকে এই মধ্যবয়সে পৌঁছনো তার কাছে কৈশোরের সেই ফ্রেমটাই অমোঘ হয়ে থেকে গিয়েছে। সে যখন শোনে, ‘লাথি মার্, ভাঙ্ রে তালা! যত সব বন্দী-শালায় আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি’, তখন কেন কে জানে এই আধা-প্রৌঢ়ত্বেও তার অ্যাড্রিনালিনের খানিক বাড়তি ক্ষরণ হয়। কিন্তু রহমানের সৃষ্ট ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল রণভেরীর সেই নির্ঘোষ বেমালুম বদলে গিয়েছে মেদুর, পেলব এবং মোলায়েম এক প্রেমালু অবতারে। আর সেই কিশোর দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফেকলুর মতো সেটা দেখছে।
দেখছে আর হুড়মুড়িয়ে মগজের একের পর এক দরজা খুলে যাচ্ছে তার সামনে। স্লাইডের মতো সরে সরে যাচ্ছে ১৪ বছর আগের সল্টলেক স্টেডিয়াম, লাগোয়া হোটেলের ঘরে মিতভাষী এক যুবক, বিশালকায় ফুটবল মাঠের হাফলাইন বরাবর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হাজির সাদা শার্ট-ট্রাউজার্স আর পানামা হ্যাটের প্রবীণ।
মনে হল যদি রহমানকে বলা যেত, পরীক্ষায় আপত্তি নেই। কিন্তু কাটাছেঁড়া করতে গিয়ে এত নির্মম ভাবে ছুরি চালালেন যে, গানের আত্মাটারই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হল? আমার কৈশোরটা এ ভাবে কেড়ে না-নিলে চলত না? মনে হল, যদি সুভাষ চক্রবর্তীর বাক্যের অনুযোগ থেকে স্নেহসুলভ কপটতাটুকু বাদ দিয়ে রহমানকে বলতে পারতাম, আপনি কিন্তু সত্যিই লোক খেপিয়ে দিয়েছেন!
আল্লারাখা রহমান শুনতে পাচ্ছেন?