ব্রাত্য বসুর ‘হুব্বা’ ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাংলাদেশি তারকা মোশারফ করিম। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ব্রাত্য বসুর ‘হুব্বা’ একটি নিগূঢ় সামাজিক দর্পণ। গ্যাংস্টার এখানে গৌণ, গ্যাংস্টারে প্রতিভাত নিওলিবারাল পলিটিক্যাল পৃথিবীই এখানে মুখ্য। নব্য উদার বিশ্বে রিপুর যে উদ্দাম ও সর্বগ্রাসী বিস্ফোরণ, হুব্বা তারই প্রতীক। হুব্বার আয়নায় ধরা পড়ে সমসময়ের কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্যের বারণহীন বিস্তার, অনুতাপহীন প্রতাপ— এটাই এই ছবির কেন্দ্রীয় তাৎপর্য। অধুনা বহুচর্চিত ছবিটি দেখে এই আমার সমাজতত্ত্বগত অনুভব।
আমাদের আদি ডাকাত রত্নাকর অনুতাপে বাল্মীকি হয়েছিলেন। তার মাধ্যমে রামায়ণ প্রকৃতির উপর সভ্যতার জয় ঘোষণা করেছিল। আমাদের আর এক আদি দস্যু অঙ্গুলিমালের বুদ্ধপদে সমর্পণ ছিল বৌদ্ধ শীলের বিজয়প্রাপ্তি। মধ্যযুগের ‘বাগী’দের বিদ্রোহ ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, কিন্তু মানবতার বিরুদ্ধে নয়। অষ্টাদশ শতকে আমাদের রঘু ডাকাতেরা জমিদারদের বাড়িতে হানা দিত, কিন্তু নানা মূল্যবোধ ও মাতৃশক্তির কাছে অবনত থাকত। উনিশ শতকে বঙ্কিমের পুনর্নির্মিত ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী ‘ডাকাইত’ হলেও অনুশীলিত স্বদেশপূজক। এই দীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিতুলনায়, একবিংশ শতকে হুব্বার কোনও অনুশোচনা, শীল, সঙ্কোচ বা নতি নেই। সে স্পর্ধিত ভাবে আত্মপূজক। সে জেনেছে শেষ মন্ত্র: ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর।
বিংশ শতকের ভারতে অবিস্মরণীয় কিছু গ্যাংস্টার ছবি ছিল। (খল) নায়কেরা সেখানে মাতৃক্রোড়ে শিশু, বিচ্ছিন্ন অভিমানী ভাই, আইনের ঊর্ধ্বে, কিন্তু মানবতার ঊর্ধ্বে নয়। যেন তখনও মানবতার কোনও সার্বভৌম সংজ্ঞা রচনা করা সম্ভব ছিল। নব্য উদার পুঁজি এই সম্ভাবনা কেড়ে নেয় এবং পরিণতিতে হুব্বা এই সব ছলনাকে পরিহার করে। হুব্বা শিক্ষককে ধমকে ও মা-বাবাকে মারধরের হুমকি দিয়ে বাড়ি ছাড়ে, আর কখনও ফেরে না। প্রেয়সী প্রথমা স্ত্রী বর্তমানে হুব্বা হেলায় একই অন্তঃপুরে দ্বিতীয়াকে ঢোকায়। হুব্বা খুনের আনন্দে খুন করে, কোনও মমত্ব বা আদর্শে পরিত্রাণ খোঁজে না। কোটিপতি যে আনন্দে অর্বুদপতি হতে চায়, হুব্বা সেই আনন্দে খুনি থেকে খুনিতর হতে চায়। হুব্বার কোনও প্রত্যাবর্তন নেই।
‘হুব্বা’ ছবির পরিচালক ব্রাত্য বসু। ছবি: ফেসবুক।
