Agnimitra Paul

Agnimitra Paul: রণবীর জনপ্রিয় তারকা, তিনি ভারতীয় সংস্কৃতিকে আহত করলে চর্চা তো হবেই!

রণবীর সিংহের ছবি ‘অশালীন’। কেউ তারকার নিন্দা করছেন। কেউ পুলিশে খবর দিচ্ছেন। কী বলছেন পোশাকশিল্পী ও রাজ্য বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল?

Advertisement

অগ্নিমিত্রা পাল

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২২ ১৫:১৯
Share:

রণবীর-কাণ্ড নিয়ে অগ্নিমিত্রার মতামত।

শিল্প হিসাবে দেখাই যেতে পারে রণবীর সিংহের বস্ত্রহীন ছবি। কিন্তু শুধু ওইটুকুই দেখব কি?

Advertisement

নিজের শিল্পীসত্তা নানা জনে নানা ভাবে প্রকাশ করেন। রণবীর নিজে শিল্পী। যিনি এই ছবি তুলেছেন, তিনিও শিল্পী। এই ছবিও শিল্প বটে। আমিও শিল্পী। ফলে এই ছবিকে ‘অশালীন’ না-ই বলতে পারি। কিন্তু এই নগ্ন ছবিকে অন্য একটি প্রেক্ষিতেও দেখতে হয়। এ দেশের সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে তো চলা যায় না! এখনও আমরা পশ্চিমী হয়ে যাইনি।

সময় বদলেছে। তবে ভারত তো বদলে যায়নি। দেশের সংস্কৃতি এখনও কিছু ভাবনাকে মূল্য দেয়। কিছু চিন্তাধারা, কিছু অভ্যাস, কিছু সংস্কৃতির জন্য আমরা ভারতবর্ষ। তা-ই বা নিজের মন থেকে বাদ দিয়ে দিই কী করে? যাঁরা রণবীরের নগ্ন ছবি দেখে নিন্দা করছেন, প্রতিবাদ করছেন, নিশ্চয়ই তাঁদের সংস্কৃতিতে আঘাত করছে এই ছবি। এ দেশে এখনও আমরা পরিবারের মধ্যে থাকি। পারিবারিক ভাবনাচিন্তাকে গুরুত্ব দিই। বিদেশে যেমন ১৮ বছর বয়স হতে না হতেই সকলে নিজের মতো থাকেন। আমরা সেখানে নানা বয়সের সকলকে নিয়ে, তাঁদের ভাবনাকে সম্মান করেই দিনযাপন করি। শুধু নিজের ইচ্ছা-পছন্দ, নিজেরই ভাল থাকা নিয়ে ভাবতে অভ্যস্ত নই। পরিবারের সকলে একসঙ্গে টিভি দেখতে বসলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন আমাদের অস্বস্তির কারণ হয়। গর্ভনিরোধকের বিজ্ঞাপন নিয়ে তো আরও রাখঢাক।

Advertisement

আমরা কি জানি না যে, মাসের একটি সময়ে মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে হয়? অবশ্যই জানি। সঙ্গমের পরেই সন্তান হয়। তা কি জানি না? তা-ও জানি। কিন্তু কিছু সত্য জানা আর তা চোখের সামনে দেখার মধ্যে ফারাক আছে। আমরা এই সংস্কৃতিতেই বড় হয়েছি। এ দেশের অধিকাংশের মানসিকতা এমনই। এখনও পরিবারের বড়দের সঙ্গে বসে মদ্যপান করায় বিশ্বাসী নয় এ দেশ। তা বলে কেউ কি করেন না মদ্যপান? হয়তো বাবাও করেন। ছেলেও করেন। দু’জনেই জানেন যে, অন্য জনও মদ্যপান করেন। তবু সেই আড়ালটুকু আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। তাকে বাদ দিতে গেলে নিজেদের সংস্কৃতিকেই প্রশ্ন করা হয়।

আর সেই ‘আড়াল’-কেই ভেঙেছে রণবীরের ছবি। এই প্রেক্ষিতেও রণবীরের ছবিটি নিয়ে আলোচনা করা দরকার। তিনি এক জন জনপ্রিয় তারকা। সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁকে দেখছেন। শুধু দেখছেন না, অনুকরণও করছেন। রণবীর এর পর কী করবেন, সেই অপেক্ষায় বসে থাকছেন। সেই কারণেই তো এত কথা! অন্য কেউ হলে এত কথা হতই না। এই তো উরফি জাভেদ নামে এক জন আছেন। তিনি তো কত রকমের পোশাক পরে ছবি তোলেন। তা-ও সকলের পছন্দ হয় না। তাঁকে নিয়ে কি এত কাণ্ড হয়? হয় না কিন্তু।

