গত কয়েক মাস থেকে করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় মনে হচ্ছিল, আমরা হয়তো এই ভয়ঙ্কর অতিমারির শেষ পর্বে পৌঁছেছি। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব, কালো দিনগুলো স্মৃতি থেকে মুছে যাবে, নতুন করে আলোর দিন, স্বপ্নের দিন আবার ফিরে পাব। কিন্তু এই অতিমারি যেন চলে গিয়েও ফিরে আসে, নতুন কোনও প্রতিরূপ বা ‘ভেরিয়েন্ট’ হঠাৎ করে কোনও দেশে দেখা যায়, কিছু দিনের মধ্যে অনিবার্য ভাবে সারা পৃথিবীতে ত্রাসের সৃষ্টি করে। ভ্যাকসিন নেওয়া হয়েছে, তা সত্ত্বেও কেন এমন শঙ্কা? স্কুল, কলেজ, অফিস, বিদেশযাত্রা, আবার কি সব শিকেয় উঠবে? এর কি শেষ নেই?
ভাইরাসের মূল কাজ হল নিজের সংখ্যাবৃদ্ধির স্বার্থে ‘অতিথি’ খুঁজে বেড়ানো, কারণ জীবন্ত দেহের মধ্যে প্রবেশ না করতে পারলে তার অস্তিত্ব মূল্যহীন। কিন্তু দেহে যখন ভাইরাসের পুনরুৎপাদন হয়, প্রত্যেক নতুন প্রজন্মের মধ্যে অল্পবিস্তর কিছু পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটে। কোন মিউটেশন কখন দেখা দেবে তা আগে থেকে ঠিক ভাবে নির্ণয় করা অসম্ভব। বেশির ভাগ মিউটেশন এলোমেলো বা অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু কিছু মিউটেশন ভাইরাসকে সংক্রমণের নতুন ক্ষমতা দেয়, ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে— হয় সংক্রমণের সংখ্যা বা হার বৃদ্ধি পায় অথবা সংক্রমণ তীব্রতর পর্যায়ে পৌঁছয়। ভারতে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট-এর ক্ষেত্রে আমরা এর ভয়াবহ প্রমাণ পেয়েছি। অথচ ভাইরাসের পুনরুৎপাদনের স্বার্থে জীবন্ত দেহ প্রয়োজন। ক্রমবিবর্তনের এই দ্বন্দ্বে ভাইরাসের মিউটেশন প্রথমে ভয়ঙ্কর সংক্রমণের রূপ ধারণ করলেও পরবর্তী কালে অনেকটা ভোঁতা হয়ে আসে, মানুষের সঙ্গে সহ-বাসের ফলে। স্প্যানিশ ফ্লু যখন ১৯১৮-তে প্রথম দেখা দিয়েছিল, সারা বিশ্বে প্রায় ৫০ কোটি জীবনহানি হয়েছিল। অথচ ফ্লু-ভাইরাস এখন একটা মরসুমি ভাইরাস। প্রতি বছর কয়েক লক্ষ লোক এতে মারা গেলেও ফ্লু ত্রাসের সঞ্চার করে না, কারণ ফ্লু ভাইরাসের মিউটেশন এখন আর অতিমারির পর্যায়ে পৌঁছয় না। একই সঙ্গে, মানুষের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ভ্যাকসিনের মাধ্যমে ক্রমশ জনসাধারণের মধ্যে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ গড়ে ওঠে। তাই বিজ্ঞানীদের ধারণা, কোভিডের ভাইরাসও আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হয়তো মরসুমি ভাইরাসেই রূপান্তরিত হবে।
ইদানীং খবরে সারা বিশ্বে ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট-এর কথা খুব শোনা যাচ্ছে। ওমিক্রন কি ডেল্টার থেকেও বেশি সংক্রমণের ক্ষমতা রাখে? এর বিরুদ্ধে কি ভ্যাকসিন কাজ করবে না? বিশ্লেষণ করে দেখা যাক, ওমিক্রন সম্পর্কে আমরা কতটা ঠিক তথ্য জানি। ওমিক্রন প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকায় দেখা দেয় এ বছরের ২৪ নভেম্বর। যদিও আমেরিকায় তা প্রথম ধরা পড়ে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, গত দু’সপ্তাহের মধ্যেই শতকরা ৭৫ ভাগ নতুন কোভিড রোগী ওমিক্রনে আক্রান্ত। ফলে একটা তথ্য ঠিক যে, ওমিক্রনের সংক্রমণ-ক্ষমতা অন্য ভেরিয়েন্ট-এর থেকে অনেক বেশি, তাই খুব দ্রুত গতিতে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। অথচ একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণের প্রকোপ ডেল্টা ভেরিয়েন্ট-এর থেকে কম। তার ফলে সংক্রমিত হলেও লোকে সাধারণত গুরুতর অসুস্থ হচ্ছে না অথবা মৃত্যু ঘটছে না। যেমন আমেরিকায় এখনও পর্যন্ত এক জন ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ভারতে এখনও এর প্রকোপ খুব দেখা যায়নি। তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে, ভবিষ্যতে এই সংখ্যা অনেক গুণ বাড়বে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, আমরা এখনও ওমিক্রন সম্পর্কে সবিশেষ তথ্য জানি না, আশা করা হচ্ছে আগামী দু’মাসের মধ্যে আরও অনেক সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।
যে কোনও সংক্রামক ভাইরাসের প্রতিরোধে টিকার প্রয়োজন। একই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য, ভাইরাসকে প্রতিরোধ না করলে তা পাল্টাতেই থাকবে, যেমন কোভিডের ভাইরাস আলফা থেকে শুরু করে ডেল্টা আর এখন ওমিক্রন ভেরিয়েন্টে পরিণত হয়েছে। ভাইরাস যত ছড়াতে থাকবে, ততই তার মিউটেশন বাড়তে থাকবে। টিকার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল গোড়ার দিকে, যখন ডেল্টা বা ওমিক্রন ভেরিয়েন্টের অস্তিত্ব জানা যায়নি। বাজারে যে সব টিকা চালু আছে তার প্রতিটিই সমস্ত কোভিড ভেরিয়েন্ট-এর বিরুদ্ধে অল্পবিস্তর প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখে। কিন্তু কোনও ভেরিয়েন্ট এমন ভাবে পাল্টাবে যে, তার বিরুদ্ধে পুরনো টিকা ঠিক ভাবে প্রতিরোধ জোগাবে না, এও অনিবার্য। আশঙ্কা করা হচ্ছে, কিছু চলতি টিকা হয়তো ওমিক্রনের বিরুদ্ধে ঠিকঠাক কাজ না-ও করতে পারে। একই সঙ্গে আরও একটা তথ্য মাথায় রাখা প্রয়োজন, বেশির ভাগ টিকা আমাদের অপরিসীম প্রতিরোধ ক্ষমতা জোগায় না। প্রতিরোধ ক্ষমতা সাধারণত কমে আসে, তাই তা আবার বাড়িয়ে তুলতে বুস্টার ডোজ় নিতে হয়। টিকা দেওয়া শুরু হয়েছিল গত বছরের গোড়ায়, তাই বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রথম থেকেই অনুমান করেছিলেন, সম্ভবত মাস দশেক পরে বুস্টার ডোজ় নিতে হবে। তাই এখনও অবধি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না— ওমিক্রনের বিরুদ্ধে টিকা ঠিক ভাবে কাজ করছে না কারণ টিকার প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে এসেছে, সে ক্ষেত্রে বুস্টার ডোজ় কাজ করবে কি না; অথবা চলতি টিকা আদৌ ওমিক্রনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোগাতে পারবে কি না, সে ক্ষেত্রে বুস্টার ডোজ় কার্যকর হবে না। প্রাথমিক গবেষণায় মনে হচ্ছে, বুস্টার ডোজ় ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কার্যকর হচ্ছে, যদিও ব্যাপক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনও শেষ হয়নি। এও অনুমান করা যাচ্ছে যে, শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ প্রতিরোধ না জোগালেও, বুস্টার ডোজ় গুরুতর অসুস্থতা প্রতিরোধে আশানুরূপ ফলপ্রদ হবে। হয়তো ভবিষ্যতে শুধু তৃতীয় নয়, চতুর্থ বুস্টার ডোজ়— বা প্রত্যেক বছর বুস্টার ডোজ় নিতে হবে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, কোভিড মোকাবিলায় টিকাই এখনও পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। দুঃখের কথা, আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও প্রাথমিক টিকার হার ৭৩%, বুস্টার ডোজ়ের হার মাত্র ১৯%। ভারতে সেই হার ৬০%, বুস্টার ডোজ় এখনও দেওয়া শুরু হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকায়— যেখানে ওমিক্রন প্রথম ধরা পড়ে— প্রাথমিক টিকার হার মাত্র ৪৫%। হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে ৭০-৭৫% মানুষকে টিকা নিতে হবে। গোটা বিশ্বে টিকার হার বাড়াতে না পারলে, অন্য কোনও ভেরিয়েন্ট অনিবার্য ভাবে কোথাও মাথাচাড়া দেবে, অচিরেই বিশ্বে ছড়িয়ে যাবে।
ওমিক্রনের সূত্রপাত নিয়েও অনেক তত্ত্ব ও মত। যেমন: আবার কোনও জন্তুর মাধ্যমে হয়তো তা মানুষের দেহে প্রবেশ করেছে, অথবা ওমিক্রন দক্ষিণ আফ্রিকার কোনও এক ছোট জায়গায় ঘোরাফেরা করছিল কিন্তু ধরা পড়েনি। কিন্তু ওমিক্রনের জিনোম বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, হয়তো ২০২০’র মাঝামাঝি থেকেই এই ভেরিয়েন্টের অস্তিত্ব রয়েছে, ব্যাপক ভাবে প্রকাশ পায়নি। সম্ভবত ওমিক্রন কোনও ‘ইমিউন কম্প্রোমাইজ়ড’ (যেমন এইচআইভি আক্রান্ত) মানুষের শরীরে অনেক দিন থেকেই আস্তানা গেড়ে ছিল, ধীরে ধীরে পাল্টেছে, আর ঠিক সময় ও সুযোগমতো অন্য মানুষের সংস্পর্শে এসে ছড়িয়ে পড়েছে। জিনোম বিশ্লেষণ করে আরও এক আশ্চর্য তথ্য জানা যায়— ওমিক্রন সাধারণ মরসুমি করোনাভাইরাসের এক টুকরো জিনোম নিজের জিনোমে জুড়ে নিয়েছে। ফলে মরসুমি করোনাভাইরাস যেমন ঘরে ঘরে নিয়মিত দেখা দেয়, তেমন ভাবেই ওমিক্রনও ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। কিন্তু ওমিক্রনের ঢেউ যেমন হুহু করে ছড়িয়ে পড়ছে, তেমনই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা কমেও যাচ্ছে। এ থেকেই বিজ্ঞানীদের ধারণা, কোভিডের ভাইরাস হয়তো অন্যান্য মরসুমি করোনাভাইরাসের মতো হতে চলেছে। তা যদি সত্যি হয়, তবে এই অতিমারি পুরোপুরি শেষ না হলেও, আশার আলো দেখা যাচ্ছে— আর পাঁচটা সাধারণ ঠান্ডা লাগার ভাইরাসের মতো কোভিড-ভাইরাস প্রতি বছর ফিরে আসবে, কিন্তু অতিমারির পর্যায়ে আর যাবে না। আরও আশার খবর হল, কোভিড-ভাইরাসের জন্য টিকা ছাড়াও খাওয়ার প্রতিষেধক ওষুধও বেরিয়েছে, অদূর ভবিষ্যতেই বোধ হয় আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারব।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ,
ওয়াশিংটন ডি সি