এই কলাকৈবল্যবাদী ও সর্ব-ধ্বংসী আত্মতন্ত্র আমাদের নব্য উদার সময়ের যুগলক্ষণ। উনিশ শতকে মার্কস ও বাকুনিন প্রভৃতি পুঁজির এই ধর্মহীন, মায়াহীন, প্রেমহীন, সঙ্কোচহীন রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন বটে, কিন্তু কার্যত তখনও পুঁজির বিপরীতে সক্রিয় ছিল অজস্র সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, প্রায়-প্রাকৃতিক সংস্কার। তদুপরি তখন রাজনীতির ভিতর থেকেই উঠে এসেছিল শ্রমশক্তির হুঙ্কার, বিপ্লবের নির্ঘোষ। রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর থেকে তো প্রায় সত্তর বছর জুড়ে পৃথিবীতে সমাজবাদী প্রভাব স্বীকৃত, পুঁজি যেন তখন সেই ঠান্ডা যুদ্ধের সময় একটু সতর্ক ও মৃদুকণ্ঠ। হালের ফরাসি অর্থনীতিবিদ পিকেটি বলছেন, বিংশ শতকের প্রথম তিন-চতুর্থাংশে অসাম্য কিছু কম ছিল। পূর্বসূরি ইংরেজ অর্থশাস্ত্রী কেইন্স যাকে একদা বলেছিলেন পাশবিক স্পিরিট, বিংশ শতকের প্রথম সাত দশকে পুঁজির সেই সত্তা ছিল অনেকটাই বিনীত ও সুভদ্র।
বিংশ শতকের শেষ পাদে জন্তুটিকে বল্গাহীন করলেন রোনাল্ড রেগান ও মার্গারেট থ্যাচারের মতো রাষ্ট্রনেতারা ও ফ্রিডম্যানের মতো বাজারমুগ্ধ পণ্ডিতেরা। পুরনো অ্যাডাম স্মিথ-মার্কা উদার অর্থনীতির তত্ত্বগুলিকে আবার ঝালিয়ে নিয়ে, সমাজতন্ত্রের সাম্যবাদী ঝোঁককে ঝেড়ে ফেলে, এই নয়া উদারবাদীরা একমেরু বিশ্বে আবার পুঁজিকে সিংহাসনারূঢ় করলেন। তত দিনে পুরাতন বহু ধর্ম পবিত্রতা হারিয়েছে, পুরাতন বহু সঙ্কেচ অন্তর্হিত, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ তার শিবিরকে বিধ্বস্ত হতে দেখেছে, শ্রম ক্রমে অসংগঠিত হয়েছে। বিংশ শতকের শেষ দশকে পুঁজি নব্য উদারতায় বিপুল শক্তিশালী, নিঃসপত্ন মহিমায় বিশ্বজয়ী।
হুব্বা সমকালীন এই নিঃসপত্ন তন্ত্রের ছবি। ডারউইন ব্যতিরেকে হুব্বার পক্ষে আর অন্য কোনও সমর্থন নেই। উনিশ শতকের মধ্যভাগে পুঁজির নিদারুণ উত্থানের যুগে ডারউইন বলেছিলেন, স্ট্রাগল ফর এগজ়িসটেন্স আছে, আর আছে সারভাইভ্যাল অব দি ফিটেস্ট। অস্তিত্বের লড়াই এবং যোগ্যতমের বেঁচে যাওয়া ছাড়া ডারউইন প্রাণিজগতে আর কোনও ধর্ম দেখেননি। কিন্তু তখন এই অকরুণ প্রাণিধর্ম সভ্যতা সহ্য করতে পারেনি। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই সমাজবাদের হরেক নৈতিকতা এসে ডারউইনকে আচ্ছন্ন করে দেয়। শতখানেক বছরের মতাদর্শগত যুদ্ধ চালানোর পর সমাজবাদ-সাম্যবাদ-নৈরাজ্যবাদ প্রভৃতি সবই যখন হারল, যখন বিশ্বায়িত পুঁজি বিপুলতর বিক্রমে পুনরায় তার পশুত্ব প্রকাশের সুযোগ পেল, একবিংশ শতাব্দীর সেই গোড়ায় হুব্বার জন্ম তখন অনিবার্য থাকে না কি?
উনবিংশ ও বিংশ শতকে অ-পাশবিক আদর্শের আরেক ঠাঁই ছিল দেশপ্রেমী জাতীয়তাবাদ। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বহু প্রান্তরে স্বাদেশিক জাতীয়তাবাদ স্বার্থতন্ত্রকে বিনম্র রেখেছিল, আত্মত্যাগের জ্বালানিতেও যে দীপশিখা জ্বলে এমন একটা বিশ্বাস জাগরূক রেখেছিল। বিংশ শতকের শেষে এসে কেবল সমাজবাদই বিধ্বস্ত হল না, দেশপ্রেমী জাতীয়তাবোধও বহু তির্যক বিন্যাসে বিস্রস্ত হল। আগে বুঝি ঔপনিবেশকতা-বিরোধী দেশপ্রেমে কিছু ললিত সৌকুমার্য ছিল, পারিবারিক মূল্যবোধের বৃহত্তর প্রক্ষেপ ছিল— ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে একুশ শতকের উত্তর-ঔপনিবেশিক পুঁজিলালিত জাতীয়তাবাদ অনেক মাংসল ও পেশিবহুল, রক্তের আস্বাদে অভ্যস্ত। হুব্বা যখন রক্তের গরম স্রাবে নেশাগ্রস্ত হয়, তখন আমরা সেই বদলে-যেতে-থাকা সমাজেরই পরুষ চেহারা দেখি মাত্র।
ধর্মভয়বিযুক্ত, সাম্যমোহমুক্ত, আত্মতন্ত্রী ও আগ্রাসী এই জনজীবন তো আসলে তা হলে এক বিশাল কলোসিয়াম— যেখানে মাঠের মধ্যে থাকে এক-একজন গ্ল্যাডিয়েটর বা বুলফাইটার এবং গ্যালারিতে থাকে নিযুত রক্তপিপাসু দর্শক। দর্শক উত্তেজিত, তারা চায় শুধু সাফল্যের প্রদর্শন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বা আপন আপন গুহাভ্যন্তরে তারাও তো সমান আগ্রাসী, সমান শোণিত-তাড়িত। মাঠে তারা চায় শুধুই শক্তির জয়— হয় পশুটির, নয়তো পশুসম মল্লযোদ্ধাটির। যোদ্ধাটি জানে, ধর্ম নয়, সাম্য নয়, আদর্শ নয়, শ্লীলতা নয়, সৌকুমার্য নয়, দেশপ্রেম নয়— সামনের পশু থেকে তাকে বাঁচাতে পারে কেবলই কোনও শক্তিশালী পশুতরত্ব। খেলা সেভাবেই সাজানো হয়েছে, উন্মত্ত দর্শককুল সেভাবেই খেলা দেখতে চায়, সেভাবেই তারাও খেলে, নিজ নিজ অনিশ্চিত মাঠে— কিবা পরিবারে, কিবা অর্থনীতিতে, কিবা সমাজে, কিবা মল্লযুদ্ধে। সকল নিয়ম পরিহার্য, সকল মূল্যবোধ পরিত্যাজ্য, পিতা-মাতা-শিক্ষক-স্ত্রী-বান্ধব-সঙ্গীসাথী সকলেই মুহূর্তে নিক্ষেপযোগ্য। সকল রিপুর চূড়ান্ততম ব্যবহারে আসে যে জৈবিক জয়, তা-ই তখন একমাত্র সত্য।
ব্রাত্য বসুর ‘হুব্বা’ এই গ্রহের সর্বনাশের পর্বে আঁকা এক সর্বনাশা ছবি। হুব্বা এক প্যারোডি মাত্র, আমাদের সমসময়ের এক বিপ্রতীপ আখ্যানকাব্য। আসলে আমাদেরই কথা, শুধু উল্টো করে আয়নায় ধরে রাখা কাহিনি। বঙ্কিমের কমলাকান্ত চক্রবর্তী যেমন কোনও আফিংখোর বাউন্ডুলে ছিলেন না, ছিলেন ঔপনিবেশিক ভারতের এক বিপরীতবিহারী চিত্রকর মাত্র— হুব্বাও তেমনই কোনও গ্যাংস্টার নয়, সে এক নব্য উদার সময়ের সংগুপ্ত ভাষ্যকার মাত্র। কমলাকান্তে আমরাই ছিলাম, হুব্বায় আমাদেরই চেনা সমাজের অচেনা প্রতিচ্ছবি।
(লেখক বাংলা ভাষার আলোচক। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা। মতামত নিজস্ব।)