সেই জন্যই বলছি, রণবীরেরও এ সব কথা ভাবার দায়িত্ব ছিল। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ সমাজে কোনও না কোনও বার্তা দিচ্ছে। এ ছবির মাধ্যমে যে বার্তা যাচ্ছে, তা ঠিক ‘ভারতীয়’ নয়। অনেকেই এমন ছবি দেখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। এই অস্বস্তি তো যুক্তি দিয়ে কাটানো যাবে না।

তবে আমি এই কাজ ‘অশালীন’ মনে করি না। আমি শহুরে জীবনযাপন করি। নিজে পোশাকশিল্পী হিসাবে এত বছর ধরে কাজ করছি। আমাদের অনেক কিছুই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার জায়গা থেকে শিল্পকে দেখার মতো পরিস্থিতিতে আছেন ক’জন? এই ছবি তো প্রত্যন্ত গ্রামে যিনি বাস করেন, তিনিও দেখছেন। শহরের কোনও এক কোণে ছোট্ট বস্তিতে যে শিশুটি বড় হচ্ছে, সে-ও দেখছে। সকলের ক্ষেত্রে কি এক ধরনের যুক্তি খাটে? তাঁদের ভাবনায় যদি আঘাত লাগে, তবে কি আটকাতে পারবেন?

রণবীরের নিরাবরণ ছবি নিয়ে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হওয়ার প্রসঙ্গিকতাও সেখানেই। একে শিল্পীর অধিকারে হস্তক্ষেপ বলাই যায়। কিন্তু সমাজকে উপেক্ষা করলে চলবে না। সকলে কী চাইছেন, কোনটি আপন করে নিতে পারছেন, তা তো দেখতেই হবে।

অনেকে রণবীরের ছবির প্রসঙ্গে লিঙ্গভেদের কথা তুলছেন। এতে কিন্তু আসলে সে সংক্রান্ত ভেদাভেদ দেখা যাচ্ছে না। রণবীর তো প্রথম নন। এর আগে মিলিন্দ সোমান করেছিলেন। তখনও গেল-গেল রব উঠেছিল। আবার মধু সাপ্রে করেছিলেন। তা নিয়েও হইচই হয়েছিল। নিন্দা কম হয়নি। যে কেউ করলেই হবে।

মিলিন্দ-মধুর সেই বিজ্ঞাপন শ্যুট করা হয়েছিল প্রায় ২৫ বছর আগে। যৌনতা নিয়ে তখনও অস্বস্তি ছিল। এখনও আছে। তা হঠাৎ উবে যাবে না সমাজ থেকে। এ তো সংস্কৃতির বিষয়। বিশ্বাসের জায়গা। সেই বিশ্বাসকে সম্মান জানাতে হবে। বিশেষ করে তিনি যখন রণবীরের মতো এত জনপ্রিয় তারকা। যদি আরও ২৫ বছর পর সমাজ বদলায়, তখন না হয় নতুন করে ভাবা যাবে। কিন্তু তার আগে খেয়াল রাখতেই হবে, কোন ছবি দেখানো উচিত, আর কোনটি নয়।

হিন্দু বিয়েতে যেমন এখনও পুরুষরা নারীদের বলেন, বিয়ের দিন থেকে তিনি স্বামী হিসাবে স্ত্রীর ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিলেন। এ সময়ে সে কথা কি আদৌ প্রাসঙ্গিক? কে কার দায়িত্ব নেয় এখন? বিয়ের পরে মেয়েরা বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর সময়ে পিছনে চাল ছুড়ে দেয়। এখনও। এর কি যুক্তি আছে? নেই। কিন্তু সেই রীতি তো আমরা বাদ দিইনি। এখনও ঘরে ঘরে সেই আচার পালন করা হয়। ভারতীয়রা নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে পছন্দ করেন। সব কিছু তো যুক্তি দিয়ে হয় না।

রণবীরকে আমি খুবই পছন্দ করি। অভিনেতা হিসাবে রণবীর দারুণ। আরও অনেক কিছু করার আছে ওঁর। নজরে পড়ার জন্য এ ধরনের কাজ রণবীরের করার প্রয়োজন নেই। এই ছবি কিন্তু শৈল্পিক রুচির দিক থেকে অসাধারণ কিছু নয়। খুবই নিম্নমানের। একটি সাধারণ কার্পেটের উপর শুয়ে আছেন তারকা। খুব রুচিসম্মত ছবি এটি নয়। দেখে মনে হচ্ছে, শুধুই রণবীরের শরীর দেখানোর জন্য তোলা হয়েছে।

মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর কোনও ভাস্কর্য দেখলে কি মনে হবে তাতে শুধুই নগ্নতা দেখানো হয়েছে? কখনওই নয়। কারণ, তাতে শিল্পীর ভাবনা, রুচি, শৈলী আগে প্রকাশ পাচ্ছে। প্রাচীন ভারতের বহু ভাস্কর্য আছে, যেখানে মহিলাদের বিশেষ কিছু অঙ্গ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ক’জন আগে তাতে যৌনতা দেখবেন? রণবীরের এই ছবিটি সে সবের ধারেকাছেও যাবে না। যিনি তুলেছেন, তিনি একে ‘শিল্প’ হিসাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। ফলে একে প্রচারধর্মী একটি পদক্ষেপ ছাড়া আর কী-ই বা বলার আছে? কিন্তু এ ধরনের প্রচার কি রণবীরের আদৌ প্রয়োজন?

শিল্পীর স্বাধীনতার প্রসঙ্গ উঠতেই পারে। অনেকে রণবীরকে ‘ট্রোল’ করছেন। কেউ তারকার জন্য ‘বস্ত্রদান শিবির’ করছেন। এ সব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু শিল্পীর স্বাধীনতা মানেই কি নগ্নতার প্রদর্শনী হতে হবে? শিল্পী নিজের ইচ্ছা মতো কিছু তৈরি করতে পারেন। তা নিয়ে কারও আপত্তির কিছু নেই। তিনি নিজের পরিচিতদের মধ্যে সে কাজ দেখান না! রণবীর যদি কয়েক জন বন্ধুকে এ ছবি দেখাতেন, তবে কারও কিছু বলার ছিল না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি।

খ্যাতির সঙ্গে কিন্তু দায়িত্বও আসে। আমার মতো এক জন ফ্যাশন ডিজাইনার রণবীরের ছবি যে ভাবে দেখবেন, গোটা ভারত সে ভাবে দেখতে বাধ্য নয়। আমার মা-ই হয়তো অন্য ভাবে দেখবেন। তিনি শিক্ষিত। অঙ্ক নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এখন ৭৫ বছর বয়স। তাঁর মতো এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা হয়তো রণবীরের এই ছবি দেখে বলবেন, এই ভঙ্গি তাঁদের সংস্কৃতিকে অসম্মান করছে। সকলে এক রকম হবেন না। কিন্তু রণবীরের মতো বিখ্যাত তারকারা সকলের। ফলে তাঁরা কিছু করলে তা এফআইআর পর্যন্ত গড়াতেই পারে।

তৃণমূল চুরি করছে সকলেই জানেন। কিন্তু তা জানা আর ২১ কোটি, ৫০ কোটি টাকা চোখের সামনে দেখা— দু’টো তো আলাদা। বিদ্যা বালন যেমন বলেছেন, ‘‘মেয়েদেরও একটু আনন্দ পেতে দিন!’’ তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন বিষয়টা। মুম্বইয়ের এক অভিনেত্রীর পক্ষে তা সম্ভব। কিন্তু উত্তর দিনাজপুরের এক শিক্ষক বা অন্ধ্রপ্রদেশের কোনও এক গ্রামের বাসিন্দার পক্ষে কি একই ভাবে চিন্তা করা সম্ভব? তাঁদের মনে হতেই পারে যে, সংস্কৃতিকে আঘাত করা হচ্ছে।

নিজের মতো কাজ করা, পোশাক পরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু উরফির মতো সবুজ তার জড়ানো পোশাক পরে শ্রাদ্ধবাড়িতে যাব কি? কেউ গ্রেফতার করতে পারেন না নিজের পছন্দ মতো পোশাক পরলে। কিন্তু সমাজে থাকতে হলে সামাজিক কিছু রীতি-নীতি-বিশ্বাসকে গুরুত্ব দিতে হয়। রণবীর এক জন দায়িত্ববান তারকা। তাঁর থেকে সেটুকু যদি কেউ আশা করেন, সেটাকে ভুল বলা যায় না।

আবার লিখছি, এত উত্তেজনা কিন্তু বিষয়টার কেন্দ্রে রণবীর আছেন বলেই। বহু মডেল নগ্ন হয়ে শিল্পীদের সামনে বসেন। তাঁদের ছবি আঁকা হয়। এ নিয়ে কিন্তু কেউ কথা বলেন না। এমনকি, উরফি কী পোশাক পরলেন, তা নিয়েও বেশি লোক মাথা ঘামান না। আবার সেই পোশাকই দীপিকা পরলে হইচই হত। যেমন রণবীর পরায় হচ্ছে।

(লেখক পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার। আসানসোল কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক। মতